• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিশ্বজিৎ লায়েক (পর্ব – ৪)

জন্মস্থান – পুরুলিয়া পেশা – সরকারি চাকরি প্রকাশিত কবিতা বই :- ১) ডানায় সে চুম্বকত্ব আছে ২) উন্মাদ অন্ধকারের ভিতর ৩) ভিতরে বাইরে ৪) পোড়া নক্ষত্রের কাঙাল ৫) মুসলপর্বের স্বরলিপি ৬) কৃষ্ণগহ্বর ৭) শরীরে সরীসৃপ ৮) প্রেমের কবিতা ৯) পোড়ামাটির ঈশ্বর ১০) ঈর্ষা ক্রোমোজোম উপন্যাস ১) কৃষ্ণগহ্বর

পূর্ব প্রকাশিতের পর…

ঘড়ি রাত এগারোটার কাঁটা ছুঁল। এখনও দু-চার জন যুবক রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছে। সাটার ঝোলানো দোকানের বারান্দায় বসে কেউ কেউ ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে মগ্ন। কেউ কেউ ভিডিও ক্লিপিংস দেখছে। এরাই আমাদের ভারতবর্ষ! সারা বিশ্ব যাকে ভাবছে আগামী প্রন্মের সুপার পাওয়ার। কেননা ভারতের ছেলে মেয়েরা সফটওয়ার আর কাজের ইংরেজি ভালো বোঝে। তাতে কাজ হবে! অর্থনৈতিক, সামাজিক, আত্মীক বাস্তবটা গুরুত্বপূর্ণ নয়!
রাস্তায় নির্বাক দাঁড়িয়ে কয়েকটা ফ্যাশনেবল বাইক। মুরগির স্টু আর খান দশেক রুটি সাবড়ে পান খেতে ইচ্ছে হল। তাই এত দূর আসা। সুনয় তিনটে পান কিনল। কয়েকদিন আগেও এই রানীগঞ্জ মোড়ে তিনটা পানের দাম  ছিল সাড়ে সাত টাকা। এখন বারো টাকা। দিন দিন জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। তবে এটা তো ঠিক টম্যাটো তিরিশ থেকে আশি হলে রিক্সাওয়ালা মুকুন্দ যে দামে কেনে, সুনয় কিম্বা তার বস অনিমেষকেও সেই দামেই কিনতে হয়। অর্থাৎ টম্যাটোর দর মূল্যায়নে মুকুন্দ, সুনয়, রাকা, অনিমেষ এক সরলরেখায় বসবাস করে। সোহম কিছুতেই বুঝতে পারে না এটা সাম্য না অসাম্য । এটা বীজগণিত না পাটিগণিত! এটা ত্রিকোণমিতি না ক্যালকুলাস!
এই মফস্‌সল শহরে সুনয়ের পাঁচ বছর যাপন পূর্ণ হল আজ।  সেটা কী খুব গুরুত্বপূর্ন, আজ হয়ত নয়! কিন্তু পাঁচ বছর আগের এই দিনটা মানে এই ১৭ জুলাই, পোষ্ট অফিসের ডাকে আসা বাদামী রঙের খামের ভেতর লম্বা একটা কাগজ তার জীবনে অনেকটা স্বপ্ন ভরে দিয়েছিল। দুলতে দুলতে থিতু হওয়া আর নিরাপত্তার স্বপ্ন। বাড়ির সবকটা মুখেও সেই আলোবাতাসের প্রচ্ছন্ন প্রকাশ ছিল। এই মফস্‌সল শহরের অনেকেই সুনয়কে স্যার বলে ডাকেন। কোন কারন নেই। অকারন। অমনি অমনি। সুনয়ের লজ্জা হয়। এইমাত্র পানের দোকানে এসে দাঁড়ালেন যে ভদ্রলোক সুনয়কে দেখেই বললেন, ‘ কেমন আছেন স্যার?’
সুনয় চিনতে পারল না। তাকাল। বলল, ‘ ভালো। আপনি কেমন আছেন?’
-‘পান খাবেন স্যার?’
