• Uncategorized
  • 0

ছোট গল্পে পাপিয়া মণ্ডল

মধুর খেলা

অনুরাগ আর বিপাশার বিয়েটা হাফ অ্যারেঞ্জড আর হাফ লাভ। মানে বাড়ী থেকে দেখাশোনা করে বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর চুটিয়ে প্রেম করেছিল বেশ কয়েক মাস। দুজনেই মফস্বলের ছেলেমেয়ে।  কলকাতার বেসরকারি ফার্মে চাকরী করে, তবে দুজনের কর্মক্ষেত্র আলাদা।
বছর চারেক আগে ওদের বিয়ে হয়। কলকাতায় ফ্লাটে থাকে। দুজনেই চাকরী করে,  তাই দিনের আর রাতের খাবার ওরা হোম ডেলিভারিতে নিয়ে নেয়।
মাঝে মাঝে কোনো বিশেষ দিন বা ছুটির দিনে বিপাশা নিজে রান্না করে।
বিপাশাকে ‘ বিয়াস’ বলে ডাকে অনুরাগ। আর ওকে ‘অনু’ বলে বিপাশা।
বছর তিনেক বেশ মাখো মাখো প্রেম ছিল দুজনের।
উইকএণ্ডে ছোটোখাটো আর বড় ছুটিগুলোয় একটু দূরে ঘুরতে যেত ওরা। একে অপরের প্রতি খুবই কেয়ারিং ছিল।
বিগত এক বছর ধরে ওদের দুজনেরই অফিসে কাজের চাপ এতোটাই বেড়েছে যে, কেউ কাউকে আর আগের মতো সময় দিতে পারে না।
রাতে প্রায়ই দুজনেই আলাদাভাবে বাইরে খেয়ে আসে। শণি-রবিবারটা একসঙ্গে বাড়ীতে থাকে ঠিকই, কিন্তু দুজনেই নিজেদের প্রজেক্ট ওয়ার্ক নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
অনুরাগ তাও মাঝে মাঝে বলে, এখানে চলো, ওখানে চলো কিন্তু বিপাশা বেরোতে চায় না।
আগের দিনগুলোর কথা ভেবে খুবই খারাপ লাগে অনুরাগের। চাকরী তো ওরা প্রথম থেকেই করে, তখন তো ঠিক সময় বের করতো নিজেদের জন্য।  আজ কি এমন হলো, ওদের নিজেদের জন্যও সময় নেই। যত দিন যেতে থাকে, চিন্তাটা ওকে গ্রাস করতে থাকে। তবে ও বিপাশাকে বোঝে না তা কিন্তু নয়। কোনোদিন ওদের মধ্যে ঝগড়াঝাটিও হয় নি। বিপাশা বরাবরই খুব শান্ত প্রকৃতির মেয়ে। খুবই বুদ্ধিমতী ও। রাতে শুয়ে  ঘুমন্ত বিয়াসের চোখে- মুখে ক্লান্তির ছাপ দেখে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিজেও কখন ঘুমিয়ে পড়ে অনুরাগ।
আগামী কাল অনুরাগের জন্মদিন। আজ ১১ই সেপ্টেম্বর।  আগের তিনটি বছর আজকের রাতেই  ঘড়ির কাঁটা ঠিক বারোটা ছুঁলেই বিয়াস ওর হাতে ছুরি ধরিয়ে দিত। ও কেক কাটতো। ঘরে মৃদু আলো আর মৃদু সুরে পছন্দের গান বাজতো।  তারপর দুজন মিলে একটু  গল্পগুজব করে ঘুমিয়ে পড়ত।
পরের দিনটা দুজনেই ছুটি নিত। সারাটা দিন দুজন মিলে ঘুরে, সিনেমা দেখে, রাতে বাইরে খেয়ে বাড়ী ফিরত। ওদের দুজনেরই জন্মদিন আর বিবাহবার্ষিকীটা ওরা এভাবেই কাটিয়ে এসেছে এই তিনটে বছর ধরে।
সন্ধ্যেবেলায় বাড়ী ফিরে ফ্রেশ হয়ে টিভি চালিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল অনুরাগ।
ওর আগেই অফিস থেকে ফিরেছিল বিপাশা।
কফি আর বিস্কুট নিয়ে এসে ওর কাছে এসে বসল। রাতের খাবারের অর্ডার দিয়েছে এটাও জানালো।
কফি খেতে খেতে অনেক কথাই হলো দুজনের।
কিন্তু কালকের অফিস ছুটির ব্যাপারে কোনো কথাই বলল না বিপাশা।  মনে মনে একটু অভিমান হলো অনুরাগের। অন্যান্য বছরগুলোতে ও বাড়ী ঢুকতে না ঢুকতেই ওর ছুটির খবর জানার জন্য ও উদগ্রীব হয়ে থাকে, কিন্তু আজ ওই ব্যাপারে একটাও কথা বলল না। রাত এগারোটার মধ্যে খাওয়া হয়ে গেলো।
একটু পর বিপাশা এসে শুয়ে পড়ল। খুব অবাক হল অনুরাগ। বারোটার আগেই ও শুয়ে পড়ল। ঘরে মোমবাতি,  কেক কিছুই তো আনে নি।
ওর পাশে এসে আলো নিভিয়ে ও নিজেও শুয়ে পড়ল। কিন্তু এক অজানা অভিমানে চোখে কিছুতেই ঘুম আসছিল না ওর। কি এমন হল, বিয়াস ওর জন্মদিনটাও ভুলে গেল!
একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়ল।
খোলা জানলা দিয়ে সকালের সোনালী রোদ্দুর ওর চোখ মুখ স্পর্শ করে জন্মদিনের একরাশ শুভেচ্ছা জানাল। চোখ খুলেই দেখল, ওর আগেই বিপাশা উঠে গেছে। প্রতিবার আজকের সকালে মিষ্টি করে ওর চোখে-মুখে-ঠোঁটে আলতো চুমু দিয়ে ওকে ঘুম থেকে জাগিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায় বিয়াস।তারপর  স্নান- পুজো সেরে ওর মাথায় ঠাকুরের পুষ্প ছুঁইয়েই বেরোনোর জন্য তৈরী হতে হতে ওকেও তাড়াতাড়ি তৈরী হওয়ার জন্য তাড়া লাগায়।
অনুরাগ ভাবলো, কাল নিশ্চয় কোনো কারণে ভুলে গেছিল। আজ হয়তো ও খুব আক্ষেপের সঙ্গে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে ওকে শুভেচ্ছা জানাবে। এই ভেবে ও শুয়েই রইল।
একটু পর বিপাশা চা এনে বলল——–” কি হলো, ওঠো এবার অফিস যাবে তো!”
ও অবাক চোখে বিপাশার দিকে তাকালো। ওর স্নান হয়ে গেছে, অফিসের জন্য প্রায় তৈরী ও।
ওর এমন আচরণে যারপরনাই বিস্মিত ও দুঃখিত হয়ে ওর হাত থেকে চা টা নিলো। একটু পর তৈরী হয়ে বিপাশার আগেই বেরিয়ে গেলো ও।
আজ ছুটি নিয়েছে। অফিসে তো যেতে পারবে না। কি করবে কিছু ভেবে না পেয়ে দক্ষিণেশ্বরে চলে এলো। মা ভবতারিণীর পুজো দিল। তারপর লঞ্চে করে গঙ্গা পেরিয়ে বেলুড় মঠে এলো। এখানের শান্ত পরিবেশে ওর অশান্ত মন কিছুটা হলেও শান্তি পেলো। ওর যখনই কোনো কারণে মন খারাপ হয়, খুব চাপে থাকে, তখন  এখানে চলে আসে।  প্রার্থনা গৃহে চুপচাপ বসে থাকে চোখ বন্ধ করে। আজও বেলা তিনটে পর্যন্ত বসে থাকল গঙ্গার পাড়ে।বিবেকানন্দের বাণী গুলো মনে মনে আউরালো একাকী নিরিবিলিতে বসে।
মন এখন অনেকটাই শান্ত ওর। বেশ হালকা লাগছে নিজেকে।  মনকে বোঝাল , সত্যিই তো একটা মানুষ যে সারাজীবন পাশে আছে, কাজের চাপে, সে যদি একটা বিশেষ দিনের কথা ভুলেই গেলো তার জন্য এতোটা কষ্ট পাওয়ার তো কিছু নেই। বাইরে বেরিয়েই বুঝতে পারলো খুব ক্ষিদে পেয়েছে ওর। সারাদিন কিছুই তো খাওয়া হয় নি। প্রসাদটাও একটু মুখে দিয়ে একটা ভিখারীকে দিয়ে দিয়েছিল।
সামনের একটা দোকানে ঢুকে পড়ল। গরম গরম হিংয়ের কচুরি আর চা খেলো। এরপর বাড়ীর দিকে রওনা দিল।
সবে সন্ধ্যা নেমেছে। বাড়ীর দরজায় এসে বুঝল,  বিপাশা ওর আগেই বাড়ী ফিরেছে। কলিং বেল বাজতেই  হাসিমুখে দরজা খুললো। ও ভিতরে ঢুকতেই ওকে জড়িয়ে ধরল ।
অনুরাগ বলল ——” ওহো, ম্যাডামের তাহলে মনে পড়েছে আমার কথা?”
ওর গালে জোরে একটা চুমু খেয়ে ওর হাত ধরে ঘরের ভিতরে যেতে যেতেই  বলল——” তোমায় আমি ভুললাম কখন অণু , যে আলাদা করে মনে পড়তে হবে?”
