• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৪)

‘যেনাহং নামৃতা স্যাং’

৩৩

পাল অটোমোবাইলস – তালা বন্ধ করে এসে বাবাকে দেখে শ্যামলী ডাক্তারকে ফোন করল। তিনি বললেন হাসপাতালে নিতে। দু ভাইয়ের একজনও নেই। দিদি পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পারে নি। মাকে ডাকল শ্যামলী।
টাকা পয়সা তোমার কাছে কি আছে? বাবাকে হাসপাতালে নেব।
সে কি? তোর ভাইয়েরা আসুক, বীরু ঠাকুরপো আসুক , তুই একা কি করে কি করবি?
মা, তোমার আলমারির চাবি দাও।
চাবি নিয়ে কি করবি? বেশি টাকা লাগলে বীরু ঠাকুরপো’র কাছে চা। সে আসুক।
মা, চাবিটা দিতে বলেছি।
চাবি নিয়ে আলমারি খুলে ফেলে সে। সম্ভাব্য জায়গাগুলি খুঁজে দেখে বেশ কিছু টাকা পায়।
তোমার সাথে বাবার জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট আছে?
ছিল তো। বীরু ঠাকুরপো জানে।
এমন সময় নিচে একটা চেঁচামেচি শুনতে পেল শ্যামলী।
দাদার কী হয়েছে – বলতে বলতে বীরুকাকু সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসছে। মাঝ সিঁড়িতে তাকে আটকাল শ্যামলী।
কী ব্যাপার ? আপনি ওপরে আসছেন কেন?
দাদার কী হয়েছে আমায় দেখতে দে
না, আপনি নিচে যান , যান বলছি !
বীরু ঘাবড়ে যান। কী হয়েছে তোর ?
এখুনি নিচে যান। কোনও দিন ওপরে উঠবেন না।
বীরু এক পা দু পা করে কয়েক ধাপ নেমে চ্যালেঞ্জ করলো – কারখানার দরজায় তালা কে মেরেছে ?
যার কারখানা সে মেরেছে। যান এ বাড়ি থেকে, এখুনি বেরিয়ে যান।
আচ্ছা, দেখে নেব , ইত্যাদি শাসাতে শাসাতে বীরু চলে জায়।
মা ডুকরে কেঁদে উঠলো। ও মা, তুই কি করেছিস?
মা, একদম চুপ করো।
চাকর বাকরেরা আর সবিতা পিসি শ্যামলীর কণ্ঠস্বর আর চাউনি দেখে বুঝে গেল আজ পাল বাড়িতে জরুরী অবস্থা জারি হয়েছে।

৩৪

দুটো নম্বরে ডায়াল করতে করতে এক সময় একটায় লেগে গেল।
খুব নরম গলায় বলল – আমি শ্যামলী পাল বলছি।
ওপার হতে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে একজন উত্তর দিল
কি বলবেন, বলুন।
আমার বাবা অসুস্থ। আপনি একটু আসুন।
আরেকটা নম্বর হতেও সাড়া মিলল।
ওরা আসতে শ্যামলী ওদের বলল – আমি বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো। হয়ত রাতে আমায় থাকতে হবে। আপনারা আমার সাথে চলুন।
শ্যামলী আন্দাজ করেছিল ওরা রাজি হয়ে যাবে।
ঘরের দেওয়ালে শো পিস হিসেবে একটি খাপওয়ালা ছুরি ছিল। শ্যামলী সেটি একবার হাতে নিল। বাবা অমৃতসর বেড়াতে গিয়ে এনেছিলেন। একটি তরোয়ালও এনেছিলেন শখ করে।
রাতে বাইরে থাকতে হলে একটা মেয়ের সুরক্ষা প্রয়োজন। পঞ্জাবী মহিলারা সাথে ছুরি রাখেন। ওটা ওঁদের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য। কিন্তু বাঙালিদের এমন কোনও প্রথা গড়ে ওঠে নি। পঞ্জাবী মহিলা সাথে ছুরি রাখলে কোনও প্রশ্ন উঠবে না। বাঙালি মেয়ে লুকিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু জানাজানি হলে সমস্যা হবে। থাক, ইস্পাতের অস্ত্র থাক। বুদ্ধির অস্ত্রটুকু থাকলেই হল।
বাবাকে এসো সবাই মিলে ধরে নামাই।
আগত অতিথিরা কারা মা জানতে চাইলে শ্যামলী বলল – আমার বন্ধু। এই বলে হেসে ওদের মুখের দিকে তাকাল। ওদেরও মুখে হাসি। মাকে তো আর বলা চলে না, এরা একতরফা কয়েকটি প্রেমপত্র দিয়েছিল। হাতের লেখা আর ভাষাবন্ধন ভাল লেগেছিল বলে ফোন নম্বরটা মুখস্থ রেখেছিল মেয়ে।
নিশ্চিন্তে ওদের সঙ্গে হাসপাতালে রওনা হল মেয়ে। গলায় আঁচল দিয়ে ঠাকুর স্মরণ করলেন শ্যামলীর মা।

