দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৭২)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ৭২
১৭১
ভোররাতে মা ঘুমিয়ে পড়েছে। গানের সুর মাকে ঘুমাতে সাহায্য করেছে। ওদিকে পাখিরা ডাকছে। শ্যামলীর ঘরের বড়ো জানলা দিয়ে দেখলে এই মফস্বল শহরটাকে মনে হয় গ্রাম। এদিকে বট পাকুড়ের গাছ। এলোমেলো করে এ ওর গায়ে জড়িয়ে আছে। একটা ডোবা। তাতে কচুরিপানা আর জলাঘাস ভরতি। সেখানে একটি ডাহুক দম্পতি ঘোরে। তালগাছের পাতায় ঝোলানো বাবুইয়ের বাসা। কাঠঠোকরা আছে। এই মুহূর্তে তাদেরকে দেখা যাচ্ছে না। কাদের বাড়িতে পায়রা পোষে। তারা সকালে পায়রা ছাড়ে। ওরা চক্কর কাটতে লেগেছে। পায়রার দলবেঁধে ওড়া দেখে ফিবোনাচ্চি শ্রেণীর কথাটা মনে এল শ্যামলীর। শূন্য, এক, এক, দুই, তিন, পাঁচ, আট, তেরো, একুশ.. ফিবোনাচ্চি সিরিজ শ্যামলীর মনশ্চক্ষে নড়েচড়ে উঠতে থাকে।
যে পাখিরা দলবেঁধে ওড়ে, ওরা ওই ফিবোনাচ্চি সিরিজের ছক গড়ে ওড়ে। প্রথমে একটা, দুটো, তিনটে, পাঁচটা, শ্যামলী ভাবল, পায়রা কি তাহলে ফিবোনাচ্চি সিরিজ জানে?
তার পরেই তার মনে হল, পাখিরা গণিত জানে ও চর্চা করে, এটা হতেই পারে না। আচ্ছা, সূর্যমুখী ফুলেরা গণিত জানে? মৌমাছিরা? গাঁদা, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা নিজেদের পাপড়ি সাজায় কেমন করে? মৌমাছি ফুলের উপর বসার আগে নাচতে থাকে আর নাচতে নাচতে ইংরেজি আট আঁকে। এটা কি সত্যি? পৃথিবীর সকল মৌমাছি কি এভাবেই নেচেছে ? শামুক গেঁড়ি গুগলির প্যাঁচের কথা মনে পড়ে শ্যামলীর। ওতেও ফিবোনাচ্চি শ্রেণীর ছাপ।
বাবা একবার দেখে গেলেন, মা শ্যামলীর খাটে ঘুমিয়ে আছেন। বাবা গেঞ্জির উপর চাদর জড়িয়েছেন। ভোরের বেলা হালকা শীতের আমেজ। আস্তে আস্তে শীত জাঁকিয়ে বসবে। আজ ষষ্ঠী। ঢাক বেজে উঠবে। ঢাকিরা দুর্গাতলায় এসে গেছে। ঢাক পাশে নিয়ে ওরা জড়ামড়ি করে রাতে ঘুমিয়েছে। মশারির যোগাড় নেই। উহাদের মশা লাগে না। কোথায়, কোন্ উপন্যাসের লাইন? কিছুতেই মনে পড়ে না।
আর একটা কবিতার লাইন মনে পড়ে তার। “ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালে বিলে।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা। কিন্তু কবিতার নামটা কি? মনে করার চেষ্টা করে শ্যামলী।
সবিতা পিসি ঘরে ঢোকে। কি রে, তোর মা রাতে তোর কাছে ঘুমোলো?
পিসি, রাতে মা ঘুমোলো কোথায়? এই তো পৌনে চারটের সময় টের পেলাম আর বকবক করছে না।
মাকে তুলবি না? জপ করবে কখন? আজ বোধন!
হ্যাঁ বোধন! ঠিক মতো ঘুমাতে পারে না মা। মনে মনে ভাবল শ্যামলী। পিসিকে বলল, তুমি এখন যাও। মা ঘুমোচ্ছে ঘুমোক।
সবিতা বলল, তুই রাতে ঘুমোস নি? মা বেটিতে বকবক করছিলি?
