বৈশাখের দুপুর। স্টেশনে বসে আছি নিজের তালে। এক ভদ্রলোক ট্রেন থেকে নেমে আমার কাছে এলেন। আমি খেয়ালই করি নি। সামনে এসে কথা বলতে তার দিকে তাকালাম। “কেমন আছেন” ——– কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। ভুলে যাওয়া আমার রক্তের মধ্যে। কিন্তু কেন জানি না মনে হলো আমি তাকে কোথাও কোনোদিন দেখি নি। কোনো উত্তর দিলাম না। ভদ্রলোক তাতে একটুও না দমে বললেন, “সেদিনের চা-টা এখনও মুখে লেগে আছে”। মানুষটাকেই মনে করতে পারছি না, তার ওপর আবার চা। আমি শুধু মুখে বললাম, আপনি বসুন। উনি না বসে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মুখে রাগ বিরক্তির নামমাত্র কোনো চিহ্ন নেই। “ভালো থাকবেন” —— একটা সময় উনি চলে গেলেন। খুব অদ্ভুত লেগেছিল ঘটনাটা। এই ঘটনার সাপেক্ষে একটা জিনিস আমি সেদিনই ভেবেছিলাম, আমি ভদ্রলোককে কোনো উত্তর দিলাম না কেন ? উত্তর দেওয়ার জন্য একটা মানুষকে চেনার কি খুব প্রয়োজন ? আমরা তো দুজনেই মানুষ ছিলাম। এই জায়গা থেকে তো আমরা দুজন দুজনকে চিনি। ভদ্রলোককে দেখে আমার সেদিন মনে হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ যেন এইসমস্ত মানুষজনদের দেখেই একদিন লিখে ফেলেছিলেন —– “মোরে ডাকি লয়ে যাও মুক্তদ্বারে তোমার বিশ্বের সভাতে”। উনি সেদিন কেন রেগে যাননি, বিরক্ত হননি ? আসলে উনি বিশ্বাস করেন, মানুষ হলেই মানুষকে কাছে টানা যায়। এর জন্য চেনাজানার কোনো প্রয়োজন নেই। এই ভাবনা থেকে যোজন যোজন দূরে থাকা মানুষদের কাছে টানতে উনি রাস্তায় নেমেছেন। মানুষটার সঙ্গে আমার আর কোনোদিন দেখা হয় নি।
২১
কবে কোন দিন মনে নেই। রাত এগারোটা। শেষ নৌকা ঘাটে এসে লাগল। নৌকা থেকে নামলাম। পিছন ফিরে দেখলাম, আর কেউ নেই। কেন জানি না সেদিন মনে হয়েছিল, ঘাট আমায় কিছু বলতে চায়। পাগলের মতো দাঁড়িয়েও ছিলাম অনেকক্ষণ। হয়ত সে বলেছিল কিন্তু আমি কিছু বুঝতে পারি নি।