“… nothing in the world induce me to accept any argument that justify butcheries. Yes, I choose to be blindly obstinate till the day when I could see my ways more clearly.” –The Plague-Part four(6)
হয়তো কোনোদিন কোথাও রাইফেল রোড নামে একটি রাস্তা ছিল যেখানে আমি অনেক বছর আগে প্লাস্টারহীন, ইট বেরনো একটা বাড়ির তেতলার জানলায় পা ঝুলিয়ে বসে দেখতাম সার সার ট্রেন লাইনের ওপর দিয়ে মরচে রঙের সব ধারণাতীত বড়ো ট্রেন আসছে যাচ্ছে। ট্রেনে চড়েছি কয়েকবার। কিন্তু ভেতরে ছিলাম বলে বুঝতে পারিনি কতো অপরিমেয় বড়ো হতে পারে সে। অনন্ত সময় ধরে যেন সে চলেছে। কোথাও কোনো জানালা নেই। দরজায় কাগজ জড়ানো তালা ঝুলছে। জানালায় মানুষ বসে থাকা ট্রেনের থেকে এই ট্রেনগুলো আরও অনেক বড়ো। ইঞ্জিনে বসে থাকা তার চালকদের নিস্পৃহ মুখ দেখতাম। অবাক হয়ে ভাবতাম যারা ট্রেন চালায়, কতো মজা ওদের। তবু একটুও হাসে না কেন ওরা! নাকি লুকিয়ে হাসে! রাত্রিবেলা বাড়ি ফিরে ছাদে শুয়ে তারায় ভরা আকাশ দেখতে দেখতে সারাদিনের জমিয়ে রাখা হাসি ওরা একা একা হাসে, তারপরে ঘুমিয়ে পড়ে!
রাতে ইঞ্জিনগুলোর লাল আগুনে ভর্তি বয়লারে যখন আগুন দেওয়া হতো, তখন লাল আলোর ছোটো ছোটো জোনাকি ওড়াতে ওড়াতে ট্রেন যেত।
কাদের বাড়ি ছিল রাইফেল রোডে যেখানে আমি সম্ভবত কয়েকদিন ছিলাম! জীবনে আর কখনও এই অদ্ভুত রাস্তার নাম শুনিনি। কোনো কথায়, কোনো সংবাদে রাইফেল রোডের নাম আর একবারও আসেনি। সেই বাড়ি আর সার সার ট্রেন লাইন সঙ্গে নিয়ে আমার রাইফেল রোড নিঃশব্দে হারিয়ে গেছে। পুরু কাচের চশমা পরা চন্দনদা বলেছিল ‘কাম সেপ্টেম্বর’ নামের একটা বাজনা যেন ভুলেও কখনও না শুনি আমি। শুনলে ওর মতোই পাগল হয়ে যাব, আর লেখাপড়া করতে ইচ্ছে করবে না, আর ওর মতোই একশোটা ‘কাম সেপ্টেম্বর’এর রেকর্ড জমাতে ইচ্ছে করবে। সম্ভবত চন্দনদাকেও রাইফেল রোড সঙ্গে নিয়ে গেছে একশোটা রেকর্ড সংগ্রহ করার অনেক আগেই।
‘রূপোলী খুর’ গল্পের ককভানিয়া নামের সেই বুড়ো মানুষটির সাথে রাইফেল রোড কোনো অদৃশ্য বন্ধুত্বে বাঁধা ছিল হয়তো, ঠিক যেমন সারাজীবনের মতো বন্ধু হয়ে থাকলাম দাবিয়াঙ্কা নামের সেই ছোট্ট মেয়েটি আর আমি। সাইবেরিয়ার কোনো দুর্গম জনহীন এলাকায় বুড়ো ককভানিয়া প্রতি বছর চলে যায় রূপোলী খুরের এক অলৌকিক হরিণের খোঁজে। সেখানেই সে বানিয়ে নিয়েছে কাঠের তক্তার এক বাড়ি যার চারদিকে কাচের জানলা। বয়স হয়ে গেছে বলে এবার ককভানিয়া দূরের গ্রাম থেকে দাবিয়াঙ্কা নামের এক ছোট মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। মেয়েটির বাবা মা খুব গরিব বলে বুড়ো কিছু টাকাকড়ি দেয় তাদের। দুটো জামার ছোট্ট একটা পুঁটলি একটা ভাঙা পুতুল, আর তার প্রিয় বেড়ালকে নিয়ে ককভানিয়ার স্লেজের পাশে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে পড়ে দাবিয়াঙ্কা।
