• Uncategorized
  • 0

ছোটগল্পে অভিজিৎ চৌধুরী

বিয়ে বাড়ি


গাড়িতে উঠতেই বৃষ্টির ঝাঁপ কমে গেলো । যতোখানি কাদা হবে ভাবা গেছিল, অতোটা নেই । তবে খুব সাবধানে যেতে হচ্ছিল ।
একটা নদী পড়লো ।
অশোক বললো – বাহ, বেশ সুন্দর দেখতে তো !
অভিষেকরা সামনের মারুতিতে চেপে চলেছে । এক দঙ্গল । খারাপ আবহাওয়ার তোয়াক্কা না করেই সবাই চলেছে বিয়ে বাড়ি ।
“বরযাত্রী”
অভিষেক গাড়ি থেকে চেঁচিয়ে বললো – দেবারতি ম্যাডাম, চাঁদ উঠেছে ।
অশোক আর তার বউ গাড়ির জানলা দিয়ে দেখলো । সত্যি সত্যি চাঁদ উঠেছে ।
দেবলীনা বললো – সত্যি খুব সুন্দর নদী । নামলে হয় !
অর্ক, কয়েকটা ছবি নিবি !
তখনই ড্রাইভার ষষ্ঠী চৌধুরী বললো – ম্যাডাম, ‘তমাল’ নদীর এপার-ওপার জুড়ে প্রায়ই অজগর শুয়ে থাকে ।
চমকে উঠলো দেবলীনা ।
সে বললো – কয়েকদিন আগেই অজগর দেখেছি এখানে ।
নামা হলো না । সামান্য হলেও পায়ের তলার অংশটা শিরশির করে উঠলো অশোকের ।
ভয় খুব সংক্রামণ ব্যধি । প্রায় প্রত্যেকেই একবার করে পায়ের তলাটা দেখে নিলো । অজগর না হোক এখানে চন্দ্রবোড়ার কামড়ে মানুষের মৃত্যু হয়েই থাকে ।
দেবলীনা বললো – সামনের জাংগলটার নাম কি !
আনন্দপুর । একসময় খুব ডাকাতি হতো ।
দেবারতি বললো – মাওবাদীদের সময় এই আনন্দপুর ছোটখাটো মর্গ হয়ে গেছিল ।
মানে ! অর্ক বললো ।
মানুষের লাশের পাহাড় ছিল এখানে ।
দেবলীনা বললো – ষষ্ঠীদার অজগর কিন্তু বানানো । গাড়ির পিছনের সিটে লছমন এতোক্ষণ জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিল ।
সে এবার বললো – মেমসাব, ময়াল ভি হ্যায় ।
লছমন হোমে মানুষ হয়েছে । তার বুক-পকেটে বউ আর ছেলের ছবি থাকে ।
লছমন তোর বউয়ের নাম কি ! অশোক বললো । সাহেব, লছমি ।
লছমনকে এখানে সবাই ভয় দেখায় । বলে, তোর বিয়ে দিয়ে দেবো । সে তখন হাত ঘুড়িয়ে দেখিয়ে বলে – ওর একটা আছে । ওর বিয়েতে সন্‌স্কৃতে ভি মন্ত্র হয়েছিল । অভিষেক প্রায়ই বলে, মন্ত্রটা বল লছমন ! তখন সে বলে, বহুত বড়িয়া । কিন্তু যদিদং – সে তো বুক পকেটে রেখেছে ।
এসব বেশী করে অভিষেক । লছমন ক্যান্টিনে খেতে বসলে নানা-রকম ভয় দেখায় । লছমন খুব ভীতু, সে দিনের বেলায়ও ভয় পায় । তখন ‘রাম, রাম’ – বলতে থাকে ।
তবুও ভূতের কাছেও সে কখনও কবুল করেনি যে, লছমিকে রেখে সে আর কাউকে বিয়ে করবে । গভীর ভালবাসা তার ।
গাড়ি একটু এগোতেই অরণ্য আরো গভীর হলো । তবে বৃষ্টি একেবারেই থেমে গেছে । চাঁদকে আর কৃশ মনে হচ্ছে না । সে এখন গোলাকৃতি ।
জায়গাটার – নাম কি গো !
ঝড়েশ্বর । অশোক বললো ।
সত্যি কি শালপাতার থালায় খাওয়া ।
অশোক বললো – অবশ্যই । এছাড়া কাঠের আগুনের আঁচে রান্না । বহু বছর পর হালুইকরদের দেখা পাবে ।
অর্ক বললো – বাবা, তোমার সেই বারোয়াঁ সুরে সানাই আছে !
থাকতে পারে ।
মেহবুবা ব্যান্ড !
থাকবে, গম্ভীর গলায় বললো অশোক ।
চিৎপুর রোডের সেই লোকগুলি না এলে আগে বিয়েবাড়ি জমতো না ।
দেবলীনা বললো – কুশণ্ডিকা দেখতে বেশ লাগে ।
আজকাল কি আর ওসব হয় !
দেবলীনা বললো – এতো প্রত্যন্ত গ্রামে বিয়ে নিশ্চয় শাস্ত্রমতে সব হবে ।
দেবারতি বললো – ম্যাডাম, বর কিন্তু নাস্তিক ।
তাই, ইনটারেস্টিং ।
শাঁখ, উলুর চান্স কম !
দেবলীনা বললো – রেজিস্ট্রি বিয়ে হবে !
অতোটা না নিশ্চয় । তবে সর্বজিৎ-র বাবা কয়েক বছর আগে সুইসাইড করেছিল ।
দেবলীনা বললো – কেন ?
ওর বাবা বোনের অসবর্ণ বিয়ে দিয়েছিল ।
অর্ক বললো – গ্রামটা ব্যাপক গোঁড়া-তো !
আনন্দপুর, একসময় পণ্ডিতদের বাস ছিল ।
চতুষ্পাঠী চলেছিল দীর্ঘদিন ।
অভিষেক চেঁচিয়ে বললো – ফ্যান্টাসটিক ।
সবাই একসঙ্গে বলে উঠল – চলে এলাম !
হ্যাঁ । মাটির বাড়ি কিন্তু কি চমৎকার সাজিয়েছে ।

