• Uncategorized
  • 0

ছোটগল্পে অমিতা মজুমদার

একটু উষ্ণতার জন্য

গত কয়েক বছরের তুলনায় এবারে শীতটা বড্ড বেশি পড়েছে। দিবাকরবাবু স্কুল থেকে এসেই হাঁক পাড়েন মিতুর মা তাড়াতাড়ি গরম জল দাও, এটা দিবাকর নিত্যকার অভ্যাসে বলে। কারণ মিতুর মা মানে সুহাসিনী দিবাকরের ফেরার সময় হিসেব করে এ কাজটা আগেই করে রাখতো । এমনটাই হয়ে আসছে বিগত বছর গুলোতে। কিন্তু এবারে শীতটা বেশি পড়ায় নাকি দিবাকরের বয়েস বেড়ে গেছে হিসেবে ভুল হয়ে যায়। গত শীতের মাঝামাঝি সময় সুহাসিনী বলা নেই কওয়া নেই বিনা নোটিশে চলে যায়। এবারের শীত যতোই বেশি হোক দিবাকরের একলা জীবনে গরম জল দেয়ার কেউ নেই এ কথাটা কেন যেন ভুলে যায় সে। মেয়েটা শ্বশুর বাড়ি। ছেলে তো সেই কবে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। অবশ্য ছেলের তাতে কোন দোষ নেই। সুহাসিনী চাইতো তার ছেলে বিদেশে গিয়ে বড় ডিগ্রী অর্জন করুক। ছেলে অর্ক বরাবরই লেখাপড়ায় ভালো। তায় সুহাসিনীর কড়া ও যত্নের খবরদারিতে দরিদ্র স্কুল মাষ্টারের ছেলে হয়েও বুয়েট থেকে ভালো ফলাফল করে অর্ক সুদূর আমেরিকায় উচ্চতর ডিগ্রী নিতে যায় মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে। কিন্তু সেই যে যায় আর দেশে আসেনা। সেখানেই সংসারী হয়েছে। নিয়ম করে টাকা পাঠায় মা-বাবাকে। আজকাল তো ভিডিও কলে কথা বলে।
এসব ভাবতে ভাবতে দিবাকর ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে। পোশাক ছেড়ে একটা লুংগি পরে গামছা নিয়ে কলতলায় যায়। সুহাসিনী প্রায় জোর করেই এই ডিপ টিউবওয়েলটা বসিয়েছিল রান্নাঘরের সাথে। যখন কাঠের কাঁচা ঘর ভেঙে এই পাকা দালান করে,তখন মটর পাম্প বসিয়ে রান্নাঘরে,খাবার ঘরে, স্নান ঘরে জলের লাইন লাগিয়ে নেয়।
আসলে সুহাসিনী শহরে বড় হয়েছে। দিবাকরকে ভালোবেসে বিয়ে করে এই গ্রামে যখন থাকতে শুরু করে ওর খুবই অসুবিধা হতো। যেহেতু দিবাকরের আর্থিক সামর্থ্য ছিলনা নাগরিক সুবিধা দেয়ার সুহাসিনী কখনো কোন অনুযোগ করেনি। ছেলে বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো শুরু করার পর সেই টাকা একটু একটু করে জমিয়ে ,বাড়ি পাকা করা,ঘরের মধ্যে বাথরুম করা সহ বাকী সংস্কার করিয়ে নেয়। অবশ্য ততোদিনে গ্রামে বিদ্যুৎ আসায় আরো সুবিধা হয়।
হাতমুখ ধুয়ে ঘরে এসে ইলেক্ট্রিক কেটলিতে চায়ের জল চাপিয়ে দেয়। চা বানানোটা ভালো করে রপ্ত করেছে দিবাকর। কারণ সুহাসিনীর এই একটা বিলাসিতা ছিল।সে নিজে চা বানিয়ে খেতে চাইতোনা,অথচ সকালবেলা চা না খেলে তার সারাদিন মাথা গরম থাকতো। অগত্যা দিবাকরকেই চা টা বানাতে হতো। ঘরের কাজে সাহায্যকারীর এই চা বানাতে পারার উপরই নির্ভর করতো সে স্থায়ী হবে কিনা।
