• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৩৩)

পর্ব – ১৩৩

সকাল হলে শ‍্যামলী ব‌ই খাতা টেনে নিয়ে অঙ্ক করতে বসল। সবিতাপিসি ঘরে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, শ‍্যামলিমা, কাল রাতে কি হয়েছিল তোর? আমি আসতে চেয়েছিলাম। দাদা বারণ করল। বলল, ওর কষ্ট ওকে নিজেকে সামলে নিতে দাও। আমিও ভাবলাম, যে চাপা মেয়ে তুই, মরে গেলেও কারো দোষ ধরবি না।

শ‍্যামলী বলল, কেন বাজে বকছ পিসি, আমি তোমার কথার খুঁত ধরি না? যখন ধরিয়ে দিই, তখন তুমি ক্ষেপে যাও না?
সবিতা বললেন, সে ছেলে মেয়েরা বাপ মাকে তো সংশোধন করে দেবেই। সেই জন‍্যেই তো লোকে ছেলেমেয়ে চায়।
শ‍্যামলী বলল, কি জানি গো, অনেকে বলেন, ছেলে মেয়ের মধ‍্যে দিয়ে মানুষ নিজের জীবনটা আরো অনেকটা বহে নিয়ে যেতে চায়। অনেক লোক ভাবে মরে যাবার পর ছেলে মেয়েরা শ্রাদ্ধ শান্তি করবে। পিণ্ড দেবে। জল দেবে।
সবিতা বললেন, সেই অনেক দিন আগে তুই একটা গল্পের বই পেয়েছিলি। তাতে একটা অভাগীর গল্প ছিল। ওর খুব লোভ ছিল ছেলের হাতের আগুন পাবে। স্বামী ওকে নিত না।
শ‍্যামলী বলল হ‍্যাঁ। ক্লাস এইটে প্রাইজ পেয়েছিলাম। ওর সাথে আরো একটা গল্প ছিল পিসি। একটা বলদ নিয়ে।
সবিতা বলল, দাঁড়া দাঁড়া, সেই বাপটা মা মরা মেয়েটাকে নিয়ে গাঁ ছেড়ে চটকলের বস্তিতে চলে যাবে। বলদটাকে নিজের ছেলের মতো ভালবাসত।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ‍্যামলী বলল, হ‍্যাঁ পিসি, ভোলা যায় না।
সবিতা বললেন, লোকটা মুসলমান। কিন্তু বলদটাকে আদর করে মহেশ বলত। কিন্তু কেন রে?
শ‍্যামলী বলল, বাংলায় ওরকম হয়। আসলে তো হিন্দু ছিল। তার আগে বৌদ্ধ ছিল। বড়লোকের হাতে মুখ বুজে মার খেতে খেতে একসময় ধর্ম না বদলে নিলে জান টিঁকছিল না। এই যে সেন পাল বসু মিত্র ঘোষ এইসব পদবি দেখতে পাও না, এসব অনেক আগে হয়তো বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোক ছিল। সব বদলে বদলে যায়।
সবিতা বললেন, আমাদের গাঁয়ে একবার মুসলমান মেয়েদের একটা দল এসেছিল, ওরা কৃষ্ণলীলার পট দেখিয়ে গান করেছিল।
শ‍্যামলী আনমনে বলল, হুঁ। মানুষ এনেছে ধর্ম, ধর্ম আনে নি মানুষ কোনো।
সবিতা বললেন, তাহলে ধর্ম নিয়ে এত ঝগড়াঝাঁটি কেন রে?
বাসন্তীবালা এসে ঢুকে আলোচনায় যোগ দিলেন। সেই সপ্তপদী মনে কর্। সেই সুচিত্রাকে ছবি বিশ্বাস কি নিষ্ঠুর ভাবে বলেছিল। কতখানি পাষাণ হলে মেয়েটাকে বলতে পারে, এই ব্রাহ্মণের ছেলেকে তুমি ছেড়ে দাও!
শ‍্যামলী বলল, মা, তুমি সুচিত্রা সেন না বলে রীণা ব্রাউন বললে ঠিক হত। আর ছবি বিশ্বাস না বলে কৃষ্ণেন্দুর বাবা।
সবিতা বলল, বৌমণি, কতবার দেখেছি বলো তো সিনেমাটা! টিভিতে দিত তো।
বাসন্তীবালা বললেন, আর টিভির কথা মনে করিয়ে দুঃখু দিস্ না। বেশ ভুলে ছিলাম তুই আবার খুঁচিয়ে তুললি।
সবিতা বলল, আমি তো সিনেমা দেখার কথা বলছিলাম।
