“পাঠগ্রহণের দিনগুলি” সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অমিতাভ দাস (পর্ব – ৩)

পাঠ গ্রহণের দিনগুলি

পর্ব ৩

২০০০ সাল । হাতে একটা বই পেলাম স্যারের আলমারি ঘেঁটে বুদ্ধদেব বসুর ‘ প্রবন্ধ সংকলন’ । শাহাবুদ্দিন স্যারের মধ্যমগ্রামের বাড়িতে তখন যেতাম খুব । ঐ বইটা পড়ে এত ভালো লাগলো যে বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধের ভক্ত হয়ে উঠলাম । একে একে পড়ে ফেললাম কালের পুতুল , কবি রবীন্দ্রনাথ ,আমার ছেলেবেলা , আমাদের কবিতা ভবন । ঐ সময় অগ্নিভ-এর সঙ্গে আলাপে সে পড়া আরো বিস্তার লাভ করে । অগ্নিভ এক গ্রন্থকীট তরুণ আর বুদ্ধদেবের এক নিষ্ঠ ভক্ত । ঐ সময় ‘বিকল্প ‘ বুদ্ধদেব বসুর বই করছে । কিনে ফেলি সমীর সেনগুপ্তের ‘বুদ্ধদেব বসুর জীবন’ । প্রতিভা বসুর ‘মহাভারতের মহারণ্যে’ ; নবনীতা দেবসেনের’ বারান্দা ‘। সে সময় আমি কিছুকাল বুদ্ধদেব আর নবনীতায় আচ্ছন্ন ছিলাম । তবে লক্ষণীয় তাঁর কবিতা তখন পড়িনি ।বা বলা ভালো তেমন টানেনি ।আমার কাছে তখন বাংলা গদ্য মানেই বুদ্ধদেব বসু ,শঙ্খ ঘোষ আর নবনীতা দেবসেন । সুভাষ মুখোপাধ্যায় পড়া শুরু করেছি–অতটা জোরালো নয় । প্রায় ঐ সময়ে পড়েছিলাম ,একদিনে ,’রাত ভোর বৃষ্টি’ । আর কিছু পরে ‘মহাভারত কথা’ । ‘রাত ভোর বৃষ্টি’  উপন্যাসটি নাকি অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট ।আদালত পর্যন্ত গড়িয়ে ছিল ।কই পড়ে আমার তো তেমন কিছু মনে হয় নি  !! কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ ঢোলগোবিন্দের মনে ছিল এই ‘ বইটি আমার বিশেষ পছন্দের । জীবন ও চরিত্র গঠনে সাহায্য করেছিল । আমি তাঁর ভক্ত হয়ে উঠলাম ।
‘৯৭ সাল । কবিতা সম্পর্কে বুঝতে সাহায্য করেছিল যে বইটি ,সেটি সুজিত সরকারের লেখা ‘ কবিতা কেন কবিতা ।’ এই বইটি সকলেরই পড়া উচিত ,অন্তত যাঁরা লিখতে আসছেন তাঁদের তো বটেই । আরো একটি বই সুভাষ ভট্টাচার্যের , সংসদের বই — ‘ কবিতার সহজ পাঠ ‘। ছন্দ বোঝার জন্য কিনেছিলাম ‘কবিতার ক্লাস ।’ যদিও ভালো লাগেনি । ওভাবে ছন্দ শেখা যায় না । তদ্রুপ রবীন্দ্রনাথের ‘ছন্দ’ –সেটাও আমার কাজে আসেনি ।পড়েছি ওই পর্যন্তই । ছন্দ শিখেছি(যদি কিছুমাত্র শিখে থাকি) বিজয় সিংহ স্যারের কাছ থেকে আর আত্ম প্রচেষ্টায় জীবেন্দ্র সিংহরায়ের ‘বাংলা ছন্দ’ পাঠ করে ।যাঁরা সহজে ছন্দ শিখতে চান তাঁদের পক্ষ উপযুক্ত বই এটি ।
তখন  কবি তাপস রায়ের কাছে আমি আর আমার বন্ধু সৌরভ প্রতি রবিবার যেতাম ।তিনি আমাদের গাইড করতেন ।ভালো লেখার উৎসাহ দিতেন । তিনি বলতেন , “ভালো লেখক হওয়ার আগে ভালো পাঠক হওয়া জরুরী “। সে কথাটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে এগিয়েছিলাম । তাঁর রাত্রিবাস ,জোর চার্ণকের কবিতা ,হে পুরাণ প্রথা ও প্রাচীর আমাদের ভাব জগৎকে আন্দোলিত করেছিল । ভাবতে শুরু করেছিলাম ,এটাই কবিতার যথার্থ ভাষা । পরে অবিশ্যি সে ভুল ভেঙেছে ।