পিসি, তোমার বকবক থামাও তো। আমি পড়া করছি।
সবিতা বলে, হুঁঃ, কিছু বলতে গেলেই অমনি পড়া করছি! হ্যাঁ রে, কাল তোমার কলেজ থেকে একটা মেয়েমানুষ ফোন করেছিল।
শ্যামলী বলে, ও কি পিসি, ও আবার কি ভাষা?
সবিতা হাত মুখ নেড়ে বলে, কেন, মেয়েমানুষকে মেয়েমানুষ বলব না তো কি গুরুঠাকুর বলব?
শ্যামলী জানতে চায়, ও পিসি, বলো না, উনি পরিচয় কিছু দিয়েছেন? কি বলছিলেন উনি?
উফফ! একটা একটা করে প্রশ্ন কর্ মা। বুড়ো হয়েছি, সব মাথায় নিতে পারি না।
চলো, ও ঘরে চলো, মায়ের ঘুম ভেঙে যাবে।
হ্যাঁ। মনে পড়েছে। তোকে ফোন করতে বলেছে।
পিসি, কোনো নম্বর দিয়েছেন উনি?
সবিতা বলে, কি চোপা রে মেয়েটার! বলে কি না, তোমাদের শ্যামলীকে ফোন করলে পাওয়া যায় না কেন? কি রাজকার্য করেন তিনি? তখন আমিও মুখের উপর বলে দিইচি। তার বাপের শরীর খারাপ। তার ঘাড়েই ছিষ্টি সংসারের বোঝা। তাকে খেটে খেতে হয়। আবার আমাকে বলে কি, আমার নম্বরটা লিখে রাখো, ফিরলে যেন ফোন করে।
শ্যামলী জিজ্ঞাসা করে, নম্বরটা লিখে রেখেছ পিসি?
সবিতা বলে, উঁহু, আমি সে বান্দা নই। সোজা বলে দিইচি, তোমার দরকার থাকলে তুমি আবার ফোন করে দেখবে। আমি অত লিখতে পারব না। বলে ঠক করে রেখে দিইচি।
শ্যামলী বলে, ছিঃ পিসি! উনি নিশ্চয়ই করবী ম্যাডাম। নইলে এত খোঁজ আমার কে করবে। আমায় বড্ডো ভালবাসে গো। তুমি নম্বরটা লিখে রাখলে না কেন?
সবিতা তেতে উঠে বলল, হ্যাঁ, লিখে রাখবে! আমি তখন তেঁতুল দিয়ে পুজোর বাসনগুলো মাজছিলুম। তেঁতুল হাতেই ছুটে এসে ফোন ধরেছি। হ্যাঁ রে শ্যামলিমা, তোদের সংসার ঠেলতে গিয়ে কি আমি দশটা হাত বের করব?
পিসিকে রাম চিমটি কাটে শ্যামলী। তুমি ম্যামকে ওরকম কটকট করে কথা বলেছ কেন? জানো, উনি আমাদের কলেজে পড়ান?
সবিতা অবাক হয়ে বলে, সে কিরে শ্যামলিমা, তোদের কলেজে মেয়েমানুষও পড়ায়?
শ্যামলী বলল, পিসি, তুমি মেয়েমানুষ কথাটা একদম বলবে না। মহিলা বলবে। আর কলেজে মেয়েদের না পড়াবার কি আছে? এখন এদেশের আইনে ছেলে মেয়ে সবাই সমান।
সমান! হুঁ, ওই নিয়ে থাক্। সমান! বলি, ‘ভাগ্যবানের বউ মরে, অভাগার ঘোড়া,’ কথাটা জানিস তো? একটা লোকের বউ মরুক, অমনি তিনটে মাস যাবে কি যাবে না, আবার টোপর পরে ছাদনাতলায়। আর মেয়েদের? সমান কাকে বলে জানিস মুখপুড়ি?