গল্পে কুহেলি মুখার্জি

বাবুনের স্বপ্নেরা

জানলার ধারে বসে রোজ বিকেলে ফুটবল খেলা দেখতে আর ভালো লাগে না বাবুনের।চোখের কোণ কখন যে নিজের অজান্তেই ভিজে যায়, বুঝতে পারেনা।
মাস ছয়েক আগেও এরকমটা কিন্তু ছিলোনা,বছর আটের বাবুনের মা-বাবা-ঠাম্মা-দাদু সবাই একসাথেই এক বাড়িতে থাকতো মিলেমিশে, কথা থেকে কি যে হয়ে গেল।।
মফস্বলের বাড়িটা ছেড়ে ছয় মাস আগে যখন মা-বাবা কলকাতার ভাড়ার ফ্ল্যাটে এসে উঠলেন, তখন বাবুনের মনটা পড়ে ছিল ওই দেশের বাড়িতে, হালিশহরের ওই দোতলা বাড়ির ছাদ, চিলেকোঠা ঘরে কত যে স্মৃতি রয়েছে! বাবার নাকি খুব বড় একটা চাকরি হয়েছে,ওখানে থাকলে বাবুনের বড় হওয়া হবেনা, বড় স্কুলে পড়ে আদবকায়দা শেখা হবেনা। আচ্ছা, যারা মফস্বলের স্কুলে পড়ে, তারা কি আদবকায়দা জানেনা নাকি? কে জানে?
এখানে এসে মাও একটা অফিসে চাকরি নিলো,বাবা নাকি একা সংসার চালাতে পারছেনা, তাহলে বাপু কি দরকার ছিল ওখান থেকে আসবার?সকাল হলেই বাবুনকে স্কুলে পাঠিয়ে, বাবার অফিসের খাবার রান্না করেই মা চলে যান অফিসে।বাবুন স্কুলছুটির পর একটা ক্রেসে থাকে।মা অফিস থেকে ফিরে ওকে নিতে আসেন।সারাদিন পর বাড়ি ফিরেই আবার রান্না আর আজকাল এত ফোন আসে মায়ের, বাবুন ঠিক করে মায়ের সাথে গল্প করার সুযোগ ই পায় না।
বাবা সারাদিন পর যখন অফিস থেকে ফেরেন, বাবুন প্রায়দিন ই ঘুমিয়ে কাদা। আর শনি-রবিবারগুলো মায়ের সারা সপ্তাহের জমানো কাজ,ঘর পরিষ্কার এসব লেগেই থাকে। হ্যাঁ, আর থাকে বাবার বন্ধু বা মায়ের বন্ধুদের বাড়িতে পার্টি।সেখানে ওদের বড়দের গল্পের মাঝে রাতের ডিনার শেষ হলে বাড়ি ফেরা।আঙ্কেল-আন্টিরাও কেমন যেন।সারাক্ষন শুধু কার ছেলেমেয়ে কি কি ভালো কাজ করলো সেই আলোচনাতেই ব্যস্ত।কার ছেলেমেয়ে কত দামি স্কুলে পড়ে,কে কত দামি গাড়ি-বাড়ির মালিক এছাড়া আর কোনো গল্প নেই।।
সেদিন তো মিত্র আন্টির ছেলে সোহান বললো- “ও নাকি কখনো বাংলা বই পড়েনি।বিদ্যাসাগর,রবি ঠাকুরের নাম ই শোনেনি।”ঠাম্মির দেওয়া বুড়ো আংলা বইটার নাম শুনে ওর কি হাসি, যেন একটা খুব মজার কথা শুনেছে।।বাবুন বাংলা বই পড়ে জানতে পেরে সোহান আর পিঙ্কি ওর নাম দিয়েছে ব্যাকডেটেড।।
বিকালে মাঝে মাঝে মাঠে খেলতে গেলেও বাবুনকে বন্ধুরা ব্যাকডেটেড বলে ক্ষেপায়।আজকাল আর ঠাম্মির সাথেও ফোনে খুব একটা কথা বলা হয় না। মা-বাবাকে বললে ওনারাও খুব একটা আজকাল আগ্রহ দেখান না।কতদিন ঠাম্মার কাছে গল্প শোনা হয়না,দাদুর হাত ধরে মাঠে খেলতে যাওয়া হয়না।পুরোনো বন্ধুগুলোকেও খুব মনে পড়ে বাবুনের।।
চলে আসবার সময় বুলান, সন্তুদাদা, মিনুদিরা কত্ত কেঁদেছে ওর জন্য।প্রতি বছর মিনুদিদি ওকে ভাইফোঁটা দিতো, ওর জন্য পায়েস বানিয়ে নিয়ে আসতো, সেই পায়েস খাবার জন্য সন্তুদাদার সাথে বাবুনের প্রতিবার হাতাহাতি হতো।।মিনুদিদি চুপিচুপি রাতের বেলায় বাবুনের জন্য একবাটি পায়েস লুকিয়ে মাকে দিয়ে আসতো।।
দূর ,আজকাল পড়াশোনা করতেও ইচ্ছে করে না বাবুনের।হাফ ইয়ারলির রেজাল্ট খারাপ হলো,বাবা-মাকে স্কুলে ডেকে নির্মলা ম্যাম খুব খারাপ কথা বললেন।রাতে মা-বাবার ঝগড়ায় পাশের ঘরে বাবুনের ঘুম ভেঙে যায়।শুনতে পায় মায়ের কথা,” ঠাম্মির কাছে থেকে বাবা-ই জোর করে বাবুনকে সরিয়ে নিয়ে এসেছে,ওকে ভালো স্কুলে পড়ানোর জন্য।বাবুনের জন্য কেঁদে কেঁদে ঠাম্মা অসুস্থ হয়ে গেছেন।” বাবা অনেক ঝগড়া করেও মাকে বোঝাতে না পেরে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন ,কাউকে কিছু না বলে।মা পরদিন অনেকবার ফোন করেও বাবাকে না পেয়ে কান্নাকাটি করছেন,আর বাবুন জানলার সামনে বসে বন্ধুদের ফুটবল খেলা দেখে চোখের জল ফেলছে।।
এমন সময় হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজে ছুটে যান মা।দরজা খুলতেই ম্যাজিক, ঠাম্মিকে নিয়ে বাবা চলে এসেছেন। আগামী ছয়মাস ঠাম্মি বাবুনের সাথেই থাকবেন যতক্ষন পর্যন্ত ওর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ না হয়।পরীক্ষা শেষ হলে ঠাম্মি, মা আর বাবুন ফিরে যাবে হালিশহরে,বাবুন আবার ভর্তি হবে ওর পুরোনো স্কুলে।বাবা ওদের সাথে যেতে পারবেন না,তবে প্রতি শুক্রবার রাতে অফিস ফেরত ট্রেনে করে হালিশহরে যাবেন আর সোমবার সকালে হালিশহর থেকেই অফিস যাবেন।সপ্তাহের বাকি পাঁচটা দিন মেসে থেকে যাবেন।মাও বলেছেন, আর চাকরি করবেন না,এবার থেকে রোজ বিকালে বাবুনকে আগের মতোই স্কুল থেকে নিয়ে আসবেন, সন্ধ্যায় পড়তে বসাবেন।।
আজ বাবুনের আনন্দ দেখে কে?ঠাম্মি-মা-বাবাকে ঘিরে একপাক সে নেচে নেয়।।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।