• Uncategorized
  • 0

গল্পগাছায় সুজাতা মিশ্র (সুজান মিঠি)

বর্ষা রাগিণী

সারারাত্রি একটানা বৃষ্টির পর সকালটা একেবারে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার। গাছের পাতাগুলো তাদের গা থেকে মুক্তোর মত ফেলছে জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো, ঠিক যেন মৃদু পিয়ানোর টুংটাং শব্দ। বন্ধ জানলার ওপারের অপারেশন থিয়েটারে সদ্য জন্মানো সন্তানের কান্নায় তার মা পেল সঙ্গীতের সর্বশ্রেষ্ঠ রাগিণীর মোহাবিষ্টতা।  ফুটফুটে মেয়ের নাম ঠিক হয়ে গেল সেই ক্ষণেই; ‘রাগিণী’।
বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে রাগিণী, ভারী আদরের বড় মিষ্টি। নৃত্য গীত কোনোটিতেই কম যায়না পড়াশোনার পাশাপাশি। এইটুকু মেয়ের কাছেও যেন রবি ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছেন পরিপূর্ণতায়। তবে দুর্বলতা শুধু বর্ষাকে নিয়ে। বৃষ্টির সময় জানলার ধারে বসে হাত বাড়িয়ে জল ছোঁয়া কিংবা খোলা ছাদে আপাদমস্তক ভিজে মায়ের বকা খাওয়া দুটোতেই তার ক্লান্তি নেই। একবার পরীক্ষার প্রশ্নে ‘প্রিয় ঋতু’ লিখতে গিয়ে লিখেছিল, ‘বর্ষাকে আমি ভালোবাসি, এই পৃথিবী যেন বর্ষা হয়ে থাকে সারাবছর।’ তারপর দিদিমনির কাছে বর্ষায় কষ্ট পাওয়া মানুষদের জীবন শুনে বলেছিল, ‘আচ্ছা পরেরবার থেকে লিখবো, আমার সব ঋতুই ভালো লাগে। সব ঋতুই আসুক নিয়মমতো। তবে বর্ষা একটুখানি বেশিই ভালো লাগে আমার।’
মেয়ের দশ বছরের জন্মদিন। তার আবদার রাখতে ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যেই গাড়ি নিয়ে বেরোনো জয়দীপবাবুর। স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে গাড়িতে যেতে যেতে গান ধরলেন বর্ষার, ‘আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে…’
উন্মাদের মত ছুটে আসা লরিটা পিষে দিল বর্ষার গান।
জয়দীপ বাবু ও তাঁর স্ত্রী মারা গেলেন ওখানেই। মেয়ে রাগিণী আহত অবস্থায় ভর্তি হলো হাসপাতালে। বৃষ্টির রং হয়ে গেল রক্ত, নাকি রক্ত হয়ে গেল বৃষ্টি তা আর বুঝতে পারলো না রাগিণী।
হাসপাতাল থেকে রাগিণীর মামা তাকে নিয়ে এলো নিজের বাড়ি। মামা মামী নিঃসন্তান। বিরাট অবস্থা। সুতরাং সংসারের সব কাজ করে মার খেয়ে মানুষ হতে হবে রাগিনীর এমন ভাগ্য মোটেই নয়, আবার মামা মামী নিঃসন্তান বলে তাকে বুকে টেনে নিয়ে স্নেহে ভরিয়ে দেবে, এমন ভাগ্যও তার নয়। মামা ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকেন আর মামী সমাজসেবায় সমাজে। উদাসীন বোঝা হয়ে উঠলো সে তাদের  কাছে, কারণ দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে তার দৃষ্টি।
ব্লাইন্ড স্কুলে বড় গাড়ি করে এসে নামে রাগিণী। ড্রাইভার রামুকাকু তাকে নিয়ে এসে সারাদিন গাড়িতেই বসে থাকে। ছুটির পর বাড়ি নিয়ে ফেরে। কোনোদিন হয়তো গাড়ি রেখে বাসে তিন মাইল দূরে ছুটে যায় তার একরত্তি মেয়েটাকে দেখে আসতে। রাগিণীর মতোই বয়স তার মেয়েরও, ফুটফুটে মিষ্টি। কিন্তু পরমায়ু আর মাত্র এক বছর হয়তো। ডাক্তার বলেছে, ‘ও যা চায়…’ ভাবতেই কূল চাপিয়ে জোয়ার আসে রামুর চোখে। হৃৎপিণ্ডটা ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়তে চায় মাটিতে।
রাগিণী আসা যাওয়ার পথে তার ড্রাইভার কাকুর সঙ্গে ভারী ভাব জমিয়ে নিয়েছে। সে জেনেছে তার মেয়ে বর্ষার কথা। যে রাগিণী দুর্ঘটনার পর বর্ষার নাম শুনতে চাইতো না, বৃষ্টির শব্দে কানে দিত আঙুল, সেই মেয়ে আবার বর্ষার সঙ্গে আলাপ করতে ছুটে গেল রামুকাকুর বাড়ি, স্কুল না গিয়ে।
এমন হলো বর্ষা আর রাগিণী প্রতিদিন দেখা না করলে ছটফট করতো দুজনেই।