শশাঙ্ক পাল এসে বললেন, আমি আর টিভি কিনছি না। ছেলেরা কিনলে কিনবে।
শ‍্যামলীর মনে পড়ল, বিরাশি সালের বিশ্বকাপের কথা। স্পেন ছিল হোস্ট কান্ট্রি। তেরো জুন থেকে ঊনত্রিশ দিন ধরে বাহান্নটা ম‍্যাচ হয়েছিল। চ‍্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইটালি। রানার্সআপ জার্মানি, পোল‍্যাণ্ড থার্ড পজিশনে। ফ্রান্স ফোর্থ পজিশন। শান্তনু অতনু দুইভাই ব্রাজিলের সাপোর্টার। ব্রাজিলের ম‍্যাচ থাকলে পড়াশোনা ফেলে বাবার খাটে বসে টিভি দেখত। দুইভাই জার্সি গায়ে এমনকি ফুটবলারের জুতো মোজা পর্যন্ত পরে, খাটের ছতরিতে ব্রাজিলের পতাকা টাঙিয়ে খেলা দেখত। বাবা বলতেন, তোরা যে ব্রাজিলের এত ভক্ত, তো খেলা দেখার সাথে সাথে ব্রাজিলের ভূগোল আর অর্থনীতির খবরাখবর রাখবি। ওরা দুই ভাই বাবার কথা কানেই নিত না। একদিন ব্রাজিলের সাথে ইটালির খেলা। ব্রাজিল খুব লড়ে খেলছে। মাঠে ইটালির দিক থেকে বল বেরোনোর কোনো সুযোগ‌ই পাচ্ছে না। এমন সময় ইটালি একটা কর্ণার কিক পেয়ে গেল। ব্রাজিলের গোলের কাছে ওঁত পেতে ছিল ইটালির রোসি আর গ্রাজিয়ানি। সুযোগ পেয়ে ঢুকিয়ে দিল গোলে। ইটালি এগিয়ে গেল। ব‍্যাস্, অতনু খেপে উঠে বুট পরা পায়ে টিভিতে কষিয়ে দিল এক লাথি। দুম করে শব্দ করে টিভির কাচনল ভেঙে গেল। বাবা অতনুর উপর প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন। তখন বাবা রেগে গেলে রক্ষা থাকত না। ওটা যে হাইপারটেনশন অসুখের লক্ষণ, তা কেই বা আন্দাজ করবে? বাবা রুদ্রমূর্তি ধরে অতনুকে বকাবকি করছেন। বাঁদর কোথাকার! খেলাটা কি টিভির ভিতর হচ্ছে? তোর পা চালাবার কি দরকার!
মা বলে বসলেন, একটা টিভির জন‍্য তুমি ওকে অত গাল দিচ্ছ! আমার ছেলেরা বড়ো হয়ে টিভি কিনে আনবে দেখো।
গভীর ক্ষোভে শশাঙ্ক পাল বলেছিলেন, আমি টিভির জন‍্য বলছি না। অত বড় ছেলে, সামনের বছর মাধ‍্যমিকে বসবে, সে জানবে না, খেলাটা টিভির ভিতর হচ্ছে না, স্পেনের মাঠে হচ্ছে!
অতনু গোঁ ধরে বলল, রোসি চুরি করে গোল নিয়েছে।
বাবা বললেন, সেটা দেখার জন্য রেফারি আছে। টিভির কাঁচে তোর পা কেটে গেলে কি বিপদে পড়তাম বল্ তো!
মায়ের উপর রাগে বাবা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, আর টিভিই কিনবো না। আগে ওদের বোধোদয় হোক, ওরাই কিনবে।
শশাঙ্ক পাল মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি ভাবছিস মা?
শ‍্যামলী বলল, সেই কুয়েতের আমিরের কথা। ফ্রান্স গোল দিয়েছে। রেফারির দিকে তেড়ে গেলেন আমির। ভয় পেয়ে রেফারি গোল বাতিল করে দিল। কিন্তু শেষ অবধি কি ফ্রান্সকে রুখতে পারল! ফোর্থ প্লেস হলেও তো ফ্রান্স এগিয়েছে। কুয়েত তো সেখানে পৌঁছতে পারে নি!
শশাঙ্ক পাল বললেন, আরে বাবা, গলাবাজি করে কারো গুণকে চেপে দেওয়া যায় না।
শ‍্যামলী বলল, বাবা, একধরনের মানুষ কিন্তু গলার জোর আর গায়ের জোরকেই শেষ কথা ভাবে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *