• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৭৫)

পর্ব – ৭৫

পিসি বলল, কি রে, ফেরেণ্ডোর সাথে কি গল্প হল, আমায় বলবি নি?
শ‍্যামলী বলল, না পিসি, সে সব বড়দের গল্প। ছোটদের শুনতে নেই।
সবিতা তাকে কাকুতি মিনতি করে, বল্ না, কি গল্প করলি?
শ‍্যামলী বলল, তুমি আগে বলো, কাউকে বলবে না?
সবিতা ফিসফিস করে বলল, না রে, কাউকে বলব না। বল্ বল্ সে কি বলল?
সবিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে শ‍্যামলী বলল, চল্ পলায়ে যাই!
ওম্মা, কি সব্বোনাশী মেয়েরে তুই? আজ বলে দুর্গা ষষ্ঠী। এমন একটা দিনে এমন একটা অলুক্ষুণে কথা বলতে পারল সে ছোঁড়াটা?
শ‍্যামলী বলল, ও পিসি, ছোঁড়া কিসের? নিজের বড় ফার্ম আছে, গাড়ি আছে।
সবিতা বলল, তা হোক্, বিয়ে হবে নিয়ম মেনে। পালিয়ে গিয়ে আবার বিয়ে কিসের? আমার মেয়েটাকে নিয়ে পালালে আমি মাথাটা তার ফাটিয়ে দেব না!
শ‍্যামলী বলল, কিন্তু, তোমার মেয়েই যদি তাকে নিয়ে পালায়?
ওমা গো, কি ডাকাত মেয়ে গো, তোর মুখে বুঝি কোনো কথা আটকায় না?
না পিসি। সে বলছিল, আমাকে নিজের গাড়ি করে কলকাতা গিয়ে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাবে। আমি রাজি হ‌ই নি।
সবিতা বলল, বাঃ বেশ করেছিস। বিয়ের আগে ঘি আর আগুন কাছাকাছি আসতে নেই।
আসলে পরে কি হয় পিসি? ঠোঁট টিপে হাসে শ‍্যামলী।
সবিতা বলল, মেয়েমানুষের আসল জিনিস হল লজ্জা। লজ্জা খোয়ালে মেয়েদের আর কিছুই থাকে না।
দুষ্টুমি করে শ‍্যামলী বলল, লজ্জাটা কি পিসি? কোথায় থাকে?
বাঁদর মেয়ে, জানো না, না?
শ‍্যামলী বলল, সত্যি সত্যি বুঝতে পারছি না পিসি, লজ্জা বলতে তুমি ঠিক কি বলতে চাইছ?
আদর করে তার গাল টিপে দিয়ে পিসি বলল, সবার আগে ভাল করে দেখাশুনা হবে। তারপর পাকা কথা। তারপর আশির্বাদ। তারপর বিয়ে। বিয়ের পর তোমরা ভাল থাকবে। প্রেয়কে ছেড়ে শ্রেয়কে নেবে।
আমি ঠিক বুঝলাম না পিসি। কি প্রেয় আর কি শ্রেয়।
সবিতা বলল, শ্রেয় মানে যা ভাল।
অ। আর প্রেয় মানে?
সবিতা বলল, প্রেয় মানে যা ভাল লাগে।
শ‍্যামলী বলল, দ‍্যুৎ পিসি, শ্রেয় মানেও বলছ ভাল, আবার প্রেয় মানেও বলছ  ভাল, তাই‌ই যদি হয়, তাহলে একটার সাথে অন‍্যটার তফাতটা কিসের?
না রে, শ্রেয় মানে যা সত‍্যিকারের ভাল।
দুষ্টুমি করে শ‍্যামলী বলল, অ। তার মানে প্রেয় বলতে মিথ‍্যেকারের ভাল?
সবিতা বলল, এই তো ঠিক বুঝেছিস। জ্বরের রুগীর টক খেতে ইচ্ছে করে। ওটা অপথ‍্যি। ওটা খেতে নেই।
আর জ্বরের রুগী যদি হালকা মাছের ঝোল দিয়ে দুটো ভাত খেতে চায়? শ‍্যামলী জানতে চাইল।
সবিতা গালে হাত দিয়ে অবাক চোখে বলল, ওম্মা, জ্বোরো রুগী ভাত খাবে কি রে? সাগু বা বার্লি খাইয়ে ফেলে রাখতে হয় যে!
শ‍্যামলী বলে, তার মানে আমার যা ভাল লাগে, সেটা আসলে ভাল নয়, তুমি যেটা ভাল বললে, সেটাই আসলে ভাল। তাই তো?
সবিতা বলে, এই তো তুই কি চমৎকার বুঝে গিয়েছিস!
