শ্যামলী মা ও পিসির সাথে খেতে বসবে। শশাঙ্ক পালকে সবিতা তাগাদা দিল, যাও দাদা, তুমি ওপর ঘরে গিয়ে শোও গে। একটু পরে আমি গিয়ে মশারি টাঙিয়ে দেব।
শশাঙ্ক বললেন, না আর একটু বসি। তোরা কি খেলি, কতটুকু খেলি দেখব।
সবিতা বলল, দাদা, এখন যাও দেখি, মেয়েমানুষের খাওয়া তোমাকে দেখতে হবে না। তোমার সামনে হাঁড়ি চেঁছে পুঁছে খেতে আমার লজ্জা করবে না?
অন্যদিন শ্যামলী টেবিল চেয়ারে বসে খাওয়ার সপক্ষে জোরদার সওয়াল করে। আজ সে মা ও পিসির কাছে বসে খাবে। বাসন্তীবালা স্বামীকে বললেন, যাও, কিন্তু শোয়ার আগে ওষুধটা খেতে ভুলো না।
শশাঙ্ক পাল যেতে গিয়েও ফিরে এসে বললেন, ওরে শ্যামলিমা, কাল নকুড়দাদার শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান। আমাদের সবার নেমন্তন্ন। তবে, তোকে বৌদি খুব সকাল সকাল পৌঁছে যেতে বলেছেন।
বাসন্তীবালা বললেন, ওরে শ্যামলিমা, রমা তোকে বিকেলে ফোন করেছিল রে। সাত ঝামেলায় বলতেই ভুলে গিয়েছি। রমাকে দেব বলে জামা প্যান্টের পিস আনিয়ে রেখেছি। দেখে রাখিস।
শ্যামলী বলল, বাবা, জামা প্যান্টের পিস? রমানাথ বাবুর জন্য? কেন?
শশাঙ্ক বললেন, ওসব তোর মায়ের ডিপার্টমেন্ট। আমার কাছে টাকা চেয়েছিল, আমি দিয়ে দিয়েছি। রমা কাল সকালে তোকে নিয়ে যেতে গাড়ি পাঠাবে।
বাসন্তীবালা বললেন, তুই যেন আজ আবার শখ করে রাত জাগিস না। আজ আবার পড়ার বাহানা করে রাত জাগলে কাল তোমাকে দেখতে ভাল লাগবে না।
শ্যামলী বলল, বাবা, আমি যে নকুড়বাবুর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে যাব, এটা কি করে জানা গেল?
সবিতা বললেন, এ কি রে, এ যে সাত কাণ্ড রামায়ণ পড়ে প্রশ্ন করলি, সীতা কার বাপ!
শ্যামলী বলল, বাবা, ওই প্রয়াত ভদ্রলোক রমানাথের বাবা, আর রমানাথ বাড়ি বয়ে নিমন্ত্রণ করে যেতে বলে গিয়েছিলেন, সব আমি মেনে নিচ্ছি, কিন্তু আমি যে যাবই, এ তো আমি কাউকে প্রতিশ্রুতি দিই নি।
বাসন্তীবালা বললেন, সে কি রে, দিদি আশা করে আছেন, ঘরের মেয়ের মতো তুই গিয়ে ওবাড়ির সব সামলে দিবি, আর তুই যদি এখন গোঁ ধরিস্ যে যাবি না, তাহলে তো আমাদের মুখে চুনকালি পড়বে।
শ্যামলী বলল, বাবা, আমি একটা মানুষ। আমি জানি রমানাথ আমাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনের মতো। আমাদের পরিবারকে তিনি নিজে এসে নিমন্ত্রণ করে গিয়েছেন। কিন্তু আমি মানুষটা এইরকম অনুষ্ঠানে যেতে ইচ্ছুক কি না, সেটাও তো ভাবা দরকার। আমাকে তাঁর মা যেতে বলেছেন বলেই আমাকে যেতে হবে, তার তো কোনো মানে নেই! আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা বলে একটা ব্যাপার তো থাকতে পারে!
