দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৩)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ১৩
১১০
কলেজ থেকে ফিরে গ্যারাজে ঢুকল শ্যামলী । ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো কাজ কেমন হচ্ছে। তার পর মিস্ত্রীদের মধ্যে যে এখন দক্ষ , তাকে ডেকে বললো – আসুন, মোটর পার্টসের স্টক মেলাই। লোকটিকে ইতস্ততঃ করতে দেখে সন্দেহ জাগলো শ্যামলীর । নিজের চেম্বারে বেশ খানিক ক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও সেই মিস্ত্রী এল না দেখে শ্যামলী নিজেই বেরিয়ে এল।
“কি ব্যাপার কানে কি শুনতে পান না?”
সবাই একমনে কাজ করে চলে । টুঁ শব্দ নেই।
“কি ব্যাপার । আমাকে পার্টসের হিসেবটা তো দেবেন? কি আনতে হবে না হবে, বুঝে তো রাখি!”
অন্য এক মিস্ত্রী বলে ওঠে – “এখন দিন দুয়েক চলে যাবে দিদি । আপনি বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিন।”
মাথাটা বেশ গরম হয়ে যায় শ্যামলীর। “অ্যাই শুনুন, বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নেব বলে গ্যারাজের দায়িত্ব নিই নি। আমায় খেটে খেতে হবে । উঠে আসুন আপনি।” কড়া গলায় বলতে কাজ হয়।তেলচিটে ময়লা হাতটা ধুয়ে মিস্ত্রী যখন এসে বসলো , তখন শ্যামলী টের পেল যে সে কি একটা চাপা দেবার চেষ্টা করছে। মিস্ত্রীর অস্বস্তি বোধকে গুরুত্ব না দিয়ে শ্যামলী ক্যাশ বইয়ের সাথে স্টক মেলাতে লাগলো। অচিরেই ধরা পড়লো যে একটি গাড়ি সারানো হলেও সে বাবদে কিছুমাত্র টাকা মেটানো হয় নি।
“কে গাড়ি সারিয়ে টাকা দেয় নি?”
মিস্ত্রী চুপ ।
শ্যামলী গর্জে ওঠে – “পয়সা না দিয়ে কে গাড়ি সারিয়ে নিয়ে গেল?”
একে একে সব মিস্ত্রী তার চেম্বারে ঢুকে পড়ে।
একজন বলে – “ছোড়দি , তুমি চেঁচালে হবে? আমাদের তো প্রাণ নিয়ে বাঁচতে হবে !”
আমি জানতে চাই – “পয়সা না নিয়ে কার গাড়ি তোমরা সারিয়েছ?”
চালাক মুখের একটা মিস্ত্রী বলে “শুনে রাখুন, কারবার চালাতে গেলে অনেক রকম অ্যাডজাস্ট করতে হয় । বই মুখস্ত করে কারবার চলে না। ”
“কি বলতে চাইছেন আপনি?”
“বলছি যে, কারবার করতে গেলে পুলিশ, মস্তান আর পার্টি কে খুশি রাখতে হয়। নইলে পস্তাতে হয়।”
“আমার মোটর পার্টস কি ওরা কিনে দেয়? আমার ইলেক্ট্রিকের বিল কি ওরা দিয়ে দেয়? আমি তোমাদের মাইনে দিই বুঝলে, মাইনে । আমার জিনিস আমি নগদে কিনি, চুরি করি না , লোক ঠকাই না। পয়সা আমি বুঝে নেব। শিগগির বলুন, কার গাড়ি বিনে পয়সায় সারিয়েছেন?”
মেলে না উত্তর।
“কি ব্যাপার , আমার কথার জবাব নেই কেন?”
“শুনুন, কারবার চালাতে গেলে অনেকদিক দেখে শুনে চালাতে হয়। অমন একগুঁয়ে হলে চলে না।”
“ভারি মজা তো ? কারবার আমার, পার্টস কিনে আনবো আমি , কারেন্টের বিল দেবো আমি , আর ফিলজফি পড়াবেন আপনি ? যান, আপনাকে আর আমার গ্যারাজে কাজ করতে হবে না। আমি চাইনা এমন বেআক্কেলে লোকজন ।”
শ্রমিকেরা ঘর থেকে বেরিয়ে যায় । অকারণে পার্টসের রেজিস্টারটা আবার মেলাতে থাকে শ্যামলী । মেলাতে মেলাতে টের পায় বাইরে একটা গুঞ্জন গোলমালের রূপ নিচ্ছে।
অল্প ক্ষণের মধ্যেই দুজন মাঝ বয়সী লোক তার চেম্বারে ঢোকে । টেবিলে চাপড় মেরে বলে – “আপনি আমাদের মেম্বারকে অপমান করেছেন । চোর বলতে চেয়েছেন। আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে।”
শ্যামলী তীব্র ব্যঙ্গের সুরে বলে – “আমি যখন ওদের সাথে কথা বলছিলাম- তখন কি আপনি পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন?”
শ্রমিক নেতাটি কি উত্তর করবে ভেবে পায় না। গোঁ ধরে গলা চড়িয়ে বলে – “আপনাকে কথাটা উইথড্র করতে হবে।”
“আরে মশায়, সেই কথাটা তো জানতে চাইছি, আমি কি বলেছি, সেটা কি আপনি জানেন?”
