দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৩৪)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ১৩৪
শ্যামলীদের বাড়িতে বেশ সকালেই হাজির হলেন রমানাথ। সবিতাপিসি নিচ থেকে চেঁচিয়ে বললেন, ওরে শ্যামলিমা, দ্যাখ্, কে এসেছে।
বাসন্তীবালা দ্রুত ওপরে শ্যামলীর ঘরে এসে তাকে বলে গেলেন পোশাক বদলে নিতে। অন্যদিন সে বাইরের কেউ এসে পড়লে নিতান্ত ঘরোয়া পোশাকে উপর অ্যাপ্রনটা পরে নেয়। আজ কিন্তু শ্যামলীর আর কোনো কিছুতে মন লাগছে না।
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রমানাথ বললেন, আমি আসব?
শ্যামলী বলল, হ্যাঁ আসুন।
রমানাথ বললেন, আজ বাড়িতে ব্রাহ্মণ ভোজন। তবু আমি না এসে পারলাম না। কাল তুমি আমাকে কিছুতেই সাথে আসতে দিলে না। কিন্তু কাল তোমার কথা অমান্য করেই তোমাকে আমার এসে পৌঁছে দেওয়া উচিত ছিল।
শ্যামলী বলল, দেখুন, আপনার বাড়িতে কাল তখনও অনেক অতিথি আত্মীয় স্বজন। তাঁদেরকে ফেলে আমার সঙ্গে আসা টা আপনার একেবারেই সঠিক কাজ হত না। আর সত্যি বলতে কি, একলাটি পথ চলতে আমার ভারি ভাল লাগে।
আচ্ছা, আমি ঘরোয়া পোশাক পরে আছি বলে আপনার অসুবিধা হচ্ছে না তো?
রমানাথ সচকিত হয়ে দেখলেন, শ্যামলী একেবারেই ঘরোয়া পোশাক পরে রয়েছে। তিনি বললেন, তুমি যদি পোশাক বদলাতে চাও, আমি না হয় তোমার বাবার ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করছি।
শ্যামলী বলল, না না, আমার কোনো সমস্যা নেই। আপনার অসুবিধা না হলেই হল।
এইকথার জবাব সহসা রমানাথের মুখে এল না। চায়ের কাপ প্লেট হাতে করে নিয়ে এসে সবিতাপিসি শ্যামলীর গায়ে একটা ওড়না জড়িয়ে দিলেন।
রমানাথ বললেন, মা কালকে তোমার উপর যে দুর্ব্যবহার করেছেন, তার জন্য আমি লজ্জিত। আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি।
শ্যামলী বলল, গতকাল আপনার মা বা অন্য আপনজনেরা কোনো অস্বাভাবিক কিছু করেছেন বলে আমি অন্ততঃ মনে করি না।
রমানাথ বললেন, না, আমি খুব লজ্জিত। মা যে এত কটুভাবে বলবেন, আমি ভাবতেই পারি নি।
শ্যামলী বলল, উনি আশা করেছিলেন আমি ওঁর কাছে কাছে থেকে ওঁকে আগলে রাখব। উনি আমার উপর নির্ভর করতে চাইছিলেন। আমাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করছিল ওঁর। না পেয়ে অভিমান প্রকাশ করেছেন উনি।
রমানাথ বললেন, তা হোক, যা হয়েছে, খুব গর্হিত কাজ হয়েছে। শ্যামলী বলল, কালকের সূর্যাস্তটা কি ভাল হয়েছিল। আর কাল আমার কাসিনি আর হাইগেনস এর কথা খুব মনে পড়ে গিয়েছিল।
রমানাথ বললেন, রজনীর শেষ তারা গানটা গতকাল আমি সারা রাত গুন গুন করে গেয়ে গিয়েছি।
শ্যামলী বলল, তাই? আমিও যে সারা রাত গান গেয়েছি। …
কাল রাতের বেলা গান এলো মোর মনে,
তখন তুমি ছিলে না মোর সনে ॥
যে কথাটি বলব তোমায় ব’লে কাটল জীবন নীরব চোখের জলে
সেই কথাটি সুরের হোমানলে উঠল জ্বলে একটি আঁধার ক্ষণে–
সেই কথাটি লাগল না সেই সুরে যতই প্রয়াস করি পরানপণে–
যখন তুমি আছ আমার সনে ॥
রমানাথ বললেন, সেই, সকালে উঠেই ছটফট করে চলে এলাম।
শ্যামলী বলল, কি লজ্জায় ফেললেন বলুন তো। একটা সামান্য ব্যাপার। আর তাই নিয়ে আপনি খামোকা অস্থির হচ্ছেন।
রমানাথ বললেন, সমস্ত আঘাত বুক পেতে নিয়ে, তুমি সেই আঘাতের অনেক উপরে উঠতে চাইছ।
শ্যামলী বলল, লাভ ইজ় মাই রিলিজন, আই উইল ডাই ফর ইট। ইংরেজ কবি কীটস এভাবে বললেন। আর অস্কার ওয়াইল্ড বললেন, দীজ় আর উণ্ডস অফ লাভ।
রমানাথ বললেন, কাল যখন ছাতে তুমি তারার আলোর সাথে কথা আর গান বুনে তুলছিলে, তখন আমি আমার জীবনের একটা আশ্চর্য সম্পদ পাচ্ছি ভাবছিলাম।
শ্যামলী বলল, আমার কথা বলা আপনার ভাল লাগে শুনে আশ্চর্য হচ্ছি। নিকোলাস কোপার্নিকাস বলেছিলেন, আমি এখন যা বলছি, তা শুনে আপনাদের হয়তো বা দুর্বোধ্য লাগবে, কিন্তু সময় আসুক, সঠিক জায়গায় কথাগুলি ঠিক ঠিক খেটে যাবে।
রমানাথ বললেন, কাল তুমি বড্ড একাকীত্বের কথা বলছিলে। ওইজন্য তুমি একলাটি চলে আসার পর আমার খুব উদ্বেগ হচ্ছিল।
শ্যামলী বলল, একলা না হলে আমি ঠিক মনের কথাগুলো ভেবে নিতে পারি না। আর্থার শোপেনআওয়ারের একটা কথা মনে পড়ে, একটা মানুষ যতক্ষণ না একলা হচ্ছে, ততক্ষণ সে নিজেকে খুঁজেই পায় না। যে লোক একাকীত্ব কে ভালবাসে না, সে বুঝি স্বাধীনতা বোধকেও পছন্দ করে না। যখন কেউ একলা হয়, একমাত্র তখনই সে সত্যিকারের স্বাধীন হয়।