শশাঙ্ক পাল বললেন, দ্যাখ, রমানাথ তোকে খুবই পছন্দ করে। আমরাও রমানাথকে খুব পছন্দ করি। তাই আমি বলেই ফেলেছি, চিন্তা কোরোনা রমা, শ্যামলী ঠিক সকালে পৌঁছে যাবে।
শ্যামলী বলল, এ এক অদ্ভুত ব্যাপার দেখছি। রমানাথ বাবু আমায় পছন্দ করতেই পারেন। আমাকে নানা কারণে অনেকেই পছন্দ করেন। কিন্তু যে আমি মানুষটা নাস্তিক, পরলোকে অবিশ্বাস করি, মৃত্যুর পর মানুষের কোনো কিছু থাকে বলে বিশ্বাস করি না, আর এভাবে পুরুত ডেকে সংস্কৃত ভাষায় কখানা কথা বলে লোক খাওয়ালে, একটা মৃত লোকের প্রতি কোনো কর্তব্য করা হয় বলেই যে বিশ্বাস করে না, তাকে নিয়ে এত টানা হ্যাঁচড়া কেন বলতে পারো?
সবিতা বললেন, ও মা, তোর পেটে পেটে এত? এই যে রমা এলে হেসে হেসে কথা বলিস, চা করে খাওয়াস, নিজের হাতে লুচি তরকারি বানিয়ে খাওয়াস, সে সব ভড়ং? ভড়কিবাজি? ফক্কিকারী কারবার?
শশাঙ্ক পাল বললেন, সবিতা, তুই চুপ কর। তার পর মেয়েকে তিনি বললেন, শোন্ মা, বিপদ আপদ সব বাড়িতে আছে। তুই মনে করে দ্যাখ, দায় বিপদে আপনার জনকেই মানুষের মনে পড়ে।
বাসন্তীবালা বললেন, দ্যাখ শ্যামলিমা, তোর বাবার যখন শরীর খারাপ হয়ে হাসপাতালে দিতে হবে, তখন তুই বন্ধুদের কাছে পেতে চেয়ে অরিন্দম আর প্রবালকে ডেকেছিলি, তাই না?
শ্যামলী বলল, হ্যাঁ মা, এক হোটেলে রাত কাটিয়েছি বলে আমার খুব সুখ্যাতিও হয়েছিল।
শশাঙ্ক পাল বললেন, ছি মা, ও কথা মনে রাখতে নেই। লোকে যদি অবিচার করে, তুইও কি অবিচার করবি?
শ্যামলী কাতর হয়ে বলল, বাবা, আমি যে পরলোকে আস্থা রাখি না। এই শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে গেলে আমার নিজের কাছে নিজে খেলো হয়ে যাব না?
সবিতা বলল, অ, তার মানে তোর নিজের গোঁয়ার্তুমিটাই সবচাইতে বড়। আর একটা লোকের মিনতির কোনো দাম তোর কাছে নেই?
শ্যামলী বলল, ও, আমার চিন্তা ভাবনা সবকিছু তোমাদের কাছে গোঁয়ার্তুমি! আমি যে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করি না, পরলোক বলে কোনো কিছু আছে বলে ভাবি না, আপনজনের মৃত্যুর পর লোক খাওয়ানোর ব্যাপারটাকে ফালতু হাঙ্গামা বলে মনে করি, এসব তোমাদের কাছে নিছক অন্ধ গোঁয়ার্তুমি? একবগ্গা জেদ?
সবিতা বলল, হ্যাঁ। তোকে যে কাছ থেকে দেখবে, সেই বুঝতে পারবে ভেতরে তোর জিলিপির প্যাঁচ। সর্বদা কি করে অন্যের মাথাটা নিচু করে দেব, সেই মতলব ভেঁজে চলেছিস।
শ্যামলী আর সহ্য করতে পারল না, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, পিসি, আর যে যাই বলুক, তুমি অন্ততঃ আমায় মতলববাজ বোলো না।
ক্রমশ…