ছোটদের জন্যে বড়দের লেখায় ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

গোয়েন্দা পুপুলও ভুল করে
-আবার আমার ফোন নিয়ে খুটখাট করছিস?
– দাঁড়াও না মা। প্লিজ। আই বেগ অফ ইউ মা। একটা ভিডিও দেখছিলাম ওয়ার্ল্ডকাপের। লাস্ট গোলটা। যেটা দিয়ে ফ্রান্স জিতে গেল এবার।
– দে এবার আমার ফোন। যা, এবার পড়তে বস। আর সময় নষ্ট করিস না।
– না, মা টু মিনিটস মোর ।
– এই স্মার্ট ফোন এক সব্বোনাশা নেশা হয়েছে পুপুলের।
– তবু তো আমার নিজের ফোন নেই। স্কুলের বন্ধুদের সব নিজের ফোন জানো? তুমি তো কিনে দেবে না বলেছ।
মা বললেন, ফোন কিনে দিলে আর দেখতে হবে না।
– জানো মা? সেবার সেই ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ গেমসের ঘটনার পর নিমোর বাবা ওর ফোন নিয়ে নিয়েছে। আর দেয়নি। নিমোর খুব দুঃখ তাই।
নিমো পুপুলের বেষ্ট ফ্রেণ্ড।
মা বলেন, কত ছেলেপুলের কত ক্ষতি হয়ে গেল বল্ তো! ঢপের চপ চ্যালেঞ্জ নেওয়ার খেলার ফাঁদে পা দিয়ে সুস্থ ছেলেপুলের কি বিপত্তি ! যেন নিশির ডাক শুনেছে সব। কি নেশা রে! আর তাদের বাবা মায়েদের কি অবস্থা বল তো! ছেলেমেয়েদের ফোন কিনে দিয়ে ছেলেমেয়েকে হারাতে হল। ভাবা যায়? কত জন্মের মহাপাপ করলে এমন ঘটনা ঘটে।
কিন্তু মা আমাকে তুমি একটা স্মার্ট ফোন কিনে দিলে আমি তোমাকে ছেড়ে কোত্থাও যাব না। আই প্রমিস।
– ঠিক আছে আগে বোর্ডের প্রথম পরীক্ষাটা পেরোয় ভাল রেজাল্ট করে। অনেক দেরী এখন নিজের ফোন হতে। তারপর আমি নতুন ফোন কিনে দেব। তার আগে নয়।
মা, জানো? শালিনী বলছিল কি একটা দারুণ গেম ডাউনলোড করেছে।
– আচ্ছা বেশ। এবার ফোন আর গেম প্রসঙ্গ থাক। পড়ার কথা বল। আজ সব অংক গুলো পেরেছিলি স্কুলে?
– তুমি না সব সময় শুধু পড়া আর পড়া। আচ্ছা মা, ঐ নীল তিমি মাছ ফোনের মধ্যে ঢুকে কি করে খেয়ে ফেলে বাচ্ছাদের?
– ওরে বাবা! এ দেখছি সেই এক কথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি এসব জানিনা রে।
মায়ের ফোনে হোয়াটস্যাপে মেসেজ আসে টুং টাং করে। মা নিজের সামনেই কেবল পুপুল কে একটু আধটু ফোন দেখতে দেন।
পুপুল বলে, ছোটমাসীর মেসেজ। এই দেখ। আজ বিকেলে আসবে বলেছে। রান্না করতে মানা করেছে। মা বললেন, বেশ। সে নাহয় হোল। তাহলে পুপুল, পড়া করে নাও এখুনি।
মা, মাসী লিখেছে আজ চিকেন আর চিজ মোমো বানিয়ে আনবে।
মোমো? এই শব্দটা শুনেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে ওঠে পুপুলের মায়ের। গত কয়েক দিন ধরেই কাগজে পড়েছেন তিনি। মোমো নামে ব্লু হোয়েল গেমের মত একটা ভয়ংকর খেলা ঘুরছে আবার। মোমো একটা পাখীর নাম। চিনের পাখীর নামে চিনে অ্যাপ দিয়ে চ্যালেঞ্জ নেবার খেলায় মত্ত আজ টিন এজ । ভয়ঙ্কর দেখতে তাকে। ছবি দেখেছেন কাগজে। আর সেই গেম রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করেই নাকি মারা গেছে কার্সিয়াং এর একটি ইস্কুলের ছাত্র। কি করে মানুষ করবেন তিনি পুপুল কে। যতটা সম্ভব নিজের চোখে চোখে আগলে রাখেন। বন্ধুর মত মেশেন ছেলের সঙ্গে। কিন্তু ইস্কুলের ঐ ছ-সাত ঘন্টা? কত ধরণের ছেলেপুলেরা পড়ে সেখানে। তাদের অনেকের বাবা মা তাদের ছেলেপুলের হাতে এখনি দামী ফোন তুলে দিয়েছেন। ছেলেপুলেরা এইসময় লেখাপড়া, খেলাধুলো করবে, বই পড়বে, ছবি আঁকবে তা না এইসব ভয়ঙ্কর মারণ গেমের ফাঁদে পা দিচ্ছে আজকাল। সেই খেলায় একের পর এক চ্যালেঞ্জ নেওয়াটা তাদের নেশায় দাঁড়িয়েছে।
