দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১০৪)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ১০৪
শ্যামলী দেখল বাবা খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। মা খেতে বসেন নি। সবিতাপিসির সাথে বসবেন। মা বাবাকে বললেন, কি হচ্ছেটা কি! খেয়ে নাও। বাবা মায়ের কথায় কান দিলেন না।
শ্যামলী বাবাকে বলল, আমায় যখন থানায় পুলিশ অফিসার হাজতখানায় ওদের দেখালেন, আমারও তখন খুব খারাপ লেগেছিল বাবা।
সবিতা বলল, তোকে যখন থানা থেকে ডেকে বলল, তখনই তুই সামলে সুমলে ওদের ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে পারতিস। দাদাকে কিছু না বললেও চলত। তাহলে দাদা আর এতটা কষ্ট পেত না।
বাবা, তোমরা ব্যাপারটাকে কিভাবে নিচ্ছ জানি না, আমার সঙ্গে যেন ওদের একটা ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে। মা যখন বলেছিল, ঠাকুরের তোশকের নিচে পুজোর হাতখরচ রেখেছিল, অথচ টাকাটা দেখতে পাচ্ছে না, তখন আমি আন্দাজ করেছিলাম টাকাটা কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ সরিয়েছে। মাকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম মা, তুমি কি আমায় সন্দেহ করছ? মা বলল, না। আমার তখন মনে হল, মা জানে, মায়ের পুজোর খরচের টাকাক’টা কে নিতে পারে।
বাসন্তীবালা বললেন, কদিন আগে থেকেই বলছিল, এবার পুজোয় কলকাতা গিয়ে হোলনাইট ঠাকুর দেখবে। আমি ভেবেছিলাম, তা দেখুক গে, কতদিন আনন্দ ফূর্তি করে না ওরা।
শশাঙ্ক পাল বললেন, হ্যাঁ শখ। বাবা পড়ে আছে অসুস্থ হয়ে। বোনটা লেখাপড়া বাদ দিয়ে কারখানায় লেবারদের সাথে সমানে খাটছে। আর তুমি ভাবছ ছেলেগুলোর ফূর্তি করা হচ্ছে না।
বাসন্তীবালা বললেন, অ, এই তোমরা বাপ বেটিতে শলাপরামর্শ করছ। সব দোষ তা হলে আমার?
শশাঙ্ক বললেন, সেদিন উকিল বাড়ির অনসূয়া মেয়েটা এসে বলে না গেলে জানতেই পারতাম না, শান্তু আর ফুটবল মাঠে যায়না, এখানে ওখানে গুণ্ডামি করে বেড়ায়। সেদিন তনুর বাড়িতে গিয়ে ব্যাগ থেকে টাকা চুরি করে মদ খেয়েছে শুনে অরুণ যদি পুলিশে ধরিয়ে দিত, তাহলেই ভাল হত। খারাপ পাড়ায় গেছে, জুয়ো খেলেছে, এসব শুনতে হত না।
শ্যামলী বলল, বাবা যেটুকু ইচ্ছা হয়, খেয়ে নাও। শশাঙ্ক পাল রেগে গিয়ে বললেন, বলছি আমার কিছু ভাল লাগছে না। আমি ভাবতেই পারছিনা কেন কি করে এতদূর অধঃপাতে চলে গেল।
শ্যামলী বলল, বাবা শোনো। তুমি কি ভাবতে পেরেছিলে বীরুবাবু, না বাবা, ওই লোকটাকে আর কাকা বলতে পারব না, বীরুবাবু এভাবে তোমার কারখানাটাকে ডোবাবার চেষ্টা করবে? তুমি কি ভাবতে পেরেছিলে, তোমার গুরুদেব, যাকে তোমরা ভগবানের অবতার মনে করতে, তাকে পুলিশ নারীধর্ষণের অভিযোগে ধরবে? ভাবতে পার নি। তাই তো? বাবা, তুমি জ্ঞানী হতে পার, অভিজ্ঞও হতে পার, তবু তুমি সব কিছু আগাম জানতে পার না। কি করলে তুমি জানতে নয়, অন্ততঃ আন্দাজ করতে পারতে? খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলে। বিশ্লেষণ করে করে চিরে চিরে ভাবলে।
