হ্যাঁ, ছেলেটা ধূপ বেচত। বছর পাঁচেক আগেও। জামসেদপুর জুগসলাই থেকে কিনে আনত ধূপের কাঁচামাল। তারপর বেশ কয়েকটা প্রক্রিয়া শেষে সুগন্ধী তরলে চুবিয়ে ফ্যানের বাতাসে শুকিয়ে নিত ধূপের কাঠি। রঙীন মোড়ক, চকচকে প্যাকেটে মুড়ে দোকানে দোকানে পৌঁছে দিত। এক বাজার থেকে আরেক বাজার। লাভ নেহাত মন্দ হত না কিন্তু ছেলেটা ভাবত, সে ধূপ বেচে না। গন্ধ বেচে। কিসের গন্ধ! কার গন্ধ! ধূপের না মানুষের! ইতর প্রাণীরা মানুষের গন্ধ টের পায়। মানুষ কি মানুষের গন্ধ টের পায়! হয়ত পায় কিম্বা পায় না। সে কখনও পায়নি। মানুষের গন্ধ বা নিজের গন্ধ। একটা গন্ধ সে পেত। মেয়ে মানুষের গন্ধ! অনেকদিন আগেই সেটা মুছে গেছে। পচা শামুকের মতো বিটকেল গন্ধ। কোনো কোনো মানুষের গন্ধ নাকি পদ্ম ফুলের মতো হয় আবার কারো কারো নাকি গোলাপ, যুঁই গন্ধরাজ লেবুর মতো। কিন্তু সে সব মেয়ে মানুষের গন্ধ সে কস্মিনকালেও পায়নি।
এই সব কী লিখছ তুমি! আমি মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। ধূপ, গন্ধ, মেয়েমানুষ, পচা শামুক, গন্ধরাজ লেবু… এই সব কী!
ধূপ বেচতে বেচতে গন্ধ বেচে ছেলেটা। গন্ধ বেচতে বেচতে স্বপ্ন দেখে। হ্যাঁ ছেলেটার নাম নীল। স্কুলের খাতায় নাম ছিল নীলোৎপল। তার আরেকটা গল্প আছে। গল্পের ভেতর আর একটা গল্প। সেই গল্পে তার মা, বাবা, আরও কেউ কেউ লাফিয়ে ওঠে।
আমি কোনো গল্প শুনতে চাই না। আগে যে গপ্পটা দিয়েছ সেটাই এখনো গলা থেকে নামেনি। আরো এই হাটের মাল বাজারে আর বাজারের মাল হাটে করছো।
বাবা মদ খেত না। মাঝে মধ্যে গাঁজা খেত। মাঝে মধ্যে মানে সপ্তাহে চারদিন। হাতে টাকা না থাকলে তিনদিন। আর এই তিন-চার দিন মা বাবার হাতে মার খেত।
উফ, পাগল করে দেবে মাইরি! আমাকে এইসব জানিয়ে তোমার কী হবে বলতো? আমি তোমাকে চিনি না। তুমিও আমাকে চেনো না। তাহলে এত কথা কিসের!
নীল আমায় বৃষ্টি বলে ডাকে।
আর বনলতা! চাইছি তোমার বন্ধুতা!
হাসির একটা তীরতীরে স্রোত বয়ে গেল। সেই স্রোতে কেউ খান খান হয়নি। আনচানও হয়নি। কেবল ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে কলিজা। সন্ধ্যে নামছে। এই সময় মা এসে জিজ্ঞেস করবে, রাতে কী খাবি বল? চকলি পিঠা বানাব নাকি ভাত?
আর নীল কাঁদত। মা কাঁদত না। বলত,’আরও মারো, মেরে মেরে শেষ করে দাও। আমি আর বাঁচতে চাই না। বেঁচে কী হবে!’
বাঁচা আর মরার মাঝখানেই এই জীবন। একে নিয়েই যত আদিখ্যেত! লাফ-ঝাপ, ল্যাং, ওড়াওড়ি…
আর যেদিন বাবা গাঁজা খেত না সেদিন গলা ছেড়ে একটা গান গাইত। ” আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি।” বড় হয়ে নীল জেনেছে এটাকে রবীন্দ্রসংগীত বলে। সেদিন একটা একটা রুটির টুকরো মুগডালে চুবিয়ে মায়ের মুখে তুলে দিচ্ছে বাবা। মা বলছে,’ তুমি খাবে না!’ বাবা হাসত।
‘সুস্থ হও। হে আমার বন্ধু, তুমি/ ভোরের বাতাসে আর/ আগুনের মধ্যে/ সুস্থ হও। সুন্দর তোমাকে থাক / ঘিরে। … … … বলো : ভালোবাসা, বলো : জীবন আলোসমান,/ হাতে হাত রাখা।’ —ভাস্কর চক্রবর্তী
‘গাঁজা না খেলে আর কিছু খেতে ইচ্ছে করে না। নীল পড়ার ভান করে বই খুলে ভাবছে একি যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা নাকি প্রেম প্রেম খেলা। একদিন ঝগড়াঝাটি পরের দিন দুয়ারে জাগ্রত বসন্তকাল…
শোনো, এবার আমি জিমে যাব। তোমার মেসেজ পড়ে পড়ে আমার মাথা পুরো জ্যাম হয়ে গেছে। স্নায়ুরা সংকেত জটে পড়ে ভ্যাবাচ্যাকা। তুমি এখন অফ হও। পরে আবার কথা হবে। ভাল থেকো…
আমার কথা এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। শোনো। আর সামান্যই আছে…
আচ্ছা বল। আমি ততক্ষণ চা খেয়ে আসি।
এইসব ভাবতে ভাবতে নীলের বই এর এক একটা অক্ষর উড়ে যাচ্ছে। সিলিং-এ ধাক্কা খেয়ে আবার মেঝেতে ঠোক্কর খাচ্ছে। একপক্ষে স্বরবর্ণ অন্যপক্ষে ব্যঞ্জনবর্ণ। এদের যুদ্ধ হলে কারা জিতবে!