পুপুলের মায়ের মনে পড়ে যায় নিজের ছোটবেলাকার কথা। ইস্কুলে কে একবার রটিয়েছিল নিজের কপালে শুকনো গামছা দিয়ে একশো আটবার ঘষলে নাকি মা কালীর ছবি ফুটে উঠবে। আর সেই ঘষাঘষিতে কপালের চামড়া উঠে সে কি বিপত্তি কত মেয়ের! কচি কিশোরদের মন এক তাল মাটির মত। যা বোঝাবে তাই বুঝবে ওরা। সবাইকে সরল বিশ্বাসে মেনে নেয় ছোটরা।
মা ভাবতে থাকেন কেবলই। দুশিন্তার আর শেষ নেই তাঁর।
এই তো মাস ছয়েক আগের ঘটনা। ব্লু হোয়েলের ফাঁদে পড়ে ছাদের আলসের ওপর দিয়ে হাঁটল একটা ছেলে। আবার আরেকটা নিজের হাতে ব্লেড দিয়ে নীল তিমি আঁকতে গেল। কি যন্ত্রণাকর পরিস্থিতি! গেমের মোহে একের পর এক কঠিন থেকে কঠিনতর স্তর পেরিয়ে ছেলেপুলেরা ভাবছে আমি জিতেছি। আমি হিরো হয়েছি। আর সবশেষে মৃত্যু বরণ করিয়ে তবেই শান্তি এই গেম আবিষ্কারকদের। নিজের মন তোলপাড় হল পুপুলের মায়ের। ভাল লাগছে না কিচ্ছু। পুপুল কে পড়িয়ে নিতে হবে। বিকেলে তার মাসীরা আসবে আবার। হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নেন তিনি। মাসী আসবে। সন্ধ্যেবেলায় পড়া হবেনা। স্কুলের পড়াটা করে নাও পুপুল।
পুপুল ছোটমাসীরা আসবে বলে পড়ার ঘরে চলে যায়। হোমওয়ার্ক করে নিতে হবে মাসীরা আসার আগেই।
পুপুল কে অংক কষতে দিয়ে নিজের ফোন নিয়ে বসে পড়েন মা। পুপুল এক মনে অংক করছে। মা তার তুতো ভাইবোনেদের সঙ্গে, বন্ধুদের সঙ্গে হোয়াটস্যাপে টুকটাক মেসেজ করতে ব্যস্ত। টিভির চ্যানেল সার্ফিংয়ের মত একবার ফোনে ফেসবুক, একবার হোয়াটস্যাপ অথবা খবরের কাগজের অ্যাপ ঘোরাতে থাকেন। ও বাবা! আবারো একটা মোমো গেমে পা দিয়েছে এক স্কুলপড়ুয়া। কি জ্বালা হল! হোয়টস্যাপে নিজের প্রোফাইল বদল করতে যান এবার। স্ট্যেটাসে তিনি “ব্যস্ত’ লিখে রেখেছিলেন এতদিন। ও বাবা! এখন দেখছেন স্ট্যেটাসে লেখা “আই ওয়ান্ট টু প্লে মোমো’ মা তো জ্ঞানত স্টেট্যাস চেঞ্জ করেন নি কয়েকদিনের মধ্যে।
কে করল? তার মানে নিশ্চয়ই এটা পুপুলের কাজ। কি গোয়েন্দাগিরিতে সে মেতে উঠবে তা কে জানে?
এখুনি কাগজে পড়লেন, মৃত্যুর ইচ্ছা প্রকাশ করে হতাশ হয়ে হোয়াটস্যাপের স্ট্যেটাস দিয়েছিল জলপাইগুড়ির একটি মেয়ে। আর তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই তার হোয়াটস্যাপে হাজির স্বয়ং মারণ গেম মোমো। চিনের মারণ পাখীর ভয়ংকর ছবি হোয়াটস্যাপে।
আত্মহত্যার প্ররোচণা দেওয়া এই গেমটি সম্প্রতি ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। নাম ‘মোমো চ্যালেঞ্জ সুইসাইড গেম’। ইতিমধ্যেই বিদেশেও শিকার হয়েছে অনেক ছেলেমেয়ে। এই গেম নিয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। তবুও ভবি ভোলার নয়।