আর একটা ভুলও হয়েছিল। অতীনের পরামর্শে রুমা সি গ্রুপের পদ-তালিকা ক্রমটাকেই নিজের পছন্দের ক্রম দেখিয়েছিল যার ফলে জয়েন্ট বিডিও পদটি দাঁড়ায় রুমার প্রথম। রুমা বেলেঘাটার কমার্শিয়াল ট্যাক্স বিভাগটা প্রথম পছন্দ হিসাবে দাগাতে চাইলেও, জয়েন্ট বিডিওর সম্মান ও ক্ষমতা বেশি বলে অতীন কেবল সদ্য বাচ্চা হওয়া বৌকে গ্রামেগঞ্জে পোস্টিং নিতে উৎসাহিত করেছিল। বরের ওপর খানিকটা অভিমান বসতই ঐরকম পছন্দক্রম দিয়েছিল, যেটা সম্ভবত সাক্ষাতকার গ্রহণকারীদের খুব একটা আস্থাব্যাঞ্জক লাগেনি। গ্রাম নিয়ে করা নানা কূট প্রশ্নের সপ্রতিভ উত্তর দিয়েও শেষ পর্যন্ত গ্রুপ ডি-র তালিকাতেও নাম উঠল না। এতদূর এক সুযোগে এগিয়ে এসে কেমন প্রত্যয় জন্মেছিল, মন দিয়ে তীব্রভাবে কিছু চাইলে একদিন না একদিন সাফল্য আসেই।
ইন্টারভিঊকে সাফল্যের সিঁড়িই ভেবেছিল। ভাবেনি অবতরণের ফরমান তৈরি হয়ে চলেছিল তার অপেক্ষমান দিনগুলোতে। তখন অতীনের অফিসের ঠিকানাতেই যোগাযোগ রক্ষা হত। কিছু কিছু চিঠি অবশ্য হাউজ় ওফ রবিন চৌধুরীর ঠিকানাতেও আসত। বহুদিন পর্যন্ত উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করেছে, এই বুঝি অতীন সঙ্গে সুখবরের চিঠি এনেছে। আর করতে হয়েছে বর বাড়িতে ফিরলেই মুখ ঝুলিয়ে বিলাপ। নিজের বহুকাঙ্খিত সন্তানকে অপয়াও মনে হয়েছে। ‘সৎ চেষ্টার ফল ফলবেই’ একদিন এই বিশ্বাসটাই চলে গেল জীবন থেকে। সংসার যতটা সময় দাবি করে, ঠিক ততটুকু দিয়ে আলস্যে ঘুমে দিনগুলো পার করে দেওয়াই মানুষটির লক্ষ্য এখন। মেয়েটা এখন অত ছোট তো নেই যে সর্বক্ষণ নজরে রাখতে হবে। বেশ হোত যদি চিরতরে ঘুমিয়ে পড়া যেত। কাটা ছেঁড়া করে নিজেকে শারীরিক পীড়ন করে মরতে বড় ভয়। ঘুমটাই যেন তাকে যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর দরজা দেখিয়ে ফিরিয়ে আনে বার বার।
“এত রাতে লাইট জ্বালিয়ে কী হচ্ছে? সারা দিন তোমার মতো ঘুমিয়ে কাটাই না। রাতেও যদি অন্তত ছ ঘণ্টা ঘুম না হয়..?”
