পথে পথে সঙ্গীতা দাশগুপ্ত

দুবাই – বস্টন
১।
লাগেজের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। খুব কাছেই গলাটা পেলাম “এইখানেই সুটকেস আসবে সবার?”
আমার সাথে একই ফ্লাইটে ছিলেন ভদ্রমহিলা। একা। বয়স আন্দাজ ষাটের মাঝামাঝি। সে অর্থে প্রৌঢ়া কিন্তু হাবেভাবে বৃদ্ধা প্রায়। আমার পাশে সিট ছিল না ওঁর। ছিল সামনে। ঘনঘন কেবিন ক্রুকে ডাকছিলেন। একবার জল চাইলেন। তারপর বোধহয় খাবার। সম্ভবতঃ ডিনার দেওয়ার সময় ঘুমিয়েছিলেন। আমি উঠে হাঁটছিলাম একটু। আশেপাশে সবাই গভীর ঘুমে। ঘাড় হেলানো চোখ বন্ধ করা সারি সারি মানুষ দেখে কেমন অস্বস্তি হয়। আমি দুবাইএর ফ্লাইটে ঘুমিয়েছি তাই ঘুরে বেরিয়ে রক্ত চলাচল ঠিক রাখা। দেখলাম উনি টিভি স্ক্রীনটা বার বার টাচ করছেন।
নিচু হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম “কি দেখতে চাইছেন? সিনেমা?”
হেসে বললেন “বাঙ্গালী? যাক। হ্যাঁ, বাংলা সিনেমা দেখায় বলল পুপু”
বুঝলাম পুপু ওঁর ছেলে বা মেয়ে। নাতি নাতনীও হতে পারে।
পর পর সিনেমা, ইন্টারন্যাশনাল সিনেমা, রিজিওনাল সিনেমা ঘুরে ঘুরে বাংলা সিনেমায় গেলাম। খুব অল্প অপশন। ওঁর পছন্দ হল না।
আমাকে জিজ্ঞেস করলেন তোমার সিট কোথায়?
বললাম আপনার দুটো রো পরে।
তারপর কথোপকথন – উনি বসে, আমি সামনে দাঁড়িয়ে- এইরকম
“একা যাচ্ছ?”
“হ্যাঁ।”
“আমিও একাই যাচ্ছি”
“কোথায় যাবেন? মানে বস্টনেই না আশেপাশে আর কোথাও? ”
“বস্টন থেকে গাড়িতে দু ঘন্টার বেশি লাগে। বোনের বাড়ি”
“আগে কখনও গেছেন?”
“অনেককাল আগে। বোনের মেয়ের অন্নপ্রাশনে। তারপর তার ছেলে হল। বোন অন্নপ্রাশন দিল দেশে গিয়ে। সে ছেলে এখন মাস্টার্স করছে আর সেই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আমিও স্কুল থেকে রিটায়ার করে গেছি। এবার ভাইবোনেদের কাছে ঘোরা ছাড়া কোনো কাজ নেই। আচ্ছা শোন, আমার ব্যাগে কিছু খাবার আছে। বোন বলেছিল না নিয়ে আসতে। তাও এনেছি। এয়ারপোর্টে কি খাবার ধরে?”
এই রে…এবার আমি ঘাবড়াই
“ধরে কখনও সখনও। কী আছে খাবার? ”
“বেশি কিছু না। অল্প তিলের খাজা আর বড় গজা কয়েকটা। মগের মধ্যে বেশ ভাল করে ঠেসে ভরে নিয়েছি সুটকেসে”
“মগ?”
“হ্যাঁ, আসলে বুঝলে না, আমি বাপু ওই কাগজ টাগজ একেবারেই। ফিক করে হাসেন উনি… বোনকে বলিনি কিছু। কী দরকার ওদের বিরক্ত করে। কিন্তু আমি ওই ভাবে মুছেটুছে স্বস্তি পাব না বাবা।”
আমিও হেসে ফেলি। বলি, বেড়াতে গেলে আবার ওই মগটা নিয়ে যাবেন ব্যাগে করে?
“কী আর করা? বেড়াতে তো যাবই। আর তাছাড়া এখন মেজ বোনের বাড়ি যাচ্ছি। ওখানে একমাস থেকে ভাইয়ের বাড়ি যাব সিয়াটল-এ। সেখান থেকে আমার খুড়তুতো দিদির কাছে সাব স্যান হোসে।”
কথাটা মগ থেকে গড়িয়ে গেল ভাইবোনে। ভাই বোনেদের পড়িয়েছেন, বিয়ে দিয়েছেন। মা বেঁচেছিলেন বছর পাঁচেক আগেও। এখন মা নেই। চাকরি শেষ। ঝাড়া হাত পা। তবে ভাইয়ের ছেলে মেয়েরা কলেজে। বউ চাকরি করে। বড় ননদের সাথে ফোনে ভাব আছে কিন্তু দেখাসাক্ষাৎ কম…
“একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি জান, অবাঙ্গালীরা যে দেশেই থাকুক নিজেদের ভাইবোনেদের সাথে খুব ভাল যোগাযোগ থাকে, যাতায়াতও। আমাদের বাঙ্গালীদের মধ্যে এটা অতটা দেখি না…”
আমি আপত্তি করতে গিয়ে ভাবি কথাটা মিথ্যে নয় তেমন। সত্যিই যতই আমাদের কবি “বেঁধে বেঁধে থাকা”র কথা বলুন বাঙালী বাড়িতে ভাইবোনেদের ভাবভালবাসাটা যেন বয়সের সাথে সাথে ওই ভাইফোঁটা কি টুকটাক উৎসবেই আটকে যায়।
“জানিনা আমিও কত দিন থাকতে পারব। ভিসা আছে মালটিপল এন্ট্রির কিন্তু কী জান, হেডমিস্ট্রেস থেকেছি এত বছর, স্বভাবেও ডিসিপ্লিন ব্যাপারটা মিশে গেছে.”
পরে আরও এক দুবার আমি উঠে হাঁটছিলাম। উনি ঘুমোচ্ছিলেন। সামনে দেখলাম অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট চলছে। বুঝলাম দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে গেছেন।
ব্যাগ প্রায় একসঙ্গেই এল। ওঁর ব্যাগ দুটি বেজায় ভারী। এর মধ্যেই একটিতে আছে সেই মগে ভর্তি তিলকূট আর খাজা। ট্রলিতে ব্যাগ তুলে পাশাপাশি বেরোচ্ছি।
উনি আমার হাত চেপে ধরলেন খুশিতে… ওই দেখ, আমার বোনপো। নিজে হাতে বাংলায় লিখে এনেছে নামটা। যেন আমি ওকে চিনতে পারব না!
দেখলাম এগজিট গেটের মুখে একমুখ হাসি নিয়ে একটি বাদামী রঙের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে প্ল্যাকার্ড। তাতে পরিষ্কার বাংলায় লেখা শ্রীমতি সরস্বতী গাঙ্গুলী।
গন্তব্যে পৌঁছে বাড়িতে ফোন করে জানালাম এবার সরস্বতীর সাথে এক ফ্লাইটে এসেছি।
মেয়ে বলল সরস্বতীর বীণা ছিল সাথে? বা হাঁস?
বললাম নাহ, মগ ছিল জানি। তাতে লুকোনো তিলকূট।
২।
আটলান্টা থেকে ডালাসগামী আমি। ভাগ্যক্রমে এমার্জেন্সি এক্সিটের পাশের সিটটা পেয়েছি। সেজ জ্যাঠামশাই গোছের একজন কেবিন ক্রু এসে গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলেন প্রয়োজনে আমি যাত্রীদের প্রাণ বাঁচাতে সাহায্য করতে রাজী আছি কিনা এবং তিরিশ পাউন্ড ভারি জিনিস তুলতে পারব কিনা।
হ্যাঁ শুনে ততোধিক গম্ভীর হয়ে আমার দিকে এমন ভাবে তাকালেন যে আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম বলছেন “যদি কাজের সময় পিছিয়ে গেছ তো দেখো শাস্তি কাকে বলে”।
বিদেশি ফ্লাইটে কাঁদুনে বাচ্চা কম থাকে। তবে কপালগুণে এই ফ্লাইটে একখানি ছিল আমার সামনেই …তার কান্নাটান্না থামলে আমি হাতের বইটি খুলে মন দিয়েছি কী দিইনি, ট্রলি ঠেলে দীঘল মেয়েটি এসে দাঁড়াল। পাশ্চাত্যের ভঙ্গিমায় পশ্চিমি পোশাকে যেন আর কেউ ও। প্রাচ্যের কপালের রেখা, অল্প পুরু ঠোটের ভাঁজ, উদ্ধত গালের আভাস আর এক মাথা অজস্র বিনুনি নিয়ে কৃষ্ণাঙ্গী নিচু হয়ে জানতে চাইল আমি কোন পানীয় নেব। আমার মনে হল যদি ওর বিনুনিগুছি খুলে পিঠময় ছড়িয়ে দিই একরাশ চুল আর স্কার্ট ব্লাউজের বদলে জড়িয়ে দিই তসররঙা পাটের শাড়ি তবে মেয়েটি এই মুহুর্তে পাঞ্চালী হয়ে উঠবে। বদলে যাবে ওর শরীরের ভাষা। এই বিনীত ভঙ্গিমা ওকে একদম মানাচ্ছে না। ইউনিফর্মের আঁটো বেষ্টনী ওর সহজ সাবলীলতায় অদ্ভুত পর্দা টাঙ্গিয়ে দিয়েছে যেন।
আমি বোধহয় একটু বেশিই সময় নিলাম। আমার বরফছাড়া জলের বায়না মিটিয়ে মেয়েটি বাঁদিকে তাকাল। পাশাপাশি দুই অপরিচিত। একজনের হাসিমুখে লালচে দাড়ি গোঁফ, মাথায় ছোট্ট ঝুঁটি। অন্যজন বাহুল্যবর্জিত ছিপছিপে সুঠাম এবং গেরামভারি। মেয়েটি আবারও একই ভাবে তাদের চাহিদা জানতে গেল এবং কেন কে জানে হঠাৎ ভীষণ লাজিয়ে লালচে পার্পল অপ্রস্তুত হাসিতে মাখামাখি হয়ে গেল নিজেই। আবারও ঝলকে উঠল কৃষ্ণা। যজ্ঞের আগুনে তপ্তবর্ণা মেয়েটি অপূর্ব এক মিঠে লাজুক মুহুর্ত ঠোঁটের ভাঁজে এঁকে বাঁদিকের আর্যপুত্রদুটির তেষ্টা মিটিয়ে এগিয়ে গেল আপন আভিজাত্যে।
আমি মনে মনে ওকে ডাকলাম “যাজ্ঞসেনী … ”
মেয়েটিও পিছু ফিরে আমার দিকে হেসে আর একবার শুধাল “তুমি কি নিশ্চিত তুমি কিছু চাও না? … “