এসব ভাবতে ভাবতে কাপে চা ঢেলে নেয় দিবাকর, সাথে একবাটি মুড়ি নেয়। আজকাল চিঁড়ে, মুড়ি, টোষ্ট এসব ঘরে রাখে সে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে মনে করে এই শীতের সময় প্রায়ই সুহাস সাজের পিঠা,পাটি সাপটা,পুলি পিঠা বানিয়ে রাখতো। স্কুল থেকে এলে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ সাথে প্লেটে পিঠা নিয়ে সামনে দাড়াতো।
একসময়ের সবার নজর কাড়া সুন্দরী সুহাস শেষের দিকে কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। তার চোখে মুখে সেই উজ্জ্বলতা ছিলনা। কিন্তু দিবাকর সেটা তেমন করে খেয়াল করেনি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কিরণবাবু,হায়দার সাহেব আর নিতাইবাবু এসে পড়েন,রোজকার আড্ডা বসে যায়। সুহাসের কথাও আর মনে থাকেনা দিবাকরের। কিন্তু নিতাইবাবু রোজকার মতো বলে ওঠে এই সময়ে বৌদির হাতের চা আর লুচি সন্দেশ খুব মিস করি। আস্তে আস্তে আড্ডা জমে ওঠে,তাতে উঠে আসে বাজারদর,রাজনীতি,আন্তর্জাতিক খবর থেকে হালের ডিজিটাল বিনোদনের খবর। আজ নিতাইবাবু বৌকে লুকিয়ে কি রকম একটা উত্তেজক ছবি দেখেছে। হায়দার সাহেব বলে উঠলেন কি আর বলি বলুনতো ছেলে একটা মোবাইল পাঠিয়েছে তাতে এমনসব ছবি আসে মাঝে মাঝে যা দেখতেও চাইনা আবার চোখ ফেরাতেও পারিনা। কিরণবাবু বলে ওঠে ওসবই বা দেখেন কেন ভায়া,কতো ভালো জিনিষ আছে সেসব দেখলেই তো পারেন।নিতাইবাবু ও হায়দার সাহেব একসাথে বলে ওঠেন আরে মশাই আপনি যাই বলুননা কেন বুকে হাত দিয়ে বলুনতো আপনার মন কি একটুও চঞ্চল হয়না ? পুরুষ মানুষ বলে কথা !
শীতের রাত তাই সকলে আড্ডা ভেঙে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। দিবাকর ও সকালে চিনুর মায়ের রান্না করা ভাত তরকারি ফ্রিজ থেকে বের করে অভেনে গরম করে নিয়ে খেতে বসে। সুহাস কি জানতো ? দিবাকরকে এসব করতে হবে ! তাই ফ্রিজ অভেন সবকিছু কিনেছে,তার ব্যাবহার দিবাকরকে শিখিয়েছে হাতে ধরে।
খাওয়া সেরে বিছানা করে শুয়ে পড়ে দিবাকর। কিছুক্ষণ রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা থেকে বিদায় অভিশাপ পড়ে,তারপর মাথার কাছের আলোটা নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।কিন্তু আজ তার ঘুম আসছেনা কিছুতেই। মনে হচ্ছে বিছানাটা খুব ঠান্ডা। এপাশে ওপাশের ফাঁকা জায়গাটায় আজ একটা শরীর খুঁজছে তারও শরীর।যার শরীরের উষ্ণতায় এই হিমবাহ গলে উষ্ণ প্রস্রবণ হয়ে ছড়িয়ে পড়বে।
দিবাকরের গাল বেঁয়ে ঈষদুষ্ণ নোনতা জলধারা ঠোঁটে এসে লাগে। আবেশে আবেগে পাশবালিশটাকে জড়িয়ে দিবাকর নিশুতি রাতে আর্তনাদ করে ওঠে- সুহাস তুমি আমাকে এভাবে একলা করে দিয়ে চলে গেলে !
দিবাকরের সেই আর্তনাদ একলাঘরের দেয়ালে বাঁধা পেয়ে প্রতিধ্বনি হয়ে দিবাকরের কাছে ফিরে এলো -গেলে —গেলে —গেলে—
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।