আনন্দপুরে বরযাত্রী এসেছি আমরা । সানাই বাজছে ।
আমি অনেকদিন পর ধুতি পরেছি । ষোলআনা বাঙালি সেজেছি । যদিও সুকুমার সেনের মতে বাঙালির জাতীয় পোশাক নাকি গামছা ।
দেবলীনাও শাড়ি পরেছে অনেকদিন পর ।
দেবারতি বললো – বরের আগে চলে এলাম নাকি !
আমরা ঢুকতেই সর্বজিতের বোন অভিষেককে ডেকে নিয়ে গেলো একান্তে ।
অভিষেক বললো – কি হয়েছে !
দাদা, প্যান্ট-শার্ট পরে এসেছে । ধুতি কিছুতেই পরবে না ।
অভিষেক বললো – এটা এমনকি ব্যাপার !
সর্বজিতের বোন সুষমা অভিষেককে তার দাদার কাছে নিয়ে এলো ।
অভিষেক বললো – কি-রে হঠাৎ তোর ব্রিটিশ সত্তা জেগে উঠলো যে !
সর্বজিৎ বললো – ধুতি, পাঞ্জাবি পরতেই হবে এর কি কোন মানে আছে !
সুষমা বললো – আজকের দিনটা পরবি না !
অভিষেক ইশারায় চুপ করতে বললো ।
তারপর বললো – বাঙালি কিন্তু নোবেলের মঞ্চেও ধুতি পরছে ।
সে-টা কি ভিতর থেকে না এলেও দেখাতে হবে ।
মাটির বাড়ি কিন্তু খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে । আলপনা দেওয়া চমৎকার করে ।
অভিষেক আনন্দের বহিঃপ্রকাশ করে ফেলেছিল, এখন কাছ থেকে দেখে বেশ লাগছে । দেবারতি আবার নকল হাতী ও শ্বেত পাথরের গণেশ মূর্তির মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুললো ।
কুশণ্ডিকা হয়ে গেছে ! দেবলীনা বললো ।
সবাই মুখ চাওয়া- চাওয়ি করছে । বিয়েবাড়িটার চমৎকার আভরণের আড়ালে কেমন একটা থমথমে আবহাওয়া রয়েছে ।
এইবার বোধহয় মেয়ের ‘মা’ এগিয়ে এলেন ।
বললেন – চলো বাবা, পুরুতমশাই কখন থেকে বসে রয়েছেন । অস্মিতার দাদা সম্প্রদান করবে ।
সর্বজিৎ বললো – ওসব করার কি দরকার ! রেজিস্টার সাহেব তো এসেছেন ।
আমরাও বেশ ঘাবড়ে গেলাম । অরণ্য পার হয়েছি । হাতী, অজগর কতো কিছুর অপেক্ষা করেছি । দেখা হয়নি কিন্তু এক অনন্য বুনো গন্ধ, চাঁদ, তমাল নদী অপার্থিব করে তুলেছিল এই বিয়েবাড়িতে আসাটা ।
মাটির বাড়িও স্বপ্নের সঙ্গে মিলে গেছিল ।
