• Uncategorized
  • 0

|| জন্মদিনে উৎপল দত্ত স্মরণ || লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

আজ উৎপল দত্তের জন্মদিন। পূর্ববঙ্গের বরিশালে ১৯২৯ সালে এই রকম ২৯ মার্চ তারিখে তিনি জন্মেছিলেন। প্রয়াত হন কলকাতায়, ১৯৯৩ সালের ঊনিশে আগস্ট তারিখে।
দত্ত পড়াশুনা করে ছিলেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। সেখান থেকে তিনি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে সাম্মানিক স্নাতক।
থিয়েটার বা মঞ্চাভিনয়ের নেশা ছিল প্রথম থেকেই। কুড়ি বৎসর বয়সেই মঞ্চাভিনয়ের নেশার টানে গড়ে তোলেন এলটিজি বা লিটল থিয়েটার গ্রুপ। ১৯৬৫তে কল্লোল, তার আগে ১৯৬৪তে মানুষের অধিকার ও লৌহ মানব, এর পরে টিনের তলোয়ার এবং মহাবিদ্রোহ নাটকের সফল মঞ্চায়ন নাট‍্যব‍্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর সমুচ্চ অবস্থানটি সুনিশ্চিত করে।  তাঁর মননে চিন্তনে বামপন্থা ও প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব‍্যবস্থার ভিতরকার শোষণমূলক আয়োজনের বিরুদ্ধে ঋজু ও  স্পষ্ট উচ্চারণ আছে। এই বিষয়ে ব‍্যারিকেড, অঙ্গার, ফেরারী ফৌজ, বণিকের রাজদণ্ড ও দাঁড়াও পথিকবর নাট‍্যকৃতির কথা স্মরণ করি।  নাট‍্য আন্দোলনে তাঁর অবদান সূত্রে ১৯৯৩ সালে সঙ্গীত নাটক আকাদেমি তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান ফেলোশিপ দিয়ে সম্মানিত করেন।
আমি তাঁর অভিনয় খুব ভালো করে খেয়াল করি সত‍্যজিৎ রায়ের আগন্তুক ফিল্মে। ১৯৯১ সালের ১০ মে ফিল্মটি কলকাতায় মুক্তি পেয়েছিল। সত‍্যজিৎ রায় নিজের লেখা গল্পে, নিজের সুরারোপে ১২০ মিনিটের ফিল্মটি তৈরি করেন। বাংলাভূমির বাঘা বাঘা দাপুটে কলাকুশলীরা এই ফিল্মে অভিনয় করেছেন। সুধীন্দ্র বোস চরিত্রে দীপঙ্কর দে, অনিলা বোস চরিত্রে মমতা শঙ্কর, এছাড়া ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, সুব্রতা চ‍্যাটার্জি, প্রমোদ গাঙ্গুলির অভিনয় ছিল অনবদ‍্য। কিন্তু মনোমোহন মিত্র নামে অন‍্য ধরনের বুদ্ধি বিভাসিত মানুষটির চরিত্র রূপায়ণে উৎপল দত্ত ছিলেন অনবদ‍্য। আমার মনে হয়েছিল, মনোমোহন মিত্রের মতো অসাধারণ চরিত্র বাংলা ফিল্মে আমি দেখি নি। আর এই চরিত্রটি উৎপল দত্তকে রূপায়ণের দায়িত্ব দিয়ে সত‍্যজিৎ রায় পরিচালক হিসেবে নিজের জহুরীর চোখ এর পরিচয় রেখেছেন।
পদ্মানদীর মাঝি লিখেছিলেন মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়। আর তার চলচ্চিত্রায়ণ হয়েছিল গৌতম ঘোষের হাতে। ফিল্মটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৩ সালের ১৬ মে তারিখে।  এ ছবি তো শুধুমাত্র কুবের আর কপিলার সমাজরীতি বহির্ভূত প্রেমকাহিনী নয়। হোসেন মিঞার উপস্থিতি উপন‍্যাসটিকে একটা অসামান্য মোচড় ও চারিত্র‍্য দিয়েছে। ১২৬ মিনিটের এই ফিল্মে কপিলা চরিত্রে রূপা গাঙ্গুলি, কুবের চরিত্রে রাইসুল ইসলাম আসাদ এর পাশাপাশি হোসেন মিঞার চরিত্র রূপায়ণে উৎপল দত্তের অভিনয় অনবদ‍্য।
পদ্মা নদীর মাঝি মুক্তি পাবার পর উৎপল দত্ত মাত্রই মাসতিনেক বেঁচে ছিলেন। কিন্তু কি আগন্তুক আর কি পদ্মানদীর মাঝি, দুটো ফিল্ম‌ই পরিচালনার প্রশ্নে সেরার শিরোপা অর্জন করেছিল। এছাড়াও ১৯৯১ এর আগন্তুক অর্জন করেছিল সেরা কাহিনী চিত্রের মর্যাদা। আর ১৯৯৩ এর পদ্মা নদীর মাঝি পেয়েছিল দ্বিতীয় সেরা কাহিনী চিত্রের মর্যাদা। রুপোলি পর্দায় উৎপল দত্তের উপস্থিতি ফিল্মকে একটা উচ্চতায় পৌঁছে যেতে সাহায্য করত।
উৎপল দত্তের অভিনয় প্রতিভার কথা বলতে গেলে মৃণাল সেন পরিচালিত ভুবন সোম ফিল্মের উল্লেখ না করাটা অন‍্যায় হবে। বনফুল, ডাঃ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় এর গল্প নিয়ে ১৯৬৯ সালে হিন্দি ভাষায় ছবি তৈরি করেন মৃণাল সেন। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১২.০৫.১৯৬৯ তারিখে। কে কে মহাজনের ক‍্যামেরা আর নেপথ‍্যে অমিতাভ বচ্চনের কণ্ঠ ফিল্মটির অসামান্য সম্পদ। এই ফিল্মে নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন উৎপল দত্ত। ছবিটি জাতীয় স্তরে সেরা ছবি, আর সেরা পরিচালনার শিরোপা পেয়েছিল। আর উৎপল দত্ত পেয়েছিলেন সেরা জাতীয় অভিনেতার মর্যাদা।
এছাড়াও অজস্র হিন্দি ও বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। আর একটি বাংলা ছবির কথা বলি। তারাশঙ্কর বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় এর কাহিনি অবলম্বনে অজয় করের পরিচালনায় সপ্তপদী। ছবিটি প্রযোজনা করেছেন উত্তমকুমার। ১৬৩ মিনিটের ফিল্মটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬১ সালের ২০ অক্টোবর। না, উৎপল দত্ত অবশ‍্য এখানে রুপোলি পর্দায় জনসমক্ষে নেই। এখানে মঞ্চ কাঁপিয়েছেন উত্তম সুচিত্রা। ফিল্মে তাঁরা কৃষ্ণেন্দু ও রীণা ব্রাউন। কিন্তু কলেজের সোশ্যাল অনুষ্ঠানে ওথেলো নাটকের নির্বাচিত অংশে ওথেলো রূপী উত্তমকুমারের হয়ে ইংরেজি বাগ্ বিন‍্যাস করেছেন উৎপল দত্ত, ইংরেজি ভাষায় যাঁর প্রজ্ঞা সম্বন্ধে পরিচালক অজয় করের কোনো সন্দেহ ছিল না। সুচিত্রার হয়ে কণ্ঠদান করেছিলেন জেনিফার কাপুর। এই সময় উৎপল দত্ত সবে ত্রিশ পেরোনো যুবক। কিন্তু মেইনস্ট্রিম বিনোদনমূলক সিনেমায় তাঁর একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। হীরক রাজার দেশে, ধনরাজ তামাং ও সফেদ হাতি তাঁর অভিনীত অজস্র উল্লেখযোগ্য ফিল্মের কয়েকটি।
শুধুমাত্র অভিনয় নয়, মননে চিন্তনে জীবনযাপনে উৎপল দত্ত ছিলেন একজন প্রথম শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। সাহিত্য আকাদেমি প্রকাশিত গিরিশচন্দ্র ঘোষ একটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ। বাংলা ভাষায় লিখেছেন গিরিশমানস। এগুলি বিগত যুগের বিখ্যাত নট নাট‍্যকার গিরিশ ঘোষকে নিয়ে উৎপল দত্তের শ্রদ্ধানিবেদন। এছাড়া দি গ্রেট রেবেলিয়ন, ১৮৫৭; অন থিয়েটার; টুওয়ার্ডস এ রেভলিউশনারি থিয়েটার; অন সিনেমা এবং রাইটস অফ ম‍্যান।
আজ ভারতীয় প্রথম মহাবিদ্রোহের সূচনার দিনে একজন প্রশ্নশীল নট ও নাট‍্যব‍্যক্তিত্ব হিসেবে উৎপল দত্তকে শ্রদ্ধা জানাই।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।