৩৫

ঘণ্টা খানেকের জার্নি। বাবার মাথাটা মেয়ের কোলে। ড্রাইভারের পাশে দু জন বন্ধু। পৌঁছনো গেল রাজধানী শহরের হাসপাতালে। এমারজেন্সী বিভাগে ভরতি করে ফেলল। তার সাথে কথা বলতে বলতে জুনিয়র ডাক্তাররা বুঝে নিল পেশেন্টের সঙ্গে যারা এসেছে – তারা কিছু জানে। তারা শ্যামলীকে বুঝিয়ে বলল আপাততঃ হাই প্রেশার স্বাভাবিক করার চেষ্টা হবে। তার সাথে হাইপারটেনশন কমানো। শ্যামলী তাতেই রাজি। ডাক্তারদের সাথে সহযোগিতা করতে হয়।
সিনিয়র ডক্টর এলে শ্যামলী তাঁকে বলল – ডক্টর , আপনি যেমনভাবে গাইড করবেন , আমি সব ব্যবস্থা করব।
পেশেন্টের মেডিক্যাল ফাইল কই ?
মাথা নিচু করে থাকে মেয়ে।
নেই ?
মাথা নাড়ে মেয়ে।
নেই কেন? কোনও দিন প্রেশারটাও মাপাত না?
না।
কি ওষুধ খেত ?
হোমিওপ্যাথিক।
ওহ ! কোনও প্রেসক্রিপশন আছে?
না, বারার গুরুদেব যে ওষুধ দিতেন , বাবা তাই খেতেন।
গুরুদেব ? উনি ডাক্তার ?
না। দৈবীমাহাত্ম্যযুক্ত ওষুধ দিতেন।
কি যা তা বলছ !
আমারও তাই মত। ওইজন্যে এখানে এনেছি। বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা হোক।
গার্জেন কে? বড়রা সাথে কেউ এসেছে?
না। সে রকম কেউ নেই।
তুমি কি পড়ছ?
অঙ্ক নিয়ে ফার্স্ট ইয়ারে।
তোমার সাথে ওরা ?
আমার ওয়েল উইশার।
বাহ, বেশ।

৩৬

চলুন, কিছু খাই। মেয়েটির ঠোঁটে আলতো হাসির আভা।
সে কি , পেশেন্ট এমারজেন্সিতে , আমরা খেতে যাবো ?
এখানে দাঁড়িয়ে আছেন আড়াই ঘণ্টা হয়ে গিয়েছে। আমাদের সকলকে সুস্থ থাকতে হবে।
খেয়ে এসে ওরা দেখল বাবা ঘুমাচ্ছেন। ঝুলন্ত বোতল থেকে নলে করে ওষুধ ঢুকছে রোগীর শরীরে।
নাইট ডিউটির নার্স বলল – চিন্তা করো না। ভাল আছে তোমার বাবা। ঘুমানোর ওষুধ দেওয়া হয়েছে।
রাত গভীর হয়ে এলেও পেশেন্টের কমতি নেই। অ্যামবুলেন্স যাচ্ছে আসছে। গাছে গাছে ঘুমন্ত পাখিরা মাঝে মাঝে ছটফট করে উঠছে।
বাবাকে আর একবার দেখে এসে শ্যামলী বলল – চলুন , বাইরে যাওয়া যাক।
সে কি , এতো রাতে বাইরে কি কাজ? এখানেই একটু বসার জায়গা খুঁজে বেশ রাতটা কাটিয়ে দেবো।
চলুন না আমার সঙ্গে।
মেয়ের চোখের মেদুর অনুনয় ফেলতে পারে না ওরা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো গেট দিয়ে বের হয়। বড়ো রাস্তা পার হয়ে গ্লোরী লজ। সেখানে নিয়ে চলে মেয়ে।
এ কি ! এখানে কেন ?
ড্রাইভারকে দিয়ে দুটো ঘর বুক করে রেখেছিলাম। বাবা ব্যবসার কাজে কোনোদিন কলকাতায় থাকতে বাধ্য হলে এখানেই থাকতেন। ওরা বাবাকে বেশ অনেকদিন ধরে চেনে। ড্রাইভারকেও।
ঘর দুটো পাশাপাশি। একটা ডবল আর একটা সিঙ্গল।
এই বড়ো ঘরটায় আপনারা দুজনে থাকুন।
তুমি?
এই তো, পাশেরটায়।
তোমার একা একা ভয় করবে না?
নাহ , আপনারা তো পাশেই রইলেন।
বেহারা খাবার জল দিয়ে গেল জগ ভরে।
বিছানায় নতুন পাজামা পাঞ্জাবি দেখে বন্ধুরা অবাক।
এ কি? এ গুলো কার?
রাতটা দুচোখের পাতা এক করতে হবে। শার্ট প্যান্ট পরে ভাল ঘুম হয় না। আপনারা বিশ্রাম নিন এবার।
একটা স্নিগ্ধ সৌরভ ঘরের সিলিং এ ঝুলে থাকে অনেকক্ষণ।

