• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৪৩)

পর্ব – ১৪৩

সবিতা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন। বাবা খাটের উপর পিঠের কাছে কয়েকটা বালিশ নিয়ে আধশোয়া। মা বাবাকে তাগাদা দিলেন, কি গো, ও ক’টা ফল খেতে তুমি ক’ ঘণ্টা লাগাবে? বাবা শ‍্যামলীকে বললেন, ক‌ই রে শ‍্যামলিমা, এই যে বলছিলি শ্রীকান্ত থেকে পড়ে শোনাবি?
সবিতার দিকে চেয়ে বলল, ব‌ই কি পড়ে যাব পিসি, তার চেয়ে যা মনে আছে তা একটু করে বলে যাই। পিসি, শ্রীকান্তের কোন্ জায়গাটা তোমার খুব মনে আছে?
মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হেসে সবিতা বললেন, ওই যে তোরা নাটক করেছিলি!
বাসন্তীবালা বললেন, কোন্ নাটকটা?
সবিতা বললেন, ওই যে বৌরাণি, তোমার মেয়েটা পিছনে লেজ লাগিয়েছিল। লেজ কাটা পড়ল। তোমার মেয়ের লেজ কাটা হচ্ছে দেখে সব্বার কি হাসি!
শশাঙ্ক পাল বললেন, ও তো ছিনাথ ব‌উরুপী। ওই গল্পটা বাচ্চাদের খুব টানে।
বাসন্তীবালা বললেন, হ‍্যাঁ মনে পড়েছে গো, তোমার মেয়ে বন্ধুগুলোকে গরমের ছুটিতে টেনে টেনে এনে পার্ট মুখস্থ করাতো। সবাইকে হাত পা নেড়ে দেখিয়ে দিত কেমন করে বলতে হবে।
সবিতা বললেন, আর সেই যে মেয়েটা শ্রীকান্তের পিসি হয়েছিল, তোমার মেয়ের লেজ কাটা হল দেখে কি রকম গম্ভীরপানা মুখ করে বলেছিল, রেখে দাও, ওটা তোমার কাজে লাগবে।
বাসন্তীবালা বললেন, সে কী আশ্চর্য সব দিন গেছে। স্বামীর দিকে চেয়ে বললেন, তুমি বলেছিলে, মেয়েগুলো রিহার্সাল দিতে দিতে খিদে পেয়ে যাবে। রুটি আর আলুরদমের ব‍্যবস্থা রেখো। সবিতা তার উপর মোহনভোগ করে ফেলত।
সবিতা বলল, সেই যে মেয়েটা ওঁ ওঁ করে মাথা ঘুরে পড়ল, বদমাইশের ধাড়ি কোথাকারের, বাচ্চাদের কি জ্বালান না জ্বালাতো!
শশাঙ্ক পাল বললেন, ওরে, ওর ক‍্যারেকটারটাই অমনি। ওইভাবে লেখক লিখেছেন।
শ‍্যামলী আনমনে আলমারিতে সাঁটা বড়ো আয়নার দিকে তাকিয়ে স্কুল জীবনের কথা ভাবতে থাকে। এইসব করেছিলাম আমি? এঁরা সবাই মনে রেখেছেন?
শশাঙ্ক পাল বললেন, মজার জায়গাটা কি জানো, শ্রীকান্তের পিসি জেনে ফেলল, তার স্বামী আর ওই মেজ ছেলেটা আসলে রাম ভিতু। বাইরে হাঁকডাক করে মুখোশ পড়ে থাকে। শ্রীকান্তের পিসেমশাই কেমন বলছিল, বন্দুক লাও, সড়কি লাও! আরে, মুখে বলা সোজা। হ‍্যান করেঙ্গা, ত‍্যান করেঙ্গা। করে টা কে? ডাকাবুকো ছেলে চাই। যে ক্রাইসিস ফেস করতে পারবে। আর ওই বাঁদরটা তো দি রয়েল বেঙ্গল টাইগার বলে অজ্ঞান হয়ে গেল! ভেতরে একদানা সাহস নেই, কেবল বাচ্চাদের উপর হম্বিতম্বি। পেচ্ছাপ করতে যাবে, থুতু ফেলতে যাবে, তার আবার হিসেব রাখবে! তার জন‍্যে খাতা, টিকিট, গঁদের আঠা, সপ্তাহের শেষে অডিট! আশ্চর্য গল্প বলার কৌশল কিন্তু।
বাসন্তীবালা বললেন, ওইজন‍্য ওর মা পরে বলে দিল, নিজে বচ্ছরের পর বচ্ছর ফেল করছিস, আবার ভাইদের কান মলে দিস্ ! খবরদার ওদের শাসন করবি না। তোর কোনো অধিকার নেই! ওর কবল থেকে মুক্তি পেয়ে বাচ্চা তিনটার কী আনন্দ! মনের খুশিতে লাট্টুটা পর্যন্ত দিয়ে দিল! আগে হলে প্রাণে ধরে ও দিতে চাইত?
