• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১২১)

পর্ব – ১২১

বেলা দশটার দিকে হেডমিস্ত্রি এল। বগলে ক‍্যাশব‌ই। নিচ থেকে হাঁক দিল, ছোড়দি, উপরে আসব?
তার গলা পেয়ে ম‍্যাকসির উপর অ্যাপ্রনটা পরে নিল শ‍্যামলী। তারপর বলল, বাবার ঘরে আসুন। শ‍্যামলীর সামনে ক‍্যাশব‌ই মেলে ধরল হেডমিস্ত্রি। বলল, গতকাল দুটোর সময় কারখানা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। চোখের ইঙ্গিতে শশাঙ্ক পালকে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিল, বড়বাবুর নির্দেশে। শ‍্যামলী বলল, ঠিক আছে।
হেডমিস্ত্রি বলল, আজ আর কারখানা খুলিনি।
শ‍্যামলী খাতায় চোখ বোলাতে বোলাতে বলল, হুঁ।
হেডমিস্ত্রি বলল, আজকের দিনটা ভালয় ভালয় কেটে গেলে, কাল কারখানা খুলব?
শশাঙ্ক পাল বললেন, যতদিন না অন্ত‍্যেষ্টি হচ্ছে ততদিন বন্ধ থাকুক । এখনো তো দেহ রাখা আছে।
শ‍্যামলী বলল, কাল সকালে একবার ঘুরে যাবেন। আমি খোঁজ খবর নিয়ে বলে দেব।
শশাঙ্ক পাল বললেন, কেন ঝামেলায় যাচ্ছিস শ‍্যামলিমা? ইন্দিরাজির দেহ যদ্দিন রাখা আছে, তদ্দিন কখন কি হয়, বলা যায় না।
শ‍্যামলী বলল, আচ্ছা, খোঁজখবর নিয়ে বলে দেব’খন।
হেডমিস্ত্রি শ‍্যামলীর হাতে টাকার ব‍্যাগ তুলে দিতে গেল। বলল, টাকা গোণা আছে।
শ‍্যামলী বলল, তবু আমার সামনে একবার গুণে দিন।
শশাঙ্ক পাল বললেন, দেখি ক‍্যাশব‌ইটা একবার।
শ‍্যামলী হেডমিস্ত্রিকে বলল, আপনি এখন আসুন। কাল সকালে ক‍্যাশব‌ইটা নিয়ে যাবেন।
হেডমিস্ত্রি বলল, একটু জল খাব।
এবাড়িতে সে যে ক’বার এসেছে পরিষ্কার কাচের গ্লাসে জলের সাথে সর্বদা দুটি সন্দেশ পেয়েছে।
আজ কেউ সন্দেশ আর জল দিল না দেখে সে একটু অবাক। তাই জল খেতে চাইল।
শ‍্যামলী তার মনের কথা মুহূর্তে পড়ে নিয়ে  বলল, নিচে পিসি আছে। ওর কাছে গিয়ে জল খেয়ে নিন। মিস্ত্রি মশায় মণ্ডা মিঠাই বোধহয় জুটবে না। আজ বাতাসায় সন্তুষ্ট হতে হবে। ইন্দিরাজির মৃত‍্যুতে রাষ্ট্রীয় অশৌচ চলছে।
হেডমিস্ত্রি চলে যেতে শশাঙ্ক পাল বললেন, এবাড়িতে লোকজন জল খেতে চাইলে সন্দেশ দেওয়া গেল না, এমন কখনো হয়নি।
বাবার চোখে চোখ রেখে শ‍্যামলী বলল, দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী খুন হয়েছে বলে কলকাতায় পঞ্জাবি মানুষ গুরুদ্বারে আশ্রয় নিয়েছে, এমনটাও আগে কখনও হয়নি।
শ‍্যামলী বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। শশাঙ্ক পাল ক‍্যাশব‌ই এর এন্ট্রিগুলো দেখতে থাকেন। বললেন, বেশ ভাল ব‍্যবস্থা করেছিস তো।
শ‍্যামলী বলল, শিখিয়ে নিতে হয়েছে বাবা। ক্লাস ফোরের বেশি পড়েন নি। কিন্তু হাতের লেখাটা ভাল। তাই ওকেই শিখিয়ে দিয়ে ছিলাম।
শশাঙ্ক পাল বললেন, তুই শিখলি কি করে?
শ‍্যামলী বলল, কমার্সের ব‌ই দুদিন উলটে পালটে দেখে নিয়েছি।