৩৭

সকাল হতে দরজা খুলে ওরা দেখল মেয়েটি স্নান করে খুব যত্ন করে দুধ শাদা একটি শাড়ি পরেছে। ভিজে এলো চুল পিঠে। দেখা হতেই বলল – গুড মর্নিং।
তুমি কখন উঠেছ?
বেশ ভোরে। তখন প্রথম ট্রাম ঘন্টি দিতে দিতে যাচ্ছে। তখনই টুক করে বাবাকে একবার দেখে এসেছি। ঘুমাচ্ছেন।
তাই ? তুমি খুব ভোর বেলা ওঠো বুঝি?
না, রোজ উঠি না। আজ ভোরের ট্রামটার ঘন্টি শুনে উঠতে ইচ্ছে হল। চলুন, আপনাদের সাথে গিয়ে চা খেয়ে আসি। এখানে একটা দোকানে দারুণ চা বানায়। বাবা গল্প করতো। সেই গল্পের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে খুঁজে পেয়েছি।
মনেই হচ্ছে না এমারজেন্সিতে পেশেন্ট রেখে এসেছি। ঠিক যেন কোথাও বেড়াতে এসেছি। তোমার কোনও টেনশন নেই না?
আমি তো আমার কাজ করছি। ডাক্তাররা করছে তাদের কাজ , নার্সরাও করছে। খামকা টেনশন করে কি লাভ?
মেয়ের হাসি ভরা চোখ দেখে ওদের ভালো লাগে। একজন মেয়ের একটি করতল হাতের মধ্যে নিয়ে নেয়। দেখাদেখি অন্যজনও। মেয়ের কোনও আপত্তি নেই। তিনজনে হাত ধরাধরি করে রাজধানী শহরের বুকে হাঁটতে থাকে। শহর তখন ঘুম ভেঙ্গে একটু একটু করে জাগছে।

৩৮

বাবা, তুমি কেমন আছো ?
ভালো আছি। খুব হালকা লাগছে।
তুই ভোর রাতে এসেছিলি।
হ্যাঁ , তুমি কি করে জানলে?
নার্স রা বলছিল।
রাতে কোথায় ছিলি?
কেন বাবা, তোমার গ্লোরী লজে। ওরা তোমাকে খুব ভালবাসে।
কোনও অসুবিধে হয় নি তো ?
না বাবা, কিচ্ছু অসুবিধে হয় নি।
তোর বন্ধুরা খুব ভাল।
বেশিরভাগ মানুষই ভাল বাবা। শুধু বুঝে মিশতে হয়। মাত্রা রেখে।
ওদের জলখাবার খাইয়েছিস ?
এবার খাওয়াবো। তুমি একটু বিশ্রাম নাও।

৩৯

কি বলল বাবা?
বন্ধুদের খেয়াল রাখছি কি না… সেইসব।
তোমার ম্যানেজমেন্ট দারুণ।
জলখাবার এর ব্যবস্থা হল হাসপাতালের ক্যান্টিনে।
এবার কিন্তু আপনাদের বেরিয়ে পড়তে হবে। নিশ্চয় কাজ আছে।
কিন্তু তুমি?
আমি থাকব। বাড়ি থেকে কেউ না কেউ আসবে।
এই পাজামা পাঞ্জাবিগুলো ?
আপনাদের কাছে থাকবে। যেদিন ইচ্ছে হবে পরবেন। সেদিন আমায় মনে পড়বে।
তোমায় রোজ রোজ মনে পড়বে। সব সময়।
আচ্ছা, মনে রইলো।