শশাঙ্ক পাল মাথাটা নিচু করে চুপচাপ খাওয়া শুরু করেন।
বাবা, আমি তোমার ধর্মের বিরোধিতা করছি না। কিন্তু ধর্ম জিনিসটা কি? না, ধর্ম হল করণীয় কাজ। যঃ ধ্রিয়তে সঃ ধর্ম। জলের ধর্ম মানে হল জলটার কোনো রঙ থাকবেনা, গন্ধ থাকবেনা, যে বাটিতে বা গ্লাসে রাখবে তার মতো হয়ে থাকবে। এই হল জলের ধর্ম। তোমার ধর্ম ছিল কারবার ঠিক মতো চালানো, মজুরকে ন্যায্য মজুরি দেওয়া, ব্যাঙ্কে দেনা ফেলে না রাখা, আর কাজ করে পয়সা ঠিক ঠিক আদায় করা। তা তুমি করো নি। নিজের ঘরের লোকদের খুশিতে রাখার জন্য কারবার থেকে মুঠো মুঠো টাকা তুলে এনেছো, আর তোমার বিশ্বাসী মিস্ত্রিগুলো তোমার কারবারের রকমসকম দেখে একে একে সরে গেছে।
এই ফাঁকা জায়গাটায় ঢুকে পড়েছে বীরু বাবু। তোমাকে ধর্মের নেশায় ঢুকিয়ে দিয়ে অমন কারবারকে কোন্ অতলে ঠেলে দিয়েছিল, সেটা তুমি ভুলে যেয়ো না বাবা। তুমি ভাবছ মদ কেবল বোতলে থাকে? ভুল ভাবছ। মদ অনেক রকম। তুমিও ধর্ম ধর্ম করে এক রকম নেশা করতে বাবা। আজ সবকিছু তোমার হাতের বাইরে।
এমন সময় দরজায় এসে দাঁড়াল অতনু। মুখটা বিশ্রী রকম ফুলে গিয়েছে। বলল, তোমরা এত চ্যাঁচাচ্ছ কেন, আমি ঘুমাতে পারছি না।
সবিতা শশাঙ্কের দিকে কাঁদো কাঁদো মুখে তাকিয়ে বলল, দাদা দোহাই তোমার। ছেলেটার অবস্থা দ্যাখো। এখন চুপ করো।
অতনু কোনো মতে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, পিসি, জল দে, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেছে।
আহা, বাছা আমার, এই তোমায় জল দিই, বলে সবিতা তাকে ধরে একটা চেয়ারে বসাতে যেতেই টের পেল অতনুর গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সে বলল, ও দাদা, ছেলের গা যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। ডাক্তার ডাকো।
তিক্ত কণ্ঠে অতনুর দিকে চেয়ে শশাঙ্ক বললেন, এখনই তোকে লাথি মেরে দূর করে দেব শুয়ার। জ্বর হয়েছে! বেশ্যাবাড়ি গিয়ে জুয়ো খেলার আগে জ্বর আসে নি? জুতিয়ে তোমার মুখ ছিঁড়ে দেব।
বাসন্তীবালা ককিয়ে উঠে বললেন, কী হল তোমার? চোখ যে তোমার ঠেলে বেরিয়ে আসছে, শ্যামলিমা তোর বাবাকে ধর্।
বলতে বলতেই শশাঙ্ক পাল ঢলে পড়ছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে শ্যামলিমা বাবাকে জাপটে ধরে মেঝেতে আস্তে আস্তে শুইয়ে দিল। তারপর জল হাতে নিয়ে মুখটা মুছিয়ে দিতে থাকল। সবিতাকে বলল, অতনুর গায়ের জামা খুলে মাথা ধুইয়ে দাও। জ্বর ছেড়ে যাবে।