 শশাঙ্ক পাল মেয়ের দিকে তাকান। শিক্ষকের ভঙ্গিতে শ‍্যামলী বলে, বাবা নগদ টাকা, বা চেক যাই কারবার পাবে, সঙ্গে সঙ্গে ক‍্যাশব‌ইয়ের ডেবিট দিকে ঢুকবে। আর নগদ টাকা বা চেক যা পেমেন্ট হবে, সব ক্রেডিট দিকে যাবে। যেদিনকার ব‍্যাপার, সেদিনই লিখতে হবে। তাই ক‍্যাশব‌ই জার্ণাল। জার্ণাল মানে দৈনিক। রোজ দিনের শেষে দেখে নাও বাক্সের টাকার অ্যামাউণ্টের সাথে খাতার অ্যামাউণ্ট মিলছে কিনা। না মিললে দ‍্যাখো কোন্ খরচটা খাতায় ওঠে নি, বা কোন্ এন্ট্রিটা বাকি থেকে গিয়েছে। ক‍্যাশ ইন হ‍্যাণ্ড মানে তোমার বাক্সে যে টাকা আছে। আর ব‍্যাঙ্কে যা রেখেছো, সেটা হল ক‍্যাশ অ্যাট ব‍্যাঙ্ক। মাঝে মাঝে ব‍্যাঙ্কের পাশব‌ই দেখে সেটা আবার মিলিয়ে নিতে হয়।
শশাঙ্ক পাল বললেন, হ‍্যাঁ, ব‍্যাঙ্ক চার্জ কাটে।
শ‍্যামলী বলল, যে টাকা বাক্সে আছে, তা তোমার টাকা নয়। কারবারের।
খসখসে গলায় শশাঙ্ক পাল বললেন, হ‍্যাঁ, জানি জানি।
শ‍্যামলী বলল, বাবা দেখেছ, তিনটে গাড়ি সারানো বাবদে টেন পার্সেন্ট করে ডিসকাউন্ট দিয়েছে। খেয়াল করছ?
শশাঙ্ক পাল বললেন, হ‍্যাঁ, তাইতো দেখছি। কিন্তু ডিসকাউন্ট কেন?
শ‍্যামলী বলল, রামনারায়ণবাবুর সাথে আমার কথা হয়েছে তিনি যদি গাড়ি সারাই করতে পাঠান, তাহলে স্পেশাল ডিসকাউন্ট দেব। গতকাল উনি তিনটে গাড়ি পাঠিয়েছেন।
শশাঙ্ক বললেন, রামনারায়ণকে মার্কেট রেটের থেকে কম দিয়ে তোর লাভ কি হচ্ছে?
শ‍্যামলী বলল, বাবা, কাজ বেশি করতে পারলে মজুররা পয়সা পায় বাবা। পার্টস বিক্রি হয়। তেল মোবিল গ্রীজের একটা বিক্রি হয়। এই সব থেকে কারবারের একটু একটু করে লাভ আসে। ডেলি সেল বাড়লে টার্ন‌ওভার বাড়ে।
শশাঙ্ক বললেন, রামের সাথে তোর এ রকম কথা হয়েছে?
শ‍্যামলী বলল, হ‍্যাঁ বাবা। জেন্টলম‍্যানস এগ্রিমেন্ট। এতে কি হল জানো, ওর লোকেরা আমার কারখানায় আর মাস্তানি করে যাবে না, গুণ্ডামি করতে আসবে না।
শশাঙ্ক পাল বললেন, বেশ তো। এ কায়দাটা তুই শিখলি কোথায়?
মেয়ে বলল, সম্রাট অশোকের কাছে। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ধর্মবিজয়। ওই বিষয়ে ইন্দিরা গান্ধী ডাহা ফেল বাবা। উনি স্বর্ণমন্দিরে মিলিটারি পাঠিয়ে শিখ সম্প্রদায়ের ঘৃণা কুড়িয়েছেন। শিখ গণহত্যার আয়োজন করে কংগ্রেসীরা আরো ধিক্কার কুড়োচ্ছে।
শশাঙ্ক পাল বললেন, তুই পলিটিক্সের এত কথা শিখলি কোথায়?
শ‍্যামলী বলল, তোমার কাছে বাবা। দাদা যখন আমার গায়ে হাত তোলে, আর চুপ করে তুমি যখন তা দ‍্যাখো, তখন আমি বুঝতে পারি, আমি তোমার সংসারে ধানের তূষের মতো। সুবিধা পেলেই লাথি মেরে আমায় দূর করে দেওয়া হবে।
শশাঙ্ক পাল কি বলবেন ভেবে পান না। শ‍্যামলী হাসতে হাসতে বলে, দেশটা স্বাধীন, আদালত‌ও সাজানো গোছানো আছে। গরিবি হঠাও বলে নৌটঙ্কির আয়োজন আছে। কিন্তু এই যে নির্বিচারে শিখ গণহত্যা হচ্ছে, এর সুবিচার করতে ভারতীয় গণতন্ত্রের দশকের পর দশক ফুরিয়ে যাবে। আমার গায়ে হাত তুললেও তোমার কাছে সুবিচার মিলবে না বাবা।
এমন সময় নিচ থেকে বাসন্তীবালা ডাকলেন, শ‍্যামলিমা, রান্না করবি বলেছিলি, বেলা যে বয়ে যাচ্ছে রে!
শ‍্যামলী হাতের তালুতে চোখ মুছে বলল, যাই মা।

 

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।