• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৫৬)

পর্ব – ৫

সকালে কলেজ যাবার আগে কারখানায় ঢুকল শ‍্যামলী। সেখানে ঝাঁট পড়ছে। বাথরুম ফিনাইল দিয়ে ধোয়া হয়েছে। শ‍্যামলী দেখল শুকনো মুখে হেডমিস্ত্রি বসে আছে। শ‍্যামলীকে দেখে সে কাছে এসে দাঁড়াল। ছোড়দি, আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। ক‍্যাশ ছেড়ে চলে যাওয়া আমার ঠিক হয় নি।

শ‍্যামলী তার দিকে তাকিয়ে হাসল। তা কেন, মালিকপক্ষ আপনার উপর অত‍্যাচার করছে, আর আপনি মালিকের কাছেই ক্ষমা চাইছেন? আজ সকালে আপনার নেতা আমাদের বাড়ির ফোনে যোগাযোগ করেছে। তাকে আপনি বলেছেন বলেই তো সে করেছে।
না ছোড়দি, আমি তাকে বারণ করেছিলাম।
আপনি তাকে খবর দিয়েছেন যে, আমি আপনার থেকে মুচলেকা আদায় করেছি?
হেডমিস্ত্রি মাথা নিচু করে থাকে।
কি মিস্ত্রি মশাই, আমি মুচলেকা আদায় করে অপরাধ করেছি, তাই না?
চারপাশে আরো কয়েকটি শ্রমিক জুটে গিয়েছে।
শ‍্যামলী বলল, সবাই আমার অফিস চেম্বারে এসো। কথা আছে।
আচ্ছা, তোমাদের মনে আছে, আমার আগের আমলে কারবারের খুব লস হয়ে গিয়েছিল।
সবাই মাথা নাড়ে।
কেউ একজন বলো তো, কেন কারখানার এত লস হয়েছিল?
একজন বলল, তোমরা কারবারের দেখাশুনা করতে না।
শ‍্যামলী বলল, না, কারবার একলা মালিকের রাজত্ব, আর শ্রমিক সেখানে একেবারে ফালতু একটা বাইরের লোক, এই ধারণার আমি বিরোধী।
ছোড়দি, তোমার অতো শক্ত শক্ত কথা আমরা বুঝতে পারি না।
সে কথা শুনে শ‍্যামলী মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে তাকায়।
ছোড়দি, তোমাকেও আমরা বুঝতে পারি না।
তাই না? শ‍্যামলীর চোখে ব‍্যথা টলটল করে। তারপর সে বলে, আচ্ছা, পুজোর আগে বোনাস পেয়ে সবাই খুশি হয়েছো তো?
হেডমিস্ত্রি বলে, আমার হাফ পাওনা বাকি আছে।
তার কথা শুনে শ‍্যামলী বলে, তার কারণটা তোমরা বুঝতে পেরেছ?
কিছু লোক হ‍্যাঁ বলে। কিছু লোক চুপ করে থাকে।
শ‍্যামলী বললো, কে বলতে পারো, কেন ওর বোনাসের হাফটাকা আটকে রেখেছি?
একজন বলল, ও গাড়ি সারানোর পয়সা চেয়ে নিতে ভুলে গিয়েছিল।
আর কেউ কিছু বলবে?
কোনো সাড়া আসে না।
শ‍্যামলী বলে, অনেক কষ্ট করে কারখানাটাকে ঘুরে দাঁড় করিয়েছি। ও যে কাউকে কিছু না বলে ক‍্যাশ বাক্স ছেড়ে, পার্টসের বাক্স আলগা ফেলে রেখে বীরুবাবুর কাছে গিয়েছিল, সেটা তোমাদের চোখে পড়ল না?
হেডমিস্ত্রি আবার বলল, আমার ভুল হয়েছিল। এবারের মতো মাপ করে দিন।
কিছু মনে কোরো না, তোমরা একেবারে নিজেরটুকু ছাড়া কিছুই দেখতে পাও না। তোমরা ভালবাসতে জানো না। তোমরা বোনাস পেয়ে সবটুকু টাকা বাড়ির লোকের হাতে দাও না। মজুরির টাকা পেয়ে তোমাদের নেশা করতে যেতে ভাল লাগে। বাচ্চাদের স্কুলে পড়ার কী ব‍্যবস্থা হবে তোমরা খবর রাখো না। তোমরা কাউকে ভালবাসো না।
