হাবি
সেবারে বুড়োশিব বাবার মেলা শুরু হওয়ার আগেই বুড়ী পিসির বিয়ে ঠিক হল… বাড়ী ময় হুলুস্থুল.. পিসির বয়েস 23 গায়ের রঙ দোলের পরের দিনের রাস্তার মতন.. চোখ দুটো বড় মায়াময় কাজল কালো…. ঈশ্বর সব দিলেও বুড়ী পিসিকে তৈরি করার সময় ঈশ্বরের নাকে পোকা ঢুকে প্রবল হাঁচি পাওয়ায় পিসির বাক যন্ত্র টা বসাতে ভুলে গিয়েছিলেন… ফলে পিসি কে ছোট থেকেই “হাবা মেয়ে হাবি মেয়ে” এসব শুনতে শুনতে মেয়েবেলা পেরোতে হয়েছিল.. বাড়ীর সব কাজকর্ম “মুখ বুজে” করে যেত বুড়ী পিসি..
সিঁড়ির তলায় ঘরের মধ্যে পিসির সম্পত্তি ছিল একটা বড়বাজার এর ট্রাংক, একটা গোপাল ঠাকুরের ছবি দেওয়া ক্যালেন্ডার…একটা ভাঙা আলনা একটা সেলোটেপ দেয়া আয়না আর ছ পিস বই.. ট্রাঙ্কের মধ্যে জামা কাপড়,সাজের জিনিস, টিপের পাতার নিচে একটা বঙ্গলিপি খাতা ছিল… তার ভেতরে একটা কালীপটকার প্যাকেট থেকে নেওয়া একটা গোলগাল বাচ্চার ইজের পরা ছবি আর খাতার প্রথম পাতায় ” কুমারী স্নেহলতা অধিকারী”.. লেখা..
“হাবি” মেয়েকে যে কেউ “চোখ তুলে দেখো না কে এসেছে” বলে বিয়ে করে নিয়ে যাবে না এ ব্যাপারে বাড়ীর সবাই এক প্রকার নিশ্চিন্ত ছিল বলা যায়.. সব পিসির বিয়ে হয়ে গেলেও বুড়ী পিসি বাড়ীতে জলের কুঁজোর মত এক কোনে পড়ে থাকত নিজের মত.. ঘরের কাজ কর্ম, বৌদিদের বাচ্চা দের নিয়ে বসে থাকা, রাজ্যের এঁটো বাসন মাজা এসব কাজে পিসি ছিল সিদ্ধহস্ত..
দাদু বহুবার রতন ঘটক কে বলে বলে ফেড আপ.. ” বাবা রতন.. আমার লতা মা কে তো তুমি ছোট থেকে দেখছ.. মেয়েটার বয়েস হচ্ছে তুমি একটা গতি করে না দিলে বাবা…” রতন গম্ভীর মুখে বিড়ি ধরিয়ে ” ভাঙা থালায় কেউ ভাত খায় জ্যাঠা মশাই..??” বলে দাদুর ইচ্ছের গাছে আলকাতরা ঢেলে দিয়েছে সবসময়.. রতন ঘটক আচমকা একদিন পিসির সম্বন্ধ নিয়ে হাজির.. ভাঙা থালায় ভাত খেতে রাজী হয়েছেন একজন তাহলে.. পাত্রের নাম সুবিনয় মন্ডল , সত্তর দশকের কালী বন্দ্যোপাধ্যায় এর মত দেখতে, রাজ্য সরকারের কর্মী, তিনকুলে কেউ নেই.. মা ছিলেন.. তিনিও গত হয়েছেন বছর দেড়েক হল.. পুরুষ মানুষ একা হাত পুড়িয়ে কদিন খাবে.. তাই অনেক ভেবে চিন্তে বিয়ে করার কথা ভেবেছেন..