পিছন থেকে কয়েকজন শ্রমিক গলা মেলায় -এ”আমাদের মেম্বারকে অপমান করেছেন । চোর বলতে চেয়েছেন। আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে।”
শ্যামলী শক্ত হয়, বলে, “এই যে মশায় , আমার গ্যারাজ, আমায় সব দায় ঝক্কি নিতে হয়, আর আমি হিসেব চাইলে আপনি যদি হিসেব না দিতে পারেন, কেন কি ঘটেছে, বলতে না চান, তাহলে কি আপনাকে পুজো করবো ?”
শ্রমিক নেতা গলার শির ফুলিয়ে চিৎকার করে বলে – “আপনি ওকে চোর বলবেন কেন?”
শ্যামলী মজা পায়, হেসে বলে – “আপনি কি করে শুনলেন, বুঝিয়ে বলুন।”
শ্রমিক নেতা বলে – “এই আপনার গোঁয়ার্তুমির জন্যে আমাদের একটা মেম্বার মার খেয়েছে , সে ভুগছে , জ্বর ছাড়ছে না !”
“আহা হা, তাই না কি, তো আপনার ইউনিয়ন থেকে ক’ টাকা দিয়ে তাকে সাহায্য করেছেন গো?”
শ্লেষ ধরতে পারে নেতাটি । “হ্যাঁ , টাকা দিয়েছেন বটে । কিন্তু তাতেই মার খাওয়ানোর অধিকার আপনার জন্মে যায় না?”
শ্যামলী হেসে বলে – “টাকা দেওয়া আর মার খাওয়ানো, কোনটা আগে জন্মেছে?”
শ্রমিক নেতার যুক্তি গুলিয়ে যায় । বলে – “আপনার জন্যে মার খেয়েছে আমাদের মেম্বার।”
শ্যামলী চোখ তুলে সকলের দিকে তাকিয়ে বলে – “অ্যাই , তোমরা কি সবাই বলছো যে, আমি হেড মিস্ত্রীকে মার খাইয়েছি ?”
কোনো উত্তর আসে না ।
“কি কারো মুখে কথাটি নেই কেন? আমি মার খাইয়েছি ? তার পর আমি থানায় গিয়েছি ডায়েরি করতে? তার পর আমি তার বাড়ি গিয়ে সাহায্য দিয়ে এসেছি , আবার গতকালও তার বউ এসে টাকা নিয়ে গিয়েছে। অ্যাঁ , এসব কথা সত্য কি না? ”
শ্রমিক নেতাটি মাথা নিচু করে বলে – “হ্যাঁ , আমাদের কাছে খবর আছে আপনি থানায় গিয়েছিলেন। আর সাহায্য করে এসেছেন।”
তাকে বাগে পেয়ে যায় শ্যামলী – “আমি শুধু জানতে চাই আমার কারখানায় কে এসে শ্রমিককে চোখ রাঙিয়ে বিনে পয়সায় কাজ করিয়ে নিয়ে যায় ? কি নেতা বাবু, আপনার জানা আছে?”
শ্রমিক নেতা ভাবতে থাকে কি বলবে ।
অভ্যস্ত তার্কিক গলায় শ্যামলী বলে – “শুনুন , কে গাড়ি সারিয়ে পয়সা দিল না, সে কথা শ্রমিক যদি বলতে না পারে, তাহলে তার পাওনা মজুরির হিসেবে ফাঁক থেকে যাবে না? হাড় ভাঙা খাটুনি খেটেও শ্রমের দাম পাবে না মজুর। এই আপনি মজুরের ভাল চান? গাড়ি সারালে শুধু মালিকের লাভ হয় – এইটা শুধু শিখেছেন, কিন্তু গাড়ি সারিয়ে হিসেব দিলে যে শ্রমিকের মজুরি বাবদ টাকা পাওনা হয় সেটা শেখেন নি?”
শ্রমিক নেতা হেরে গিয়েছে ধরে নিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকে ।
পিছন থেকে শ্রমিকেরা চেঁচিয়ে ওঠে – “তোমার খাম খেয়ালি মানবো না। তোমার জন্যে আমরা পুলিশ, মস্তান আর পার্টির হাতে প্যাঁদানি খাবো, তা হবে না।”
শ্যামলী এখন বাগে পেয়ে গিয়েছে – “কে পেটায় তোমাদের? পুলিশ, মস্তান আর পার্টি ? এই যে নেতা বাবু শুনছেন, আপনার মেম্বাররা বলে – পুলিশ, মস্তান আর পার্টি নাকি ওদের পেটায়। তো আপনার কি কি করছেন এই অত্যাচারটা ঠেকাতে? ক’টা এফ আই আর করেছেন? ক’টা রেল রোকো করেছেন? হিসেব দিন?”
নেতাটি বিরক্ত হয়ে শ্রমিকদের দিকে ফিরে তাকায় – “অ্যাই , তোরা থামবি ? সব যদি তোরাই বলবি, তাহলে আমায় ডেকে এনেছিস কেন?”