রাগিনীর মামা বা মামী কেউ কখনো খোঁজ রাখতো না মেয়েটা বাড়ি ফিরেছে কিংবা খেয়েছে কিনা, বলা যায় হয়তো মনেই রাখতে চাইতো না অবাঞ্চিত মেয়েটাকে।
একটু একটু করে বর্ষা রাগিণীর পরম আপন হয়ে উঠলো,
বর্ষার মায়ের স্নেহে তার গর্ভধারিনী ফিরে এলো যেন। রাগিণী এরপর সাহস করে রাতেও থাকতে শুরু করলো রামুকাকুর বাড়ি।
মামা একদিন ডেকে বললেন, ‘রাগিণী রামুদের বাড়ি যাচ্ছ, থাকছো, ভালো কথা, বেশি টাকা পয়সা দিওনা। গরিব মানুষ হচ্ছে লোভী।যত পায় তত চায়।’
বর্ষা ছোট থেকেই নাচতে ভালোবাসতো ভীষণ। আট বছর বয়সে রোগ ধরা পড়ার পর বন্ধ হয়ে গেল তা। রাগিণীও ভুলে যেতে চেয়ে গায় না গান, ময়ূর হয়ে ওঠে না বর্ষা কিংবা বর্ষার ভাবনায়। বর্ষার খুব ইচ্ছে যে জীবনে আর কয়েকদিনেই আসবে মৃত্যু, সেই জীবনের ভালোবাসাকে সে জড়িয়ে রাখুক শরীরে, সে রাগিণীকে বললো তার বাবাকে রাজি করাতে, সে নাচবে।
— ‘না বেটা, বর্ষার শরীর নাচের ধকল নিতে পারবে না। ওকে তুমি বোঝাও।’ কান্নায় ভেঙে পড়ে রামুকাকু।
কাকিমা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে উঠে যায় একটা আসন্ন মৃত্যুকে কান্না দিয়ে আটকাতে।
বর্ষা রাগিণীর হাত ধরে তার বাড়ির পরিবেশ চিনিয়েছে। চিনিয়েছে তার বাড়ির সামনের খোলা আকাশ। বসন্তের দখিনা হাওয়া। গ্রীষ্মের কালবৈশাখী।
সেদিন রামুকাকু রাগিণীকে নিয়ে স্কুলের পথে যাওয়ার সময় আসে কাকিমার ফোন। গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ির পথে ছুটলো রামুকাকু, রাগিণীর বুক শুন্য হয়ে উঠতে লাগলো যেন চেনা অথচ এক অনাকাঙ্ক্ষিত কষ্টে।
গাড়ি থেকে নেমেই রামুকাকু ছুটে গেল ঘরে। রাগিণীও এখন চেনে রাস্তা। এক পা এক পা করে ঘরে ঢুকতেই বর্ষার গলার আওয়াজ, ‘রাগিণী আমি আজ নাচবো। তুমি গাইবে, আমি নাচবো।’
‘বাবা, বাধা দিও না।’ ‘এই শেষ ইচ্ছা আমার আজ আমি নাচবো।’
‘দেখো রাগিণী, বর্ষা আসবে কদিন বাদেই, তুমি গাও বন্ধু, গাও…’
‘মন মোর মেঘের সঙ্গী উড়ে চলে দিক দিগন্তে।’
এসে জড়ো হয়েছে প্রতিবেশীরা। কাকিমা রাগিণীর হাত ধরে বলে, ‘গাও মা। আমার এক মেয়ে গাইবে আর এক মেয়ে নাচবে। কত সুখের দিন আজ।’
রাগিণী শুরু করে তার ফেলে আসা পথ, বৃষ্টি দেখতে দেখতে মায়ের কোলে মাথা রেখে প্রথম গেয়েছিল এই গান।
বর্ষা তার পায়ে পড়েছিল তার পুরানো ঘুঙুর জোড়া। রাগিনীর গান থেমে গেল কিছু পরেই, কারণ অধিক উত্তেজনায় বর্ষার পায়ের আওয়াজ থেমে গেছে।
এরপরের ঘটনা অতি দ্রুত গতিতে এগোয়। হাসপাতালে ছোটে বর্ষার বাবা মা, প্রতিবেশী, নিয়ে যাওয়া হয় রাগিণীকেও। আসে রাগিণীর মামা মামীও।
বর্ষা যে অনেক আগেই তার বাবা মাকে জানিয়ে গিয়েছিল সে রাগিণীর চোখেই থাকবে বেঁচে।
প্রথম চোখ খুলেই রাগিণী দেখেছিল বর্ষা। বাইরে অঝোরে ঝরে চলেছে বছরের প্রথম বর্ষা। মামা মামীর কাছ থেকে অনেক অনুনয় বিনয় করে মেয়েটাকে চেয়ে নিয়েছে রামুকাকু, বলেছে, ‘যত্নের কোনো অভাব হবে না বাবু। আপনাকে কোনো টাকা পয়সা দিতে হবে না। শুধু আমরা আমাদের বর্ষাকে আমাদের কাছে রাখতে চাই।’  অবাঞ্চিত ভাগনি বেঁচে থাকলেই হলো, খুশিতেই রাজি হয়েছিলেন দুজনে।
বর্ষার বাড়িতে ফিরে সবকিছুই চেনা লেগেছিল রাগিণীর। বর্ষা তো নিজেই হাতে ধরে চিনিয়েছিল তাকে। রাতে রামুকাকু আর কাকিমাকে লুকিয়ে উঠোনের বৃষ্টিতে এসে দাড়ালো রাগিণী। ঝমঝম বৃষ্টিতে অঝোরে ঝরতে লাগলো তার চোখের জল। বর্ষার ঘুঙুর পায়ে বেঁধে সে গাইল তার কন্ঠ আর সারা শরীর দিয়ে,
‘…মন মোর ধায় তারি মত্ত প্রবাহে…’
ছুটে আসে রামুকাকু আর কাকিমা। জড়িয়ে ধরে রাগিণীকে।
‘বর্ষা ওরে মা রে। তুই আমাদের বর্ষা রে। তুই আমাদের বর্ষা।’
রাগিণীর সামনে এসে দাঁড়ায় বর্ষা। হাসতে হাসতে বলে
‘…বর্ষার রাগিণী, রাগিণীর বর্ষা।’
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।