৪০

এমারজেন্সীতে ঢুকে বাবার হাতে সুচ ফোটানো দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো তনুশ্রী। দিদির সঙ্গে জামাইবাবুও এসেছে। শান্তনু অতনু দুই ভাই একটু দূরে মুখটা গোঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার বেডের সাথে লাগানো মেডিক্যাল কাগজগুলি দেখে নিলেন জামাইবাবু।
শ্যামলী, ডাক্তার কখন আসবে?
জানি না অরুণ দা। চলে আসবে নিশ্চয়।
রাতে কোথায় ছিলে ?
আপনি তো জানেন। গ্লোরী লজে ছিলাম।
কি পরিচয়ে ছিলে ?
আমি একটা মানুষ। আমার কি ভাগ্য ওরা সেটা দেখেই বুঝতে পেরেছিল।

৪১

দিদি প্রচণ্ড জেদ ধরল তার সঙ্গে তার বরকে থেকে যেতেই হবে হাসপাতালে। জামাইবাবু তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলো যে একটু বিকেল বিকেল সে ব্যাংক থেকে চলে আসবে। তনুশ্রী নাছোড়। না, ওষুধের কাগজগুলো বুঝে নিতে হবে। ভাইয়েরা ছেলেমানুষ, কোনও দিন এসব করে নি। বেশ বোঝা যাচ্ছে শ্যামলী যে আছে সেটা দিদি গণ্যই করতে চাইছে না। বাবাকে কে হাসপাতালে আনল, কে ভরতি করলো , কে ডাক্তারের সাথে কথা কইল – তনুশ্রী কোন কিছু জানার চেষ্টাই করল না। অথবা সব খুঁটিয়ে জেনেছে বলেই বাবার ওপর দখলদারি হারানর আতঙ্কে ভুগছে। আর বাবার ওপর নিজের অধিকার ফলাতে বরের ওপর জোর খাটাচ্ছে।
শ্যামলী দিদি জামাইবাবুর কথার মধ্যে ঢুকল না।

৪২

সেই ফেরার সময়টা খুব মনে পড়ে শ্যামলীর। মনে করো শেষের সে দিন ভয়ংকর ; অন্য সবে কইবে কথা, তুমি রইবে নিরুত্তর। তনুশ্রী , শান্তনু আর অতনু যেন একটা দল পাকিয়েছে। শ্যামলী যেন কেউ নয়। ব্যাংকের লোকে ম্যানেজারকে খুঁজতে গাড়ি নিয়ে হাসপাতালে চলে এসেছিল। কেন না, ম্যানেজার বাবুর কাছে একটা চাবি থাকে। অফিসের লোক এসেছে দেখে দিদি আর কথাটি কয় নি। ছাড়ার কাগজ গুছোতে বেলা বাড়ল। ডাক্তার শ্যামলীর সাথেই কথা বলছেন দেখে ওরা গোঁজ হয়ে রইলো। গাড়িতে ওঠার সময়েও বাবা তার কাঁধে ভর দিতে চাইলেন দেখে সে বলল অতনুকে পাশে রাখো বাবা। ও তোমায় খুব মিস করছে। বাবা যেন বুঝতে পারছিলেন তার সন্তানদের মধ্যে একটা টেনশন প্রকাশ্যে এসে পড়লো বলে। গাড়িতে দিদি আর ভাইয়েরা অনর্গল বকে যাচ্ছে। বাবার জন্যে কার কেমন কষ্ট হচ্ছিল। শুধু শ্যামলী জোর করে মুখে কুলুপ লাগিয়েছে। যে ভাই বোনেরা এক সাথে বড়ো হয়েছে – তাদের সঙ্গে এ রকম দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল।