শ‍্যামলী মজা করে বলে, ভাল। ঠিক কোনটা, সেটা তো পুরুত ঠাকুর বলে দেবে, তাই তো?
সবিতা বলে,  হ‍্যাঁ। গুরু পুরুত, এরা যা বলে তা মানতে হয়। প্রেয়কে বাদ দিয়ে শ্রেয়কে নিতে হয়।
সবিতা বলে, এই তো সোনা, কি চমৎকার বুঝে গেলি। নে, আমার ছিষ্টি কাজ পড়ে আছে। আমায় এবার ছাড়্। এখনো না নামলে তোর মা এবার চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবে।
ও পিসি, ও পিসি, শোনো না, গুরুদেব যদি বলে, বন্ধ করা ঘরের মধ‍্যে তুমি সব কাপড় চোপড় ছেড়ে রেখে আমার কাছে বসো, সেটা শ্রেয় না প্রেয়।
সবিতা রেগে যায়। তোর কি মুখের কোনো আগল নেই? যা মনে আসে, তাই বলে যাবি?
পিসি, আমি যদি প্রমাণ করে দিতে পারি, আমাদের দেশে অনেক গুরু পুরুত অমন বলে, ধর্মে না কি এ ব‍্যবস্থা আছে, একে না কি “গুরুপ্রসাদী” বলে!
সবিতা গুম হয়ে যায়। বলে, তোর সাথে কথা বলে লাভ নেই। তুই খুব ওঁচা মেয়ে।
না কি পিসি, জুতস‌ই জবাবটা খুঁজে পাচ্ছ না? আমি কিন্তু ব‌ই খুলে দেখিয়ে দিতে পারি গুরুঠাকুররা এই কাণ্ড করতেন।
সবিতা শ‍্যামলীর গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, আজ দুর্গা ষষ্ঠী, তুই এসব কি অলুক্ষুণে কথা বলছিস্। চুপ কর্। পাপ হবে যে?
বাঃ পিসি বাঃ। গুরুপ্রসাদী করলে পাপ হবে না। তা নিয়ে বললে পাপ হয়ে যাবে!
সবিতা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।
শ‍্যামলী বলে চলে, শোনো পিসি, মহাভারতের কর্ণ কি করে জন্মেছিলেন, কুন্তী কোনো দিন কা‌উকে মুখ ফুটে বলতে পারেন নি। স্বামীর কাছেও চেপে গিয়েছিলেন।  ব‍্যাসদেবের জন্ম যেভাবে হয়েছিল, সেটা তোমার শ্রেয় আর প্রেয়, ওই হিসেব মেনে হয়নি।
সবিতা রাগ করে বলল, চুপ কর্ মুখপুড়ি! ঠাকুর দেবতা নিয়ে ওসব বলতে নেই।
শ‍্যামলী বলল, না, বলবে না কেন শুনি?  ছোটো ভাইটা তীর ছুঁড়ে একটা মেয়েকে পেল, বড়ভাই হয়ে যুধিষ্ঠির তোমার ওই দ্রৌপদীকে ছুঁতে শ্রেয় বা প্রেয় প্রশ্ন উঠল না কেন?
পিসি, আজ যে আমাকে ফোন করেছিল, সে কিন্তু নকুড় নন্দীর ছেলে রমানাথ নয়।
সবিতা তীক্ষ্ণভাবে তাকিয়ে জানতে চাইল, কে সে? কার সাথে অত কথা বলছিলি?
শ‍্যামলী বলে, মিস্টার অরিন্দম। আরেক জন লোক।
সবিতা জানতে চায়, ওই লোকটার সাথে গাড়ি করে কলকাতায় যাবি বলছিলি?
শ‍্যামলী বলে, হ‍্যাঁ পিসি‌। তাকে না করেছি। কিন্তু শ্রেয় না প্রেয়, কোন্ টা নেব বলো তো?
সবিতা বলে, তোর সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। আমার তো ভয়ে হাত পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যাচ্ছে রে! তুই দু দুটো ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখছিস?
পিসি, কুন্তী কিন্তু তিন তিনটে দেবতার সাথে শুয়েছিলেন। সেটা মনে রেখো।
ওরে, আমি পালাই রে! তোর কাছে থাকলে আমার নির্ঘাৎ মাথা খারাপ করে দিবি!
সবিতা পালায়। শ‍্যামলী হাসতে হাসতে তার পিছন পিছন গিয়ে বলে, আজ দুর্গাষষ্ঠী। পিসি, তোমাকে ঠাকুরের কত গল্প শোনালাম বল?
বাসন্তীবালা কোথা থেকে এসে  বললেন, ঠাকুর দেবতার গল্প আমাকেও একটু বল্ না শ‍্যামলিমা?
সেই শুনে শ‍্যামলী হাসতে হাসতে দৌড়ে পালালো।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।