“শুয়েই তো ছিলাম। এই উঠলাম। বাথরুম যাব বলে লাইট জ্বালিয়েছি।”
আজ রাতে ওষুধ খেতে ভুলে গেছে রুমা। ওষুধ বলতে একটা অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট আর একটা সিডেটিভ। রাতের খাওয়ার আগে ভুলে গিয়ে পরে খেলে আর ঘুম আসতে চায় না। বরং সারা রাত অদ্ভূদ অস্বস্তি শিরশিরানি কষ্টে এপাশ ওপাশ করতে হয়। বেশ খানিক্ষণ তাই করল রুমা। ঘুম না এলে ঘন ঘন ছোটো-বাইরে পায়। এত কম জল পান করে ও; অথচ বারবার অতটা করে জল বিয়োগ হয় কী করে জীবনবিজ্ঞানে উত্তর পাওয়া ভার! বার বার মশারি খুলে খাট দুলিয়ে ওঠা নামা করলে মশা ঢুকে যায়, ঘুমের মধ্যে গুবলু উসখুস করে। ওর বাবা আপাত নিঃসাড়ে ঘুমোলেও হঠাৎ হঠাৎ জেগে ওঠে, আর জেগে উঠলে স্বাভাবিকভাবে ঘুম যে ভাঙায় তার ওপর প্রসন্ন হতে পারে না।
আবার স্নানঘরে গেল রুমা। এবার গা ধুয়ে ফিরল। গ্রীষ্মকালে এরকম সারা দিনে বার দশেক চলে। গাঙ্গেয় পশ্চিম বাংলায় ঘামটাও যে হয় মারাত্মক। তোয়ালে পরে আর নাইটি কাঁধে গেল ফ্রীজের কাছে। তেষ্টা পেয়েছে। কিন্তু কনকনে ঠাণ্ডা জল গলায় ঢাললেই বিপদ। বাইরের জল মিশিয়ে নিতে হয়। বোতল বার করার আগে রুমা হাত বাড়াল জামশেদপুর থেকে পাঠানো মিষ্টির প্যাকেটের দিকে। দুপুর বেলা রুটি পরোটার সাথে সাধারণত একটা মিষ্টি খেয়েই থাকে। কাজু বরফির ক্ষেত্রে হিসাব রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। ঘুরছে ফিরছে একটায় কামড় বসাচ্ছে। রাতের দাঁত মাজা হয়ে গেছে। তাও একটা বরফি কয়েক কামড়ে পেটে চালান করল রুমা। জল খেল। শোবার ঘরে গেল। গুবলু বাবার ঘাড়ে পা তুলে ঘুমোচ্ছে। অতীন মেয়ের আদরের ঠেলায় বিছানার এক প্রান্তে একটুখানি জায়গায় শুয়ে আছে। বিছানার অর্ধেকের বেশি যার জন্য ফাঁকা, তার চোখে ঘুম নেই। হাঁচি শুরু হল। সতেরো-আঠেরো। নাক আর টাকরা জ্বালা করছে। একটা নয়, পর পর দুটো অ্যাভিল ফিফটি খেতে হল। ইদানিং অ্যাভিলে আর ঘুম আসে না। শরীরে আনচানানি বেড়ে যায়। বিছানায় কোনও ভঙ্গীতেই সুস্থিরে শুয়ে থাকতে পারে না। এপাশ ওপাশ, হাত-পা ছোঁড়া, বারবার শোয়া-বসা করতে হয়।
মশারির মধ্যেই আলো জ্বালিয়ে লিখতে বসল রুমা। অতীন আবার জেগে উঠে না রাগ করে। কতগুলো দুর্বোধ্য শব্দকে খাপছাড়া ভাবে খাতার পাতায় ছড়িয়ে দিয়ে কবিতা লেখে না রুমা। যে কবিতার অর্থ নিজের কাছেই স্পষ্ট নয়, তেমন লেখাকে কবিতা বলবে কি না ভেবে পায় না। আজ একটা গল্প নিয়ে বসল রুমা। ইউনিভার্সিটিতে বিএড পড়ার সময় মারাত্মক রকম প্রেমে পড়েছিল একজনের। তার সঙ্গে নির্জনে তো দূর, জনসমক্ষেই সাকুল্যে দু-আড়াই ঘণ্টার বেশি দেখা বা বাক্য বিনিময় হয়নি। নিজের ব্যক্তিগত সুন্দর অনুভূতি গোপনে রাখারই পক্ষপাতী ছিল ও। তাছাড়া ছেলেটার আগ্রহী হাবভাব রুমার আবেগ উস্কে দিলেও সেই ব্যক্তির মনোভাব তখনও স্পষ্ট ছিল না। প্রত্যাশা, ব্রীড়া আর ভুল ভাবছে না তো – এই আশঙ্কার মিশ্র অনুভূতিতে রুমার অবস্থা খুবই সঙ্গীন। জীবনে প্রথমবার। প্রথমবারই; কারণ বছর দশেক বয়সে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়তে সপ্তম শ্রেণীর কাউকে ভালো লাগাটা যে পূর্বরাগ জাতীয় কিছু তা বোঝার আগেই ছেলেটির বাবার বদলির কারণে আর দেখা হয়নি। কোনও আনুষ্ঠানিক বিদায় বা মনোমালিণ্য নয়। তখন বুকের ভেতর ধুকপুকুনি কোনও সম্পর্কের প্রত্যাশা তৈরি করেনি, শুধু বেশ কিছুদিন অস্থির অপেক্ষার পর এক সময় হতাশ হয়েছিল মাত্র। কষ্ট হলেও তীব্রতা টের পায়নি। তাই একুশ বছরের রুমাকে অনাঘ্রাতা যুথিই বলা যায়। প্রথমবারই তো। হে ঈশ্বর!