দাদুর প্রথমেই চিন্তা যে হবু বৌ যে কথা বলতে অক্ষম সেটা সুবিনয় বাবু জানেন কি না.. রতন ঘটক ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে বলল-” আমি সব বলিচি কোন আপত্তি নেই আমনাদের ও ওই ছেলে কে পছন্দ হবে” বলে আশ্বাস দিয়ে গেল.. একদিন দুপুরে সাইকেল ঠেঙিয়ে পাত্র হাজির আমাদের বাড়িতে.. হাতে এইচ এমটি, পায়ে চীনা বাড়ীর জুতো, মুখে সর্বদাই গুড়ের নাগরীর গায়ে যেমন গুড় লেগে থাকে সেরকম মুখে হাসি লেগে আছে.. এদিকে বুড়ী পিসি কোথায় লুকিয়ে বসে আছে খোঁজ নেই… রায় কাকাদের বাড়ী থেকে কাঁচের প্লেট এনে সাধ্যমত আপ্যায়ন করলেন বাড়ীর বড় রা.. হবু জামাই এসেই একথা সেকথার পর দাদুর সঙ্গে চাষ বাস টমেটোর ফলন, সারের দাম নিয়ে এমন আলোচনায় মত্ত হয়ে পড়লেন যে পাত্রী দেখার কথা তার মাথায় নেই একেবারেই.. দাদুর সমানে পটল, মুলো নিয়ে চর্চা করে যাচ্ছেন.. শেষ মেষ বড় বৌদি কোত্থেকে পিসি কে ভালো করে শাড়ি পরিয়ে কপালে টিপ চোখে কাজল পরিয়ে হাজির… সুবিনয় বাবু চা খাওয়া থামিয়ে এমন হাঁ করে পিসি কে দেখতে লাগলেন তখন ই বোঝা গেল বিয়ে পাকা..দেনা পাওনা র প্রসঙ্গ উঠতেই সুবিনয় বাবু একটু বিরক্ত হলেন বলে মনে হল.. চায়ের কাপ নামিয়ে রুমালে ঠোঁট মুছে ” আপনার মেয়েকে পাঠাবেন তাহলেই হবে” বলে আমার বোনের হাতে ” মিষ্টি খেও” বলে একটা একশো টাকার নোট আর আমাকে ” এবারেও অংকে ফেল?? ভালো ভালো…” করে সাইকেল নিয়ে চলে গেলেন..
দিন ক্ষণ মেনেই পিসির বিয়েটা হয়ে গেল… দাদু নিজের সাধ্যমতো সব ব্যবস্থা ই করেছিলেন.. অনেকে কানা ঘুসো করলেও বিয়ে উতরে গিয়েছিল ভালো ভাবেই.. আমার পিসি চাল ছুঁড়লেও ” সব শোধ করে দিয়ে গেলাম” বলতে পারেনি… বাড়ির সবার কান্না, দাদু গম্ভীর মুখে পায়চারি করছেন বাড়ীর সামনেটা.. যাওয়ার আগে ঠাকুর ঘরে আর ঠাকুমার ছবিতে প্রণাম করে কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছিল বুড়ী পিসি.. ভাঙা থালায় যে এত অভিমান কে জানত..
. এদিকে সুবিনয় বাবু ততক্ষনে দাদুর হাতে একটা রেডিও তুলে দিয়েছেন .. দাদু হাঁ হাঁ করে ওঠায়
” আপনার সময় কাটবে খন” বলে দাদুকে রেডিও টা দিয়ে পিসে বুড়ী পিসি কে নিয়ে চললেন নিজের বাড়ী..
সুখে শান্তিতেই কাটতে থাকে দিন.. পিসির বাড়ী বেড়াতে গেলে পিসি কি খাওয়াবে কি আপ্যায়ন করবে ভেবে পেত না.. ভাষা না থাকলেও চোখ দিয়ে প্রকাশ করত আনন্দ.. দুপুরে ঘুম ভেঙে কতবার পিসির বাড়িতে দেখেছি ছুটির দিনে পিসে আর পিসি বসে বসে রেডিও শুনছেন.. অসুখের সময় কখনো পিসি দু একটা অস্ফুট শব্দ করে কি একটা বলছে আর পিসে ” না না তোমার জন্য নিয়ে আসব আর তুমি ওষুধ খাবে না বললে হয় নাকি?? খাও খাও হাঁ করো হাঁ বড় করে”… পিসিকে ওষুধ খাইয়ে দিতেন নিজের হাতে..
আজ হঠাৎ কথা গুলো বড্ড বলতে ইচ্ছে করল আজ প্রেম দিবস ভ্যালেন্টাইন ডে.. কার্ড, ফুল, গিফট এর দিন… সে সময় ভ্যালেন্টাইন ডে না হলেও ” ভালোবাসার দিন” প্রত্যেক দিন ছিল দুজন মানুষের একজনের ঠোঁট নাড়া দেখে আরেকজন বুঝতে পারতেন মনের কথা… আজ পিসি ও নেই পিসে ও না.. তবে আজ প্রেম দিবস.. সবাইকে শুভেচ্ছা.. দেখলেন কেমন ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে ফেললাম…