‘৯৪-৯৮এই সময় পর্বে আমাদের হাবড়া থেকে প্রকাশিত হ’ত  লাবু ঘোষের ‘সাহিত্য অববাহিকা’  ।আমি তার একনিষ্ঠ পাঠক ছিলাম ।খুব যত্ন নিয়ে করতেন । আমি কয়েকবার লিখে প্রভূত আনন্দ পেয়েছিলাম । আমি ,সৌরভ ,প্রবোধ সরকার আর তুষার ঘোষ মিলে করতাম ‘পাথেয়’ ।বছরে একটাই বেরুতো । তারাদাসবাবু  ,মঞ্জুষ কাকু(দাশগুপ্ত) প্রশংসা করেছিলেন । ‘৯৬ -তে  নভেম্বরে আমার সম্পাদনায় প্রকাশ পায় ‘অবগুন্ঠন সাহিত্য পত্র’ । প্রথম সংখ্যাতেই নির্মল হালদার লিখেছিলেন । তখন পড়েছি নির্মল দার কবিতা খুব যত্ন করে । কত সরল করে বলতেন অন্তরের গভীর গোপন কথা ।
জহর সেনগুপ্ত । আমার আরেক প্রিয় কবি ।তাঁর ‘অন্নস্বাদ’ –রীতিমত নাম করা একটি বই । সত্তর দশকের বাংলা কবিতার এক বিশেষ কবি । অহং শূন্য নির্ভেজাল একজন খাঁটি মানুষ ।তাঁর সান্নিধ্য  , প্রশ্রয় ও মৃদু শাষণ আমাকে ঋদ্ধ করেছিল ।তাঁর কাছে জেনেছিলাম হাংরি আন্দোলনের সাহিত্যিক বাসুদের দাশগুপ্তের নাম ।বাসুদেববাবুর কয়েকটি গল্প পড়ে মনে হয়েছিল –আর কখনো গল্প লিখবো না । বাসুদেব দাশগুপ্তের মত লেখকের সঙ্গে এক মঞ্চে বসে অনুষ্ঠান করা  ভাগ্যের ব্যাপার । তাঁকে দেখলে আমরা রীতিমতো সমীহ করতাম । প্রায়-ই তাঁকে দেখতাম রিক্সায় চেপে হাবড়ায় বিশেষ একটি প্রয়োজনে আসতেন জয়গাছি সুপার মার্কেটে । কাঁধে একটা জিনসের কাপড়ের সাইড ব্যাগ বা শান্তিনেকতনি ঝোলা থাকত । তাঁর ‘রন্ধনশালা ‘বাংলা গল্প সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ । একটি বই লিখেই ভদ্রলোক বিখ্যাত হয়ে গেলেন । রন্ধনশালা পড়েছিলাম ওঁর ছাত্র অরিঞ্জয় বিশ্বাসের থেকে নিয়ে । কী বলব , সেসব গল্প কতকাল আমাকে ঘোরের মধ্যে জারিত করে রেখেছিল । কবি জহর সেনগুপ্তের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে আড্ডা দেবার সুযোগ হয়েছিল । কম কথা বলতেন । তবে মুড ভালো থাকলে অনেক কথাই বলতেন । বেশ রাশভারী মানুষ ছিলেন । আমরা তো চুপ করে থাকতাম । ওঁদের মধ্যে উচ্চমার্গের কথাবার্তা চলত ।
সে সময় আমরা দুর্গানগরে ‘দৌড়’  পত্রিকার মাসিক সাহিত্য  আড্ডায় যেতাম । সম্পাদক মধুমঙ্গল বিশ্বাস সেখানেই থাকতেন । তারপর চলে এলেন হৃদয়পুর । এই আড্ডাও আমার জীবনে আলো-বাতাস দিয়েছে । পাঠ গ্রহণ করেছি আড্ডারুদের কাছ থেকে । পেলাম চিত্তরঞ্জন হীরা ,নারায়ণ মুখোপাধ্যায় ,সুবীর মন্ডলকে ।সুবীর  মন্ডলের ‘ জলটোপ’  আর ‘ঠাম্মাকে বলিস’ তৎকালে চমৎকার লেগেছিল ।নির্মেদ বোল্ড উচ্চারণ । নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের  ‘রূপ-ডাকঘর’ অভূতপূর্ব একটি বই ।অন্যধারার গদ্যকার তিনি ।তাঁর প্রচুর চিঠি আমার সংগ্রহে আছে ।তাঁর রচিত ‘অপাবৃণু’  অসামান্য একটি গদ্যগ্রন্থ ।যা আমার অন্তর জগৎকে নাড়িয়ে দিয়েছিল । তাঁর সান্নিধ্যে ঋদ্ধ হয়েছি ,তা বলাই বাহুল্য ।চিত্তরঞ্জন হীরার ‘অহল্যা পাথর জানে’ বেশ আকৃষ্ট করেছিল ।

দৌড়-এ একটি গদ্য প্রকাশিত হয়েছিল সাহিত্য কী –এই নিয়ে । সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লেখা । পড়ে জেনেছিলাম সাহিত্য কাকে বলে ?কোথায় লুকিয়ে আছে সাহিত্যের রস ? এত চমৎকারর লেখা খুব বেশি পড়িনি আমি সে’সময় । আজও মনে আছে ঐ গদ্যটিতে মহাভারতের প্রসঙ্গ ছিল । ছিল সত্য,  সুন্দর আর শিবের বিশ্লেষণ ।খুব সরস ভাষায় লেখা ।

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।