৪৩

বাবাকে নিয়ে সকলে বাড়ি ফেরার পর মা শ্যামলীকে আলাদা করে ডাকল। একটা খাম দিল। আজ দুপুরে মুখবন্ধ একটা খাম কে একটা লোক এসে দিয়ে গেছে। বাবার নামে খামটা। ভেতরে একটা চিঠি। চট করে পড়ে নিল শ্যামলী। নকুড় নন্দী চিঠি দিয়েছেন বাবাকে। “ পরম শ্রদ্ধেয় গুরুভ্রাতা” বলে সম্বোধন করে চিঠি শুরু। তার পর শ্যামলীর সাথে তার পুত্রের সম্বন্ধ প্রার্থনা করে নকুড় বাবু তার জীবনের চরম ভুলটি করেছেন বলে ঘোষণা করেছেন। যে মেয়ে দু দুজন পর পুরুষের সাথে হোটেলে রাত কাটাতে দ্বিধা করে না, তেমন কুলটা মেয়ের সাথে পুত্রের বিবাহ বিষয়ে যে কথা হয়েছিল এতেই তিনি যথেষ্ট অপমানিত বোধ করেছেন বলে নকুড় নন্দী বাবার উদ্দেশে লিখেছেন। শ্যামলী ঠিক করলো যে মাথা গরম করবে না। নিজেকে খুব সহজ আর স্বাভাবিক দেখানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে মাকে বলল – ঠিক করেছ মা, কোনও চিঠি এভাবে এলে খাম খুলবে না। আমাকে দেখাবে।
“কেন দেখাবো ? কেন খাম খুলবো না? তুমি কোন পীর ঠাকুর যে সকলকে তোমার আজ্ঞা নিয়ে চলতে হবে? কি পেয়েছিস তুই ? বাড়ির সবাই তোর কথায় উঠবে বসবে?”
“বিপদের দিনে শান্ত থাকতে হয় মা। তুমি তো ঠিক কাজ করেছো। খাম খোলার আগে আমায় দেখিয়েছ। এমনটাই করবে।“
“কিন্তু কেন? পেটের মেয়ের কাহে জো হুজুর হয়ে থাকতে হবে আমায় ? কেন, তোর পয়সায় আমি খাই পরি?”
“রাগ করে তুমি যাই বলো না কেন, খাম খোলার আগে আমায় দেখিয়ে তুমি সঠিক কাজ করেছো।“
শ্যামলী নিজের ঘরে গিয়ে তার আলমারির ভেতরে চিঠিটা রেখে দিল। তার পর বাবার কাছে গিয়ে দেখল দিদি আর জামাইবাবু বাবার কাছে বসে আছেন।
জামাইবাবু বললেন – “শ্যামলী তুমি যে গুরুদেবের সাথে কিছুমাত্র পরামর্শ না করে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছো – তাতে গুরুদেব খুব মনোকষ্ট পেয়েছেন। তোমার একবার সংবাদ দিয়ে অনুমতি নেওয়া উচিত ছিল। গুরুদেব দু একদিনের মধ্যে বাবাকে দেখতে আসবেন। তখন তুমি তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ো – কেমন?”
জামাইবাবুর কথা শুনেও শ্যামলীর কোনও ভাবান্তর না হতে তনুশ্রী ঝাঁঝিয়ে উঠলো –“ হ্যাঁ রে বনি , তুই না কি বীরুকা কে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিস? সে বেচারা কেঁদে কেঁদে সকলকে বলে বেড়াচ্ছে? তুই কি বাড়ির সম্মান টম্মান আর কিছু অবশিষ্ট রাখবি না? যে লোকটা তোর বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে , তাদের যাতে তোকে পছন্দ হয় , তার জন্যে কতো খেটেছে, তার প্রতি তুই নেমকহারামি করতে পারলি ?”
এমন সময় শশাঙ্ক পাল বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন “ তনু , তোরা আমায় একটু একা থাকতে দিবি?”
শ্যামলী বলল –“ হ্যাঁ অরুণদা , চলুন , আমরা বৈঠকখানা ঘরে গিয়ে গল্পসল্প করি।“
“ শ্যামলী , আমি তোমার সাথে রসালাপ করতে আসি নি।“
“ কিন্তু কি জানেন , লোকে শ্যালিকার সাথে ওই রসালাপ জিনিসটাই করে থাকে। আপনার সব কথাতেই আমার ভারি মজা লাগে। ওটা আমার অভ্যেস হয়ে গিয়েছে।“
অরুণ রাগে কথা খুঁজে পান না।