বেড়ালটা ছিল দাবিয়াঙ্কার বন্ধু, দার্শনিক এবং পথপ্রদর্শক। যখন সংশয়ে দুলতো তার মন, সিদ্ধান্ত নিতে পারত না, দাবিয়াঙ্কা তখন প্রশ্ন করতো আর বেড়ালটা প্রতিবারই একই কথা বলতো—‘এক্কে বার্রে ঠিক! তুমি এক্কে বার্রে ঠিক বলছো!’ —কী ভালো হত যে এমন একটা অসাধারণ বেড়াল যদি থাকত আমার।
বুড়োর স্লেজের পিছনে ছোট্ট পুঁটলি হাতে দাবিয়াঙ্কা আর তার বেড়াল অনেকদিনের পায়ে হাঁটা পথ পার হয়ে শেষে পৌঁছল বরফে ঢাকা বনভূমির মধ্যে বুড়োর সেই কাঠের বাড়িতে। সারাদিন বুড়ো বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায় অনেক দূর। হয়তো খুঁজে বেড়ায় রূপোলী খুরের সম্ভাব্য গতিবিধি। ফাঁকা বাড়িতে দাবিয়াঙ্কা সারাদিন ঘরকন্না সামলায়, রান্না করে। সন্ধেবেলা কাঠের আগুনের সামনে বসে খাবার খায় ওরা তিনজন। বুড়ো ককভানিয়া তখন রূপোলী খুরের গল্প বলে দাবিয়াঙ্কাকে। সে এক অলৌকিক হরিণ, দুয়েকজন ছাড়া কেউ যাকে দেখতে পায়নি। ছিপছিপে, মাথায় আঁকাবাঁকা ডালপালার মতো শিং, আর রূপোর খুরওলা সেই হরিণকে কোনো কোনো চন্দ্রালোকিত রাতেই শুধু দেখা যায়। কোনো উঁচু বরফের টিলায় দাঁড়িয়ে যখন সে পা ঠোকে, চারিদিকে ঠিকরে ওঠে পান্না, হিরে, চুনির অসংখ্য টুকরো, যেমনটা রাজামহারাজার কাছেও নেই।
কিছুদিনের জন্য ককভানিয়া বাইরে গেছে। বাড়িতে দাবিয়াঙ্কা আর বেড়াল সারাদিন ঘুরে বেড়ায়, কথা বলে নিজেদের মধ্যে। রাত হলে দাবিয়াঙ্কা কাচের জানলায় এসে বসে। অনেক দূরের বাড়িতে মা, বাবা, ভাই, বোনের জন্য মন কেমন করে তার, কাঁদে। বন্ধু বেড়াল ঘন হয়ে আসে তার কাছে। সান্ত্বনা দেয়। কথা বলে। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে দাবিয়াঙ্কা।
এক রাতে জানলায় বসে থাকা দাবিয়াঙ্কা হঠাৎ দেখতে পেল বনের মধ্য দিয়ে ছুটে যাচ্ছে এক হরিণ। জানলা থেকে জানলায় ছুটে বেড়ায় দাবিয়াঙ্কা হরিণটাকে দেখতে। বাড়ির কাছে বরফের টিলায় যখন সেই হরিণটা এলো, সব নিষেধ ভুলে দরজা খুলে এক দৌড়ে বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে পড়ল সে হরিণটাকে ভালো করে দেখতে। তাকে দেখেই যেন থমকে দাঁড়াল হরিণটা, রূপোলী খুর আছড়ালো বারবার। নানারঙের অজস্র আলো ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। যখন দাবিয়াঙ্কা সচেতন হলো তখন দেখল, বনের ছায়ায় দৌড়ে হারিয়ে যাচ্ছে হরিণ। আর যেখানে সে পা ঠুকছিল নানা রঙের উজ্জ্বল মণিমুক্তোর রাশি পড়ে আছে সেখানে।
পরদিন সকালে বুড়ো ককভানিয়া এলে দাবিয়াঙ্কা তাকে নিয়ে যায় যেখানে হরিণ এসে দাঁড়িয়ে ছিল। তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখে কোথাও কিছু নেই। বরফে, এক জায়গায় শুধু হরিণের খুরের দাগ জেগে আছে। জ্যোৎস্নায় হরিণের খুরের আঘাতে জেগে ওঠা বরফে, রঙের যে ফোয়ারা উটেছিল, সকালের রোদে আর তাদের চিহ্ন নেই কোথাও।
পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় জুড়ে এই গল্পটা বারবার আমার কাছে আসে আর মন ভাল করে দেয়। নতুন কোনো অনালোকিত অঞ্চল সে চকিতে আমাকে চোখ ফেরাতে বলে। ভাবতে বলে নতুন কোনো অভিমুখ।
বুড়ো ককভানিয়া যার সারাজীবন কেটে গেল দেখা না দেখায় মেশা বিদ্যুৎলতার মতো, মরীচিকার মতো, এক বরফ, বনজ্যোৎস্না আর অলৌকিক হরিণের খোঁজে, দিনাবসানে তার পাওয়ার ঝুলি ফাঁকা। কিন্তু সে হেরে যায়নি। কেননা তার কোনো প্রতিপক্ষ নেই, যুদ্ধ নেই কোথাও, রক্তপাত নেই। একটু ঝুঁকে, স্লথ পা টেনে, স্লেজের বেল্ট কাঁধে বেঁধে অনেক রাস্তা হেঁটে সে বাড়ি ফিরবে।
২।
ব্যর্থতার যে কতোরকম মুখ। চালগম বোঝাই একটা মোষের গাড়ি নদীয়ার নাজিরপুর মোড় থেকে থানার পাড়ার দিকে যাছে। বন্যার জল নামেনি তখনও। হাঁটু জল পার হয়ে পাঁচ মিনিটের হাঁটা রাস্তার শেষে যে প্রাইমারি স্কুল, বানভাসি কয়েকটি পরিবার তখনও থাকে সেখানে। বিকেল তার অস্তিত্ব একটু দ্রুত মুছে ফেলছে সন্ধ্যাকে জায়গা করে দেবে বলে। বাঁশের স্তূপের ওপর বসে গাড়োয়ান। হঠাৎ থেমে গেল বাঁশের গাড়ি। গাড়োয়ান হাঁক পাড়ল ওপর থেকে। দুটো রোগাক মোষ চুপচাপ দাঁড়িয়ে। গাড়োয়ান এগিয়ে এল বস্তাগুলোর ওপর দিয়ে। চেঁচিয়ে নির্দেশ দিল কয়েকবার। দুটো মোষ একইরকম চিত্রার্পিত দাঁড়িয়ে। যেন থেমে গেল বাতাসের স্রোত, রাস্তার গাছগুলোয় বন্যা-উদাসীন পাখিদের ডাক থেমে গেল—সব কিছু যেন বস্তুর মতো স্থির ছবি হয়ে উঠেছে।
সরু রাস্তা জুড়ে থমথম করছে মোষের গাড়ি। আরো থমথমে পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়াল পিছনে। দু-তিনবার বেজে উঠল অধৈর্য হর্ন আর গাড়োয়ান উন্মাদের মতো মারতে শুরু করল মোষ দুটোকে। আঘাতের দমকে মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছিল মোষ দুটোর পিঠের চামড়া। রক্তঠাসা পুরুষ্টু একটা জোঁক খসে পড়ল একজনের পিছনের পা থেকে। মোষ দুটো তবু অবিচল। নিষ্পন্দ। কিছুতেই তারা নড়বে না। একজন হোমগার্ড নেমে এল গাড়ি থেকে। পরিস্থিতি মেপে নিল একঝলক তাকিয়ে। তারপর নিচু হয়ে একরত্তি একটা বাদামী কুকুরছানা তুলে আনল একটা মোষের পায়ের সামনে থেকে। অনেক বৃষ্টি আর বন্যায় ভিজে আজ সারাদিনের রোদ্দুরে গরম রাস্তায় সেই কুকুরছানাটি ডুবে গেছে গভীর ঘুমে। পিঠে পঁচিশ ত্রিশ কুইন্টাল মানুষের খাবার বহুদূর থেকে বয়ে আনছে যে দুটো মোষ, তাদের একজনের পরবর্তী পদক্ষেপ দূরত্বের মাপে নির্দিষ্ট হয়ে আছে ঘুমন্ত কুকুরটির পেটে। তার পরবর্তী পা ফেলায় একটি শিশু কুকুরের প্রাণ যাবে, গাড়োয়ানকে এটা বোঝানোর মতো ভাষা তার নেই। মানুষের চিৎকার আর প্রহার থেকে আসা নির্দেশগুলো সে স্তব্ধ ঔদাস্যে অগ্রাহ্য করে যায়। ‘রূপোলী খুর’ গল্পের ককভানিয়া আর মোষগাড়ির চালকের যা নেই, তা এই inner eye। ধারণা ও বিশ্বাস থেকে যারা কাজ করে যায়, কিন্তু চোখের অন্তর্ভেদ তাদের নেই। থাকলে ককভানিয়া বরফে হাত রাখত আদরে আর অনুভব করত দামী পাথরদের ঘুমন্ত মুখ। সে হেরে যেত না এভাবে।
আঘাতে কেঁপে ওঠা মোষের পিঠ সহসা যেন নিয়ে যায় ১৬৩৬সালে আঁকা রেমব্রান্টের রক্তপাতময় ‘The Blinding of Samson’ ছবিটির স্মৃতিতে। অমিত শক্তিমান, অদম্য স্যামসনকে বশীভূত করতে ডেলাইলাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল স্যামসনের শক্তির উৎস জানার জন্য। প্রেমের অভিনয় করে ডেলাইলা জানতে পারে স্যামসনের শক্তি নিহিত আছে তার চুলে। চুল কেটে শক্তিরহিত করে নৃশংসভাবে চোখে বর্শার ফলা ঢুকিয়ে তাকে অন্ধ করে দেয় সৈন্যরা। রেমব্রান্ট এই মুহূর্তটিকে ধরে রাখলেন তাঁর সম্পূর্ণ, ক্রূর জান্তবতা অক্ষুণ্ণ রেখে। পিকাসোর গয়ের্নিকা বা ফ্রন্সিসকো গয়্যার ‘১৮০৮ সালের ৩রা-মে গণহত্যা’র থেকে অনেক বেশি পাশবিক এই ছবিটির সামনে দর্শক কোনো প্রতীক খোঁজার অবকাশই পাবেন না, কেননা রেমব্রান্টের এই ছবিটির সামনে চোখ খুলে রাখাই যায় না।
৩।
পরিশুদ্ধ আনন্দ চলে গেছে জীবন থেকে, চপল গতি রুপোলী খুরের মতো। নিজের মধ্যে জমে থাকা ধ্বংসে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা চালিয়ে একজন বেদনার্ত আলো বহনকারীর মতোই মানুষ এক্ষণ তার নিজের ধ্বংসাবশেষের বিপুলতা থেকে বুঝতে পারে সে ঠিক কতো বড় ছিল আর কতো দূর সর্বস্বান্ত হয়েছে সে। তিমির চোয়ালের হাড় দিয়ে তৈরি পায়ে ভর করে পেকডের ডেকে দাঁড়িয়ে উন্মাদ হিংস্র জান্তব আক্রোশে মবিডিককে অনুসরণ ও হত্যা করার পর ক্যাপ্টেন আহাব একটা লণ্ঠন জাহাজের গা দিয়ে ঝুলিয়ে নিচে নামায়। তারপর কাছি দিয়ে টেনে আনা অতিকায় মবিডিকের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার মনে হয়, তার নিজের মধ্যে অন্ধকার জলস্রোতের অনেক নিচে লুকিয়ে থাকা তাঁর একা অন্যরকম কোনো মবিডিক এখনও বেঁচে। পরিপূর্ণ মৃত্যু হয়নি এখনও সেই মবিডিকের। হবেও না হয়তো। পরিপূর্ণ মৃত্যু এখনও হয়নি সেই মবিডিকের। হবেও না হয়তো।
জঙ্গলে জ্যোৎস্নায় বরফে পা আছড়ে যে বর্ণবিচ্ছুরণ তুলেছিল রূপোলী খুর, সেটা দেখার মুহূর্তে যে অলৌকিক উদ্ভাসনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল ছোট্ট মেয়ে দাবিয়াঙ্কার, আর সেই অনুভূতি ফিরবে না কখনও। তার বিস্ময় থেকে বিচ্ছুরণ থেকে অনেক দূর চলে এসেছে মানুষ। আকার ও রঙের যন্ত্রণাদায়ক অনৈক্যের মধ্যে নিরাশ্রয় ছুটে বেড়াচ্ছে সে।