কিন্তু শহর কলকাতা নয়, এমনকি মেদিনীপুর শহরও নয় – এরকম প্রত্যন্ত আনন্দপুরে সর্বজিৎ বলছে, রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করবে । ওর সম্পর্কে অবশ্য শুনেছিলাম, বিজ্ঞান মঞ্চের সক্রিয় সদস্য কিন্তু ওসব তো অনেকেই করে ।
সুষমা বললো – বাবার মৃত্যু কিন্তু আমি ভুলতে পারিনি ।
সর্বজিৎ বললো – সেটা মানুষের ভুলভাল সংস্কার । বাবা তো আত্ম-বলিদান দিয়েছেন যাতে তাঁর গ্রামে বিজ্ঞান চেতনা ফিরে আসে ।
সুষমা বললো – ফিরে এসেছে কি !
আসবে । একদিনে না হলেও আসবেই । তুই তো সুখী হয়েছিস । জাত, কৌলিন্য, বর্ণ – এসব মানুষের তৈরি। সংস্কার ।
মেয়ের মা, মাসী ও আরো অনেকেই কাঁদো, কাঁদো গলায় চললো – আমরা গ্রামীন সমাজে একঘরে হয়ে যাবো ।
সর্বজিৎ বললো – আমি আপনাদের মেয়ের সঙ্গে কথা বলবো !
এখনও তো শুভ দৃষ্টি হয়নি !
সর্বজিৎ মানলো না । সটান রেজিস্টারকে নিয়ে কনের কাছে চলে এলো ।
চোখের পলকে কাগজের কয়েকটা সই – যদিদং হৃদয়ং মম্‌ ইত্যাদি সংক্ষেপে হয়ে গেলো । আর হৃদয়ের অন্তঃপুরের খবর অনেক বছর নথিপত্রেই পর পেয়েছিলাম ।
লছমন এবার আমায় বললো – স্যার হামলোক খায়েগা তো !
সর্বজিৎ ওর পীঠে থাপ্পর মেরে বললো – জরুর ।
খুব সন্তর্পণে খাওয়ার কাজটা সারলাম ।
পথে যেতে যেতে চাঁদ উঠলো এখন সে আরো সুন্দরী । তমাল নদীর জল রূপোর মতোন চকচক করছিল ।

এর কিছুদিন পর আমি ওখান থেকে বদলি হয়ে গেলাম ।
কখনও কখনও মনে হয় আমাদের পুরোনো বিয়েটার তো পঞ্জীকরণ এখনও হলো না ।
তবে শুনেছি সর্বজিৎ, কৃষ্ণা বেশ আছে । ওদের একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে ।
নাগরিক কলকাতায় বহু বিয়েতেই কুশণ্ডিকা হয়েছে । দেবলীনার সেই বিষয়ে আর আক্ষেপ নেই । সময় কোথাও একটা দাঁড়িয়ে থাকে । বাইরের প্রযুক্তি, সভ্যতা সেখানে খুব একটা আলো ফেলে কিনা আমার জানা নেই । আমারও কি ফেলেছে ! জানি না ।
তবে শহর কলকাতার শপিং মলে হারিয়েছি সেই তমাল নদী, বন-মর্মর আর অদেখা অজগর যে নাকি নদী জুড়ে শুয়ে থাকতো যখন-তখন ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।