৪৪

অরুণ রাতে তোমরা খেয়ে যাবে কিন্তু। আমাদের রান্না রেডি।
সবিতা পিসি জামাইয়ের সামনে এসে বললেন।
কি রেঁধেছ পিসি ? ছোলার ডাল করেছো তো?
তা আর করিনি ? আর …
আর কি করেছো ?
ধোঁকার ডালনা।
পিসি আজ আর থাক। যে ধোঁকা খাচ্ছি , আর ধোঁকার ডালনা নাই বা খেলাম।
মিস করবেন অরুণ দা। শ্যামলীর চোখে দুষ্টু মিষ্টি হাসি।
তোমার কি লাজলজ্জা কিছু নেই শ্যামলী? তোমাকে দেখছি, আর আমার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে।
কেন, এত লজ্জা পাবার মতো কোনও কাজ তো করেছেন বলে আমি শুনি নি।
হেসো না শ্যামলী , তোমার ওই হাসি আমার অসহ্য লাগছে। কি করে তুমি দুটো বাইরের লোকের সাথে রাত কাটালে ?
আপনি নিশ্চয় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন ; নইলে জানলেন কি করে ? হ্যাঁ , বেশ মনে পড়ছে, দরজার বাইরে কুটুর কুটুর শব্দ হয়েছিল। আমি ভাবলাম ইঁদুর টিদুর হবে। তাহলে আপনি আমার দরজার পাশে আড়ি পেতেছিলেন !
বাজে বোকো না শ্যামলী। ন্যাকা সেজে পার পাবে না।
ও অরুণ দা, আমি তো বলছি আমি দুটো বাইরের লোকের সাথে রাত কাটিয়েছি , আর কি কি করেছি , দরজার আড়াল থেকে সব আপনি দেখেছেন। আচ্ছা দিদি, অরুণ দা কে তুই ছেড়ে দিলি ? সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকতে অরুণ দা’র কতো কষ্ট হয়েছে বল তো !
সবিতা পিসি ঘাবড়ে যান। ও শ্যামলিমা , কি করেছিস তুই ? ও জামাই , শ্যামলী ছোটো মেয়ে। মনে কিন্তু কোনও পাপ নেই। ওকে তো কোলে করে মানুষ করেছি। ওর দোষ নিয়ো না। পরে আমি ওকে শাসন করে দেব। এখন এসো খাবে এসো।
তনুশ্রী বরের ওপর ঝাঁঝিয়ে ওঠে। তোমার কি এতো দায় পড়েছে ওর ভাল চিন্তা করবার? কলেজে পড়ছেন , দুটো পাখনা গজিয়ে ফেলেছেন ; যাকে যা বলবার নয়, তাই বলে শাসাচ্ছেন। তুমি কেন গাল বাড়িয়ে চড় খাচ্ছ ?