 শশাঙ্ক পাল বললেন, স্বাধীনতা জিনিসটা এমনি দামি!
 শ‍্যামলী বলল, তোমাদের এত খুঁটিনাটি মনে আছে?
বাসন্তীবালা বললেন, তা থাকবে না? ও ঘরে তোরা সবক’টা মিলে দুপুরে মহড়া দিতিস। আমরা ঘুমোতে যেতাম না। তোদের কাণ্ডকারখানা দেখতাম। খুব মনে পড়ে, তুই সবাইকে পার্ট বুঝিয়ে দিতিস। হ‍্যাঁ রে, ওরা সবাই কেমন আছে, সেই সীমা, তৃপ্তি, পল্লবী?
শ‍্যামলী বলল, কি জানি, আমাদের কলেজে তো ওদের কাউকে দেখতে পাইনি। মাধ‍্যমিকের পর উচ্চ মাধ্যমিক পড়তে গেলাম অন‍্য একটা স্কুলে। তখন থেকে আর দেখা সাক্ষাৎ নেই।
সবিতা বললেন, মেয়েদের অমনি হয়। কথায় বলে, রাজায় রাজায় দেখা হয়, তবু বোনে বোনে দেখা হয় না। এই যে আমি একটা মেয়ে। একটা মেয়ে এখানে রয়েছি, আমার বাপের বাড়ির কেউ একটু খোঁজ খবর নেয়? কেউ কোনোদিন এসে বলেছে, ওরে এখেন দিয়ে যাচ্ছিনু, তোর সঙ্গে এট্টু দেখা করতে এনু, এসেছে কেউ?
শশাঙ্ক বললেন, খপর নেয় না, নেয় না, তাতে তোর অসুবিধে কোনো কিছু হয়েছে?
সবিতা বলল, তারা ভাবে, যাবো, যদি মেয়েটা দুটো টাকা চেয়ে বসে? তেমন মেয়ে পাও নি আমাকে, বুক ফেটে মরে যাব, তবু নিজের অভাবের কথা কাউকে বলব না।
শ‍্যামলী খেয়াল করল, পিসির ব্লাউজের বগলের নিচে একটু ফেটে গিয়েছে। তাঁকে চোখের ইঙ্গিত করে গা চাপা দিতে বলল মেয়ে।
 বাবার দিকে তাকিয়ে মেয়ে বলল, জানো বাবা, শ্রীকান্তের পিসি যখন স্বামীকে সবার সামনে বলছে, খড়ের লেজটা রেখে দাও, তোমার কাজে লাগবে, এ কথাটা আসলে ওঁর স্বামিত্বকে নিদারুণ একটা ধিক্কার। এ যেন ঘুরিয়ে কৌশল করে স্বামীকে জানোয়ার বলে গাল দেওয়া। কতদিনের কত অসম্মানের জ্বালা সহ‍্য করতে করতে অতিষ্ঠ হয়ে গেলে তবে একটা সেকালের মেয়ে স্বামীকে সবার সামনে মুখ ফুটে এভাবে বলতে পারে! ঘরে ঘরে মেয়েরা এরকম জ্বালায় জ্বলছে। আমাদের একটা পাঠ‍্য কবিতা ছিল, রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের, ঈশ্বরী পাটনীর কাছে অন্নপূর্ণা বলছেন, কুকথায় পঞ্চমুখ, কণ্ঠভরা বিষ/ কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ/ গঙ্গা নামে সতা তার তরঙ্গ এমনি…
দাঁড়াও, আগের লাইনটাও বলতে পারব….
অতিবড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ।
কোন গুণ নাহি তাঁর কপালে আগুন।।
কুকথায় পঞ্চমুখ কণ্ঠভরা বিষ।
কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ।।
গঙ্গা নামে সতা তার তরঙ্গ এমনি।
জীবনস্বরূপা সে স্বামীর শিরোমণি।।
ভূত নাচাইয়া পতি ফেরে ঘরে ঘরে।
না মরে পাষাণ বাপ দিলা হেন বরে।।
অভিমানে সমুদ্রেতে ঝাঁপ দিলা ভাই।
যে মোরে আপনা ভাবে তারি ঘরে যাই।
এইভাবে ভারতচন্দ্র বাঙালির ঘরে ঘরে দাম্পত্য সম্পর্কের নামে বাস্তবে কি চলছে দেখিয়ে দিলেন।
শশাঙ্ক পাল বললেন, ওরে না না, ওর ভেতরের কথা ক’টা অন‍্য। ওর প্রতিটি কথার ভেতরের মানে আলাদা। কু মানে বেদ। কুকথা মানে বেদপাঠ। শিব ভোলানাথ পঞ্চমুখে বেদগান করেন। ত্রিভুবনকে প্রলয়ের হাত থেকে বাঁচাতে সমুদ্র মন্থনের কালে সাপের পেট থেকে যে তীব্র হলাহল বেরিয়ে এল তা তিনি কণ্ঠে ধারণ করে নীলকণ্ঠ হলেন। সব কথাগুলোর ভিতরের মানেটা আলাদা। আরো বললেন, অনেক আগে যাত্রা হত আমাদের গ্রামে। তখন শুনেছি।
মেয়ে বলল, ওটা কথার একটা কায়দা। ওকে অলঙ্কার বলে। ব‍্যাজস্তুতি অলঙ্কার। কিন্তু বাবা, আসলে সাধারণ ভাবে দাম্পত্যের নামে পারস্পরিক অবিশ্বাসের একটা আবহাওয়া ছিলই। ন‌ইলে কবি খামখা এভাবে লিখবেন কেন? বিয়ে যদি জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্কই হবে তো বৌ বলবে কেন, না মরে পাষাণ বাপ দিলা হেন বরে!
বাসন্তীবালা বললেন, এই মেয়েটা তো বড্ড কুচুক্কুরে! ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ওই এক পোঁ ধরে আছে, জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক বলে নাকি কিছু হয় না? হ‍্যাঁ রে, বিয়ে না হয়েই এত জেনে গেলি কি করে?
শ‍্যামলী বলল, মা, ওই শ্রীকান্ত যখন জাহাজে করে ব্রহ্মদেশে যাচ্ছে, তখন ওই টগর বোষ্টমী আর নন্দ মিস্ত্রির দাম্পত্যটা খেয়াল করেছ? অভয়ার স্বামীর কথাটা ভেবে দেখেছ, পুঁটুর বিয়ের কথাটা ভেবে দেখেছ? শাহজী আর অন্নপূর্ণার কথাটা? ভাবো ভাবো, শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তের পাতায় পাতায় প্রতিষ্ঠিত মূল‍্যবোধকে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করা হয়েছে।
সবিতা হাঁ করে তাকিয়ে শ‍্যামলীর কথা শুনছিলেন। তিনি বললেন, ও মা, এই রকম করলে তুই বিয়ে করে সুখী হবি কি করে? আকাশে সপ্তর্ষি আছেন, ওর মধ‍্যে আছেন বশিষ্ঠ। ওঁর কাছে আছেন অনুরাধা। সবাই বিয়ের সময় মেয়েকে শেখায় অনুরাধার মতো হও । স্বামী পরমগুরু। পরমরতন।
হ‍্যাঁ পিসি। পরমরতন। কিন্তু রামচন্দ্র তা মনে করেন না। আজ আমি ভিড় বাসে করে যাবার সময় কেউ যদি কায়দা করে গা ছুঁয়ে দেয়, তাহলে সে দোষী। কিন্তু আমার উপর দোষারোপ হবে কেন? আমি ঘটনার সাক্ষী মাত্র।  আইনতঃ আমার উপর কোনো দোষ বর্তায় না। অ্যাবেটমেন্ট এর চার্জ আসে না। তাহলে রাবণ যদি সীতাকে ধরে নিয়ে যায়, তাহলে রাবণে এগেইনস্টে মলেস্টেশনের চার্জ আনো। অন‍্যের বিবাহিতা স্ত্রীকে আটকে রাখার চার্জ আনো আইপিসির ফোর নাইনটি এইট ধারায়। কিন্তু সীতাকে অগ্নি পরীক্ষা দিতে হবে কেন বলতে পারো? তোমাদের না জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক? সত‍্যযুগে  বেদবতী রাবণের হাতে লাঞ্ছিতা হয়ে পাঁচ পাঁচটি বার ধিক্কার উচ্চারণ করেন। তাই দ্বাপর যুগে দ্রৌপদীকে পাঁচটি স্বামীর ঘর করতে হল। তাহলে কেন যুধিষ্ঠির মহাপ্রস্থানের পথে দ্রৌপদীকে অপবাদ দেবেন যে, তিনি না কি ভীমকে বেশি ভালবাসতেন? তোমাদের না জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক?
মেয়ের নাকের পাটা ফুলে ফুলে ওঠে।
সবিতা বললেন, তুই এমন করে বলিস্, যে তোর সামনে দাঁড়িয়ে কথা খুঁজে পাই না। কিন্তু তোর মত আমি মানি না। মেয়েছেলের পতিই পরমধন। পতি পরমগুরু।
শ‍্যামলী বলল, সে তুমি যদি যুক্তি বিচার না করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে থাকো, আমার কিছু করার নেই। কিন্তু আমাদের শাস্ত্রে এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে দেখিয়ে দেওয়া যায়, স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক আসলে একটা চুক্তি। একটা অ্যাডজাস্ট করে কাজ চালিয়ে দেওয়া।
 শশাঙ্ক পাল তীব্র চোখে তাকিয়ে বললেন, কেন? বিয়ে জিনিসটা একটা অ্যাডজাস্টমেন্ট? একটা চুক্তি মাত্র?
শ‍্যামলী বলল, হ‍্যাঁ বাবা।
শশাঙ্ক পাল গর্জে উঠে বললেন, প্রমাণ দে।
মেয়ে অকম্পিত স্বরে বলল, বাবা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে শ্রীরাধার সম্পর্ক জানো? বৈষ্ণব রসশাস্ত্র মতে রাধা মহাভাবস্বরূপিণী। অথচ শ্রীকৃষ্ণের ঘরে পাঁচ পাঁচটা ব‌উ।
বাসন্তীবালা বললেন, সে কি রে? পাঁচজন?
শ‍্যামলী বলল, হ‍্যাঁ মা, ঠিক পাঁচটি পাটরাণি। আর হারেমে কতগুলি বাঁদি পুষতেন তা জানি না। পাঁচটি প্রধানা স্ত্রী হলেন, পিসি কর গোণো, সত‍্যভামা, রুক্মিণী, তখন বাসন্তীবালা বললেন, এই দুটো জানি। শ‍্যামলী বলল, আর তিনটা হল লক্ষ্মণা, সুশীলা আর জাম্ববতী। আচ্ছা, তোমরাই বলো জন্ম জন্ম ধরে পাঁচটি মেয়ে কি এক অভিন্ন ভদ্রলোকের চাহিদা মিটিয়ে যাবে?
 শশাঙ্ক পাল বললেন, চাহিদা মেটানোর কথা কি বলছিস তুই? দাম্পত্য একটা পবিত্র সম্পর্ক।
শ‍্যামলী তীব্র ব‍্যঙ্গ করে বলল, হ‍্যাঁ, পবিত্র সম্পর্ক বলেই তো পাঁড় জুয়াড়িটা বিয়ে করা বৌকে বাজি রাখতে অন্তরে বাধা পেল না। শয়তানগুলো তার কাপড় খুলে নিচ্ছে দেখেও প্রতিবাদে ফেটে পড়ছে না। সীতার প্রতি অনাস্থায় রামচন্দ্র বলছেন, তোমার মুখের বাক‍্যটুকু যথেষ্ট নয়। তোমাকে অগ্নি পরীক্ষা দিতে হবে।
ঘরে একটা নীরবতা নেমে আসে। তখন অন্ধকার নামছে। বড়ো বড়ো ডানা মেলে কালো কালো বাদুড় ফিরছে বাসার পানে।
শ‍্যামলী বলল, বিয়ে মানে একটা বেশ‍্যাবৃত্তি।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।