পিছন থেকে বাচ্চা ছেলেটি চেঁচিয়ে বলল, ছোড়দি, সবাই এক রকম নয়।
শ‍্যামলী বলল, নয়‌ই তো। ঠিক কথা। হেডমিস্ত্রি ক‍্যাশ আলগা করে চলে গিয়েছিল বলে তো ক‍্যাশ লুঠ হয়ে যায় নি। পার্টসের বাক্স খোলা ছিল বলে পার্টস বেপাত্তা হয় নি। সবাই নিজের নিজের কাজ করছিলে।
বাচ্চা ছেলেটি বললো, তাহলে, তুমি যে সবাইকে গাল দিচ্ছিলে?
বেশ, তোমরা কারখানাকে আগলে রাখলে আমি আর বকাবকি করব না। কিন্তু, মিস্ত্রির কি শাস্তি হবে?
কেউ কিছু বলতে পারল না।
তোমরা যখন কেউ কিছুই বলতে পারছ না, তখন আমিই বলি।
বেশিরভাগ মজুর বলল, হ‍্যাঁ তোমার কারখানা। তুমিই তো বলবে।
শ‍্যামলী বলল, আমি সেটা কাগজে কলমে লিখে এনেছি। তারপর হেডমিস্ত্রির দিকে চেয়ে বলল, এই নোটিশ আপনাকে দিলাম। আপনি স‌ই করে নিন।
হেডমিস্ত্রি বলল, আবার স‌ই?
ন‌ইলে আমাকে পুলিশের কাছে যেতে হয়। আমার ক‍্যাশ ঘাটতি পড়েছে।
ভয়ে ভয়ে স‌ই করে মিস্ত্রি।
সবাই বলে ওকে দিয়ে কি লিখিয়ে নিলে?
শ‍্যামলী গড়গড় করে পড়ে যায়, “যেহেতু আপনি পাল অটোমোবাইল এর ক‍্যাশ দেখাশোনা করতেন, এবং পার্টসের স্টক দেখাশোনা করতেন, এবং গতকাল বেলা দেড়টার সময় থেকে আপনার কোনো হদিশ ছিল না, ক‍্যাশ বাক্স ও পার্টসের স্টক খোলা রেখে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন, কোনো সন্তোষজনক উত্তর দেন না, তাই ক‍্যাশ ও স্টকের দায়িত্ব থেকে আপনাকে সরিয়ে দেওয়া হল।
এখন থেকে সাত দিনের মধ্যে কেন, কি কারণে আপনি ক‍্যাশ বাক্স খোলা রেখে কারখানা ফেলে চলে গিয়েছিলেন, তা জানাবেন। অন‍্যথায় এখানে কাজের দায়িত্ব থেকে আপনাকে পুরোপুরি অব‍্যাহতি দেওয়া হবে। এই সাতদিন কারখানায় কোনো পরিশ্রম আপনাকে করতে হবে না। এই সাতদিনের জন‍্য আপনি মজুরির পঁচাত্তর শতাংশ টাকা পাবেন।”
মজুরদের একাংশ বলে, এই সাতদিন কোনো কাজ না করেই বারো আনা রেটে মজুরি পাবে?
শ‍্যামলী শক্ত হয়ে বলল, হ‍্যাঁ পাবে।
হাউমাউ করে মিস্ত্রি কেঁদে উঠে বলল, আমায় আপনি জুতা খুলে গালে মারুন। এই অবিচার করবেন না।
তার দিকে না তাকিয়ে মজুরদের উদ্দেশে শ‍্যামলী বলল, ক‍্যাশ বাক্স আর স্টকের দায়িত্ব কে নেবে?
কেউ কথা বলে না।
শ‍্যামলী বলল, তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে এই দায়িত্ব নিতে পারো?
বাচ্চা ছেলেটা বলল, আমি করব।
না, তুই বড্ড ছোট। তোমরা কেউ পারবে না? আমি শিখিয়ে নেব।
একজন বয়স্ক মজুর নিমরাজি হতে, তার হাতে ক‍্যাশের চাবি তুলে দিল শ‍্যামলী।
বাচ্চা ছেলেটাকে বলল, তোরা সবাই মিলে কারখানাটাকে আগলে রাখিস।
হেডমিস্ত্রি বলল, আমি এখন কি করব?
শ‍্যামলী হেসে বলল, আপনাকে উত্তর লেখার কাজ দিয়েছি তো। বারো আনা রেটে মজুরিও দেব।
তারপর সে দ্রুত পায়ে কলেজের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।