৪৫

আচ্ছা , অরুণ দা, আপনি শুনেছেন , আমার বিয়ের কথা হচ্ছে ?
শুনব না কেন? বীরুকাকা সম্বন্ধ এনেছেন, পাত্রের বাবা আমার শ্বশুরের গুরুভ্রাতা , গুরুদেব যোটক বিচার করেছেন। সব তো জানি।
কিন্তু আমি তো কিছু জানি না। দু দুবার ওরা এসে দেখে গিয়েছেন। কিন্তু কেউ তো জানতে চান নি, আমার কি মত ?
তুমি এখন আবার নতুন কথা ফেঁদে বোসো না।
না, এই যে আপনি দেখেছেন আমি দুটো বাইরের লোকের সাথে রাত কাটিয়েছি, আর কি কি করেছি …
তোমাকে স্নেহ করি। তাই সাবধান করা। আঁচাতে আঁচাতে অরুণ বললেন।
হ্যাঁ স্নেহ করেন। খুব স্নেহ করেন। আপনি স্নেহ করেন। আপনাদের গুরুদেবও স্নেহ করেন। জানেন অরুণ দা, স্নেহ অতি বিষম বস্তু।
তুমি কি বলতে চাচ্ছ ?
একটা সোজাসাপটা কথা। একটা মেয়ের বিয়ে হবে। সে প্রাপ্তমনস্ক কি না ?
নিশ্চয়। তোমার আঠারো বছর বয়স পার হয়েছে।
যদি আমাকে প্রাপ্তমনস্ক নারী বলে মনে করেন , তাহলে কোথায় কোন হোটেলে আমি কোন দুটো বাইরের লোকের সাথে রাত কাটিয়েছি , আর কি কি করেছি … তা নিয়ে এত ভাবেন কেন?
ভাববো না, আমরা তোমার আপনজন যে ?
আমাকে প্রাপ্তমনস্ক নারী বলে যদি সত্যি সত্যি মনে করেন , তাহলে বাইরের লোকের সাথে রাত কাটিয়েছি ব্যাপারটাকে আপনি এত বড়ো ইস্যু করতেন না। আমার বোধ বুদ্ধি বিচারধারার ওপর ছেড়ে দিতেন।
কি বলতে চাইছ শ্যামলী ?
বলতে চাইছি যে বিয়ে দেবার প্রশ্নে যাকে প্রাপ্তমনস্ক বলছেন, সেটা আসলে মনকে চোখ ঠারছেন। আমার যে একটা রুচিবোধ থাকতে পারে, আমি যে একজন আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন নারী – সেটা আপনি মনেই করেন না।
তুমি বুঝতে চাইছ না।
অনেকটা বোঝাতে পেরেছেন অরুণদা। একটা নারীকে কখনোই পুরোপুরি মানুষ বলে গণ্য করেন না আপনি। নারীর কোনও ব্যক্তিত্ব, রুচিবোধ, সম্ভ্রমবোধ থাকতে পারে, এটা আপনার ভাবনায় আসে না।
তা হলে তুমি দুটো অনাত্মীয় পুরুষের সাথে রাত কাটিয়ে ঠিক কাজ করেছ?
পথে আসুন অরুণ দা, আপনি ধরা পড়ে গিয়েছেন।
ধরা পড়ে গিয়েছি মানে? কি বলতে চাও ?
বলতে চাই যে একটা মেয়ের পক্ষে অচেনা পুরুষের সাথে রাত কাটানো আপনার কাছে কোনও ব্যাপার নয় , যতো দোষ আত্মীয়তা না থাকলে। আত্মীয় বলতে আপনি কি বোঝেন অরুণ দা?
অরুণকে চুপ করে থাকতে দেখে দীপ্ত দুটো চোখ মেলে তাকায় শ্যামলী।
দু দিন বাদে আপনার আদরের শ্যালিকাটির বিয়ে দেবেন তাইতো অরুণ দা? তার পর আপনার ভায়রাভাই ফুলশয্যার দিনে আপনার শ্যালিকাটির শরীর নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করবে। সে সুযোগ আপনার ভায়রাভাই কে দিতে আপনার আদরের শ্যালিকাটি দায়বদ্ধ। কেননা, বিয়ের ব্যবস্থার মাধ্যমে আপনার ভায়রাভাই ওই শরীর নিয়ে খেলার লিগ্যাল রাইট পেয়ে গিয়েছেন। মেয়ের সাথে পরিচয় যতো সামান্যই হোক না কেন বিয়ের ব্যবস্থার মাধ্যমে একজন ভারতীয় পুরুষ একটি নারীর সমস্ত অন্ধি সন্ধি ছুঁয়ে ছেনে জেনে নিতে পারে। বিয়ের ব্যবস্থা অপরিচিত পুরুষকে এই স্যাঙশন দেয়। মি লর্ড , অ্যাম আই রাইট ?
মেয়ে বলতে আপনারা শুধু একটা কামনার যন্ত্র বোঝেন। আ লিভিং সেক্স টয়। তার ব্যক্তি স্বাধীনতা, সম্ভ্রমবোধ, সব অলীক আপনাদের কাছে।

৪৬

বাবা, মাকে তোমার সমস্ত পরিস্থিতি খুলে বলা উচিত।
তুই তো জানিস, তোর মাকে। সে শুনবে আর কাঁদবে। তাকে কাঁদাতে বলছিস?
কিন্তু তুমি যে ভেতরে ভেতরে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছ।
আমার ওষুধটা এগিয়ে দে তো শ্যামলী।
হ্যাঁ, এই যে দিই। কিন্তু তোমার সামনে আমি মাকে বুঝিয়ে বলি।
যা ভাল বুঝিস কর।
বাবা, ঝড় একটা পাকিয়ে উঠছে। মাকে আর শান্তনু অতনুকে সব খুলে বলা দরকার। মায়ের আলমারি ঘেঁটে যে কটা টাকা পেয়েছি , তাতে ক’দিন চলে যাবে। কিন্তু কারখানার ইলেকট্রিক বিল আসবে , ফোনের বিল আসবে , মাস পয়লায় বাড়ির কাজের লোকেদের মাইনে দিতে হবে।
আমি আর ভাবতে পারছি না। তুই কেন নিজেকে জড়াতে গেলি মা? কই তনুশ্রী তো নিজেকে জড়ায় না?
বাবা, এক একজন এক এক রকম হয়। ব্যাংক থেকে লোন শোধ করার তাগাদা দিয়েছে বলেছিলে। সে কাগজ কোথায় ?
অফিসের ফাইলে থাকার কথা। তুই তো সব তালা চাবি দিয়ে এসেছিস। কি পাকামো করলি বল তো ?
তুমি বললে সব চুরি হয়ে যাচ্ছে , ঠেকাতে পারছ না। তাই আমি যা জানি করে দিয়েছি।
হ্যাঁ , এবার সবাই তোমার পিণ্ডি চটকাবে।
আমি চটকাতে দিলে তো , তুমি একটু মন শক্ত করো বাবা। তার পর দ্যাখো আমি কি করি।
হ্যাঁ , লেখাপড়া ছেড়ে ওই নিয়ে পড়ে থাকো। তুই এবার আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যা শুয়ে পড়।
আলো টা নিভিয়ে মেয়ে বলে “ বাবা , এখন আমি যাচ্ছি। কিন্তু আমাকে আমার কাজটা করতে দিয়ো। হাত পা গুটিয়ে ডুবতে বোলো না বাবা ; যে করে হোক লড়তে দাও।“
আচ্ছা, অনেক হয়েছে। এবার যা। কেবল পাকা পাকা কথা।
আসি বাবা, বলে বাবার কপালে একটা চুমো খেতে গিয়ে শ্যামলী টের পেল বাবার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। তার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।