গাঁজা, যুদ্ধ, অক্ষর, বই… নিজের মুখ দেখে উঠলেই এমন ঝামেলা পাকায়। অর্ণব আগেও দেখেছে। ঘুম থেকে উঠে যেদিনই সে আয়নার কাছে গেছে সেদিনই মেলা ঝামেলা। মারপিট, খুন খারাপি ব্যাপার স্যাপার ঘটবেই ঘটবে।
মহাভারতের যুদ্ধে পাণ্ডব-কৌরব। জিতল সেই পাণ্ডব। মানে সংখ্যাটাই সব নয়। যুদ্ধে অন্য গণিত কাজ করে। কি সেই গণিত! কৌশল নাকি সততা!
সততা শব্দটা শুনলে মাথায় ভূত নামে। নিজেকে পাগল পাগল মনে হয়। থালা বাটি ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে করে। বরং কৌশল শব্দটা নিজের নিজের মনে হয়। বেশ ঘ্যামা একখানা শব্দ বটে। সাদা কাগজে কৌশল শব্দটি লিখে নীলের চুমু খেতে ইচ্ছে করে। ‘ কৌশল’ তার কি ঠোঁট আছে, জিভ আছে!
যাক, চুমু পর্যন্ত এসে গেছ। বাহ! আর কত দূর নামবে বৃষ্টি!
অমন বলছ যেন চুমু শব্দটা এই প্রথম শুনলে!
না না, প্রথম শুনব কেন! হাজার লক্ষবার শুনেছি। লেখো, লেখো। পড়তে ভালই লাগছে।
বৃষ্টির দিনে মা খুব ভালো খিচুড়ি বানাত। মুগডালের সঙ্গে গোবিন্দভোগ চাল, আলু, ফুলকপি, কুমড়ো, মটরশুঁটি। স্বাদ যেন অমৃত। বাবা বলত,’ সুপর্ণা, তুমি আমার বউ না হলে তোমাকে আমি মা অন্নপূর্ণা বলে প্রণাম করতাম।’ মা মাথায় হাত ঠেকিয়ে বলত,’ ওসব বলো না গো, আমার যে পাপ হবে!’
আর পাঁচ মিনিট অর্ণব। তারপর আর কোনোদিন তোমাকে জ্বালাব না। প্রমিস।
নীল বুঝতেই পারত না তার বাবার সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক। ভালোবাসার নাকি কিসের এই সম্পর্ক! আর বুঝতে না পারলে তো মন খারাপ হবেই। তবে কি ওই কল্কে আর গাঁজা। দুটোর মধ্যে আগুন ধরালেই সব ওলট-পালট। বিতিকিচ্ছিরি, ঢিসুম-ঢিসুম। মা ওগুলো লুকিয়ে দিত না কেন! ভেঙে দিত না কেন! তবে কি মা মার খেতে ভালোবাসত! ধূর মার খেতে কার ভালো লাগে!
অঙ্ক ভুল কষলেই কী মারই না খেতাম। কিন্তু বৃষ্টি মার খেলে নীল কেন কাঁদবে। এইসব তাকে অসহ্য করে তুলত। মনে হত কাঁচা খেয়ে ফেলে। মুখে জিভ ঢুকিয়ে চুকচুক করে পান করবে তাজা রক্ত!
অন্য কেউ মার খেলে নীলের কেন কান্না পাবে। নীল তার হদিশ দেয়নি। আমি জানতে চাই। খুঁজতে চাই। গরু খোঁজার মতো। খড়ের গাদায় ছুঁচ খোজার মতো। কিন্তু কিছুই খুঁজে পাই না।
সেই নীল ধূপের গন্ধ নিয়ে, নিজের গন্ধ নিয়ে বৃষ্টি নামের মেয়ে মানুষের গন্ধ নিয়ে হারিয়ে গেল আর আমি তাকে খুঁজেই পেলাম না। মেয়ে মানুষেরাও পুরুষ মানুষের গন্ধ পায় সেকথা বৃষ্টি কখনও নীলকে জানায়নি। নীল জানত! জানি না।
অর্ণবের মাথা ধরে এসেছে। চায়ে চুমুক দিচ্ছে। মুখে অবশ্য বলছে ভাল লাগছে না। কিন্তু অদৃশ্য কেউ যেন বসিয়ে রেখেছে কম্পিউটারের কাছে।
এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে আমরা মানে আমি আর নীল মানে বৃষ্টি আর নীল এমন একটা জায়গায় পৌঁছলাম। যেখানে ধূপের গন্ধ নয়। লিপস্টিকের গন্ধ। ভেজা চুলের গন্ধ। ঘুমহীন নিঃশ্বাসের গন্ধ। মেয়েমানুষের গন্ধ। পুরুষমানুষের গন্ধ। কিন্তু এই গন্ধ নির্জীব! তার বমি আসছে। সে ভুলে যাচ্ছে ধূপের গন্ধ। বই এর গন্ধ। মায়ের গন্ধ। বাবার গন্ধ। দুধ, রুটি, মুগডাল, খিঁচুড়ি। বৌদির দোকানের চা। কান্নার নোনাজল। বিছানার উপর বমি, বমি বমির বন্যা। ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। নীল ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে সে। বৃষ্টি একা একা কাঁদছে।