-‘ না, নিয়েছি। আপনি খান।’
-‘ চুল যে সব সাদা হয়ে যাচ্ছে। কালার করুন এবার। কথাটা শুনেই বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা মনে পড়ল।
“ ভালোবাসলে হাততালি দেয় এমনি ওরা গাধা/ বলে, তোমার বুকের ভিতর ম্যাজিক দেখাও, ম্যাজিক-/ দেব আমরা হাজার টাকা চাঁদা।/ যদিও ভালোবেসে আমার মাথার চুল সাদা।’’
-‘ অ্যাই বুড়ো বয়সে কালার করবো বলছেন!’
-‘ আপনার কত?’
– ‘এখনও চল্লিশ হতে বছর পাঁচেক সবুর করতে হবে!’
ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন, ‘ এই বয়সে আবার দুটো বিয়ে করা যাবে। বুঝলেন স্যার!’
আমি না বুঝেই হাসলাম। হো হো করে হাসলেন সেই ভদ্রলোকও। তাল মেলালেন দোকানের মালিক ভাতৃদ্বয় এবং দুই কর্মী। মুচকি হাসলেন গোটা তিনেক খদ্দের, এক মাতাল আর রাস্তার পাগল।
রাস্তাঘাট শুনশান হচ্ছে। ভদ্রলোক বললেন, ‘ চলুন স্যার আপনাকে ছেড়ে দিয়ে আসি। অ্যাই দেখুন গল্পে গল্পে কখন বারোটা বেজে গেছে। স্কুলডাঙায় কুকুরের খুব উৎপাত।’
‘আরে বাবা, ইনি তো দেখছি আমার নাড়িনক্ষত্রের খবর রাখেন।’ কৌতুহলী সুনয় বাইকের পিছনে বসল।
ড্রপ করে চলে যেতেই সুনয়ের মনে পড়ল আরে এই লোকটার খাবারের হোটেল আছে তো। প্রথম প্রথম ওই
হোটেলেই সুনয় দুবেলা খেত। সেই সূত্রে পরিচয়। এতক্ষণ স্মৃতি বিটরে করায় লজ্জিত হল সুনয়।
ঠিক সময়ে ঠিক লোককে চিনতে না পারা। এটা কী কোন অসুখ! হতে পারে। আবার নাও হতে পারে।
স্মৃতিশক্তি কী লোপ পাচ্ছে ! পেলে তো ভালোই। অনেক অপ্রিয় ঘটনা ভুলে যেতে চায় সুনয়। কিন্তু ভুলতে পারে  না। কেবল ঘুমের মধ্যে তারা ডিস্টার্ব করে না। কিন্তু বেশিক্ষণ আর ঘুমোনো যায় না, সকাল সাতটার মধ্যে উঠতে হয়। দাঁত মেজে গরম জলে সামান্য লেবু। সুনয় হেলথ্‌ ম্যাগাজিনে পড়েছে এই লেবু জল নাকি ফ্যাট কাটার। মাঝে মাঝে সামান্য মধু মিশিয়ে সুস্বাদু করা। তারপর রুটি আর মিলিঝুলি সব্জি। আগে তো রুটি বেলতে গেলে ভারতবর্ষের ম্যাপ হয়ে যেত। শুধু ভারতবর্ষ নয় এক একবার পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদনিপুরও হয়ে গেছে। এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। ঠিক ঠিক গোল হয়। নিটোল বৃত্ত। সুকান্তের কবিতার মতো পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি না হলেও এক এক সময় ঝলসানো রুটি পূর্ণিমার চাঁদ হয়। আসলে প্রয়োজন মানুষকে উন্নত করে তোলে। আর আজকের সভ্যতা সে তো প্রয়োজনেরই আউটপুট। আর অভ্যেস এর চেয়ে বড় শিক্ষক এই পৃথিবীতে নেই। সুনয় এই কথাগুলি শুনেছিল সেই কবে আর আজ এটা অনুভব করল ভিতর থেকে। অফিস থেকে ফিরে সুনয় চারজন মানুষকে দেখে। কেন দ্যাখে তা জানে না। কিন্তু প্রবল ইচ্ছে তাকে রাস্তায় টেনে আনে।
১) ভদ্রলোক অসুস্থ। হাত-পা সরু হয়ে গেছে। অক্ষম।খুব কষ্ট করে হাঁটেন। একটু হাবাগোবা কি! না, মানসিক ভাবে অসুস্থ। অথবা স্নায়ুর প্রবলেম। ভদ্রমহিলা তাঁর স্ত্রী। নিপাট গৃহবধূ। প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটার সময় নতুনচটি থেকে আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে তাঁদের দাম্পত্য, বিশ্বাস আর প্রেম এগিয়ে যায় জীবনের দিকে আর একটু, আর একটু , আর একটু…
২) বড় পোষ্ট অফিসের সামনে। আলু পেঁয়াজের দোকান। বিক্রেতার গলায় তুলসির মালা। মাছ, মাংস, ডিম তিনি কিছুই খান না। কিন্তু মাছের ঝোল, ডিমের ঝোল, মাংসের ঝোল খান। পরম আশ্লেষে। ষোল টাকা কেজি আলু পেঁয়াজ তিরিশ টাকা। রসুন দু-চার টাকার কেনা হয় বলে কেজির দাম জানে না সুনয়। আলু, পেঁয়াজ, রসুন বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক বিনা পয়াসায় জ্ঞান বিলি করেন। জ্ঞান বলতে তাঁর অভিজ্ঞতা! কথা বলতে বলতে অনেক সমস্যার সমাধান যে আপনা আপনি হয়ে যায় সুনয় ওঁর কাছ থেকেই শিখেছিল। অবশ্য কথা চালাতে হবে মুখোমুখি বসে অথবা দাঁড়িয়ে, পিছন ফিরে নয়! আর একটা প্রজন্মের সঙ্গে অন্য প্রজন্মের যে দ্বন্দ্ব, বিশ্বাসের ফারাক সেটাই আমাদের মানব সমাজকে বিকাশের পথে এগিয়ে দেয় এই উপলব্ধিও আলু বিক্রেতার কাছে পেয়েছিল সুনয়।
৩) পেট্রল পাম্পের মোড়ে বারো ক্লাসের দুই ভাই চা-কফির দোকান দিয়েছে। দোকানের একপাশে ওষুধ দোকান আর অন্যপাশে বন্ধ দোকানের ঝাঁপ। সেখানেই খালি বারান্দায় বসে থাকেন এক পাগল ভদ্রলোক। খুব একটা  কথা বলেন না। সুনয়কে দেখলে কাছে আসেন। সুনয় ওঁর জন্য চায়ের অর্ডার দেয়। মুখ দেখেই বোঝা যায়, চা খেয়ে ভদ্রলোক খুব তৃপ্তি পান। চা বিস্কিট খাইয়ে পাগল ভদ্রলোকের সঙ্গে সুনয় ভাব জমাতে চেয়েছিল। কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি। বরং মোক্ষম প্রশ্নে ছিটকে এসেছিল সুনয়, ভাব জমানো থেকে অনেকদূরে। প্রশ্নটা সোজা না কঠিন এখনও সমাধান করতে পারেনি সোহম। A প্লাস B এর হোল স্কোয়ারের সূত্র মানুষের বেঁচে থাকায় কী কাজে লাগে!
৪) জেলাস্কুলের পিছনে পান গুমটির আড়ালে যে ছেলেটি দাঁড়িয়ে কথা বলছে মোবাইলে , তার বয়স বড় জোর একুশ কি বাইশ। হয়ত কলেজে পড়ে অথবা পড়ে না। তাতে কী যায় আসে! তবে সে তিরিশ হাজার টাকার টিউশনি পড়ায়। তাতেও কিছু যায় আসে না, একদম সত্যি! তার প্রতিদিন এক প্যাকেট সিগারেট লাগে। এইটুক খবরও জানে সুনয়। মোবাইলের ওপারে যে কথা বলছে সে নিশ্চয় তার বন্ধু। বন্ধুনি বা প্রেমিকাও হতে পারেকিম্বা বন্ধু, বন্ধুনি, রিলেটিভ কেউ না। প্রতিদিন একটাই কথা শোনে সুনয়। তুমি যতই চেষ্টা কর না কেন সম্পর্ক অতো সহজে ভাঙে না। অনু, পরমানু, লেশ, কণামাত্রও টিকে থাকে। হয়তো যোগাযোগ থাকে না। হয়তো কথা হয় না। দেখা হয় না। তবু কিছু একটা থাকে। অনেক আলোকবর্ষ আগে মরে যাওয়া নক্ষত্রের উষ্ণতা টের পাওয়ার মতো সম্পর্কের আগুন নেভে না কখনও তুমি যে ভাবেই তাকে নেভাতে চাও না কেন!
ক্রমশ…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।