৪৭

ভোর বেলা ঘুম ভেঙে গেল শ্যামলীর।
বাবা জপে বসেছেন। মা বাবার কাছে।
শ্যামলী অঙ্ক নিয়ে বসল। পড়াশুনা মার খেতে দিলে চলবে না। জপ শেষ হলে বাবা তাকে ডাকল।
তোর মা কে কি বলবি বলছিলি।
হ্যাঁ মা, মন শক্ত করে শোনো। বাবার কারবারে অনেক টাকা লোকসান চলছে। প্রচুর চুরি হয়েছে। ঠেকাতে পারে নি। এখন আমাদের কঠিন ব্যবস্থা নিতে হবে।
কি করবি বল, ঠাকুর যা চাইবে তাই হবে।
ঠাকুর কিন্তু তোমার আমার হাত দিয়ে কাজ করে। ব্যাংক তাদের টাকা শোধ করতে বলেছে। কিন্তু বাবার হাতে টাকা নেই। চুরি আটকাতে আমি কারখানায় তালা দিয়েছি। তালা ভেঙ্গে কিছু করতে ওরা ভয় পাবে।
অশান্তিকে আমি ভয় করি। এখন কি করবি বল?
সবাইকে নিয়ে বোসো। সবাই মিলে বলুক কি করে কি হবে।
তুই কি বলছিস, সেটা বল না?
ব্যাংকের লোনটা নিয়ে কথা বোলো ম্যানেজারের সাথে। রিস্ট্রাকচার করাও। তোমাদের কি কোনও জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে টাকা আছে?
বাবা মা মুখ চাওয়া চাওয়ি করেন।
কোনও ফিক্সড ডিপোজিট ?
বিরক্ত খসখসে গলায় বাবা বলেন – ও টাকায় হাত দেওয়া যাবে না। তোর বিয়ের জন্যে রাখা আছে।
কতো আছে?
বলছি তো , ও টাকায় হাত দেওয়া যাবে না।
শ্যামলী নিজের মনে একবার হাসল। বাবা মা জানে না নকুড় নন্দী মশায় তাঁর “পরম শ্রদ্ধেয় গুরুভ্রাতা” কে কি পত্র দিয়েছেন।
বাবা তুমি খুব ভাল করে জান ঋণের শেষ রাখতে নেই। ঋণ বেড়ে চলে। আমি বলছি, যতটা পারো, শোধ করে দাও।
তার পর?
কারখানায় যে শ্রমিকরা থাকতে চায়, তাদের শর্ত দেব , গাড়ি সারিয়ে যারা টাকা দেয় নি, ঘুরে ঘুরে সে টাকা উদ্ধার করো। টাকা তুলে কারখানা চালাবার খরচ যোগাড় করো।
তার পর?
বাড়িতে কাজের লোক কমাও। দিনকাল খারাপ। এত বোঝা টানবে কি করে?
কে দেখবে সংসারের কাজ ?
আমাদের বাড়ির কাজ আমরা করবো। ধরো আমি করবো।
মা বলল অসম্ভব। ঠাকুর পুজোর এত যোগাড় যন্ত্র, সবিতা ছাড়া অসম্ভব।
না, সবিতা পিসি থাকুক।
শশাঙ্ক পাল একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস আড়াল করতে চেয়ে পেরে উঠলেন না।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।