ঘরে ঢুকেই  আনন্দে নেচে উঠল অনুরাগের মন। ড্রয়িংরুমে হালকা আলো, আর হোম থিয়েটারে বাজছে—-” নয় নয় এ মধুর খেলা….!”
ফুল আর বেলুন দিয়ে সাজানো পুরো রুমটা।
টেবিলে ওর নাম লেখা কেক। ওকে জড়িয়ে ধরে বিপাশা বলল——-” যাও, ফ্রেশ হয়ে এসো তাড়াতাড়ি!”
ওর কপালে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে ও ফ্রেশ হতে গেলো। বাথরুম থেকে বেরিয়েই দেখলো খাটের উপর একটা প্যাকেট। খুলে দেখলো, ওর প্রিয় নীল রঙের টি-শার্ট। ওটা পরেই ড্রয়িংরুমে এলো। তারপর দুজন মিলে কেক কাটলো। এরপর ওরা দুজনে একসঙ্গে বসে টিভি দেখতে দেখতে কফি আর চিকেন পকোড়া খেলো।
বাড়ী ফিরে বিয়াসের এমন আন্তরিক আপ্যায়ণ পেয়ে ওর মন খুশিতে ভরে উঠেছিল, তাই জন্মদিন প্রসঙ্গে আর কোনো কথাই  বললো না। আজ অনেকদিন পর ওর বিয়াসের সঙ্গে ঠিক সেই আগের মতো করে অনেক গল্প করলো।
রাত দশটায় বিপাশা উঠে গেলো খাবার দেওয়ার জন্য।  একটু পরই ডাইনিং থেকে —-” অণু খেতে এসো! ” বলে ডাক পাড়লো।
ডাইনিংয়ে এসে টেবিলের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো অনুরাগ। সব ওর পছন্দের রান্না।  আর এগুলো কোনোমতেই হোম ডেলিভারির নয়। একরাশ আনন্দ নিয়ে খেতে বসলো। খেতে খেতে বিপাশাকে জিজ্ঞেস করলো——-” তুমি এতো কিছু কখন করলে বিয়াস?”
একমুখ হাসি নিয়ে বিপাশা বললো——” তুমি কি গো? ভাবলে কি করে, আজকের দিনটা ভুলে যাব।
আমি তো কালই অফিসে বলে এসেছি আজ ছুটি নেব। আজকের দিনটা একটু অন্যরকমভাবে তোমার কাছে হাজির করব ভেবেই আমি কাল থেকে ওমন ভুলে যাওয়ার ভান করছিলাম।
তুমি বেরিয়ে যাওয়ার পর একবার বেরিয়েছিলাম আর কেনাকাটা করে ফিরে, তারপর তোমার পছন্দের রান্নাগুলো করলাম।”
আনন্দে আপ্লুত হয়ে গেলো অনুরাগ।
বিপাশা বললো —–” খেয়ে নাও, তোমার জন্য একটা উপহার আছে।”
অনুরাগ বললো——–” এই যে টি-শার্ট দিয়েছ,  এরপরেও আরো উপহার?”
মুচকি হেসে বিপাশা বললো—– ” হ্যাঁ মশাই! “
খাওয়ার পর অনুরাগ খাটে শুয়ে টিভি দেখছিল। রান্নাঘরের কাজ শেষ করে এই ঘরে এলো বিপাশা।
তারপর আলমারি থেকে একটা খাম বের করে নিয়ে এসে অনুরাগের হাতে দিয়ে বললো—–” খুলে দেখো।”
খাম খুলে একটা মেডিকেল টেস্টের রিপোর্ট পেলো অনুরাগ। বিপাশার প্রেগন্যান্সি টেস্টের  রিপোর্ট। সেটা পজেটিভ।
আনন্দে পাগল হয়ে গেলো অনুরাগ। ও কিছু বলার আগেই বিপাশা বললো——- ” দিন তিনেক আগে অফিসে শরীরটা খুব খারাপ লাগছিল। আমার কলিগ মহুয়ার সঙ্গে গাইনোকলজিস্টের কাছে গেছিলাম। কালই টেস্ট রিপোর্ট পেয়েছি।  ভাবলাম তোমার জন্মদিনে দেওয়ার মতো এর চেয়ে বড় উপহার আর কি ই বা হতে পারে!”
অনুরাগ ওর বিয়াসকে বুকে জড়িয়ে ধরল। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিল ওর কপাল, চোখ, মুখ।
বিপাশা দেখলো, অনুরাগের চোখ বেয়ে গড়গড় করে জল পড়ছে।
ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো——” স্যার অনুরাগ বোস। এবার আপনি বাবা হতে চলেছেন। এমন ইমোশনাল হলে আর কি করে চলবে বলুন তো?
আপনার উপর এবার থেকে কতো দায়িত্ব পড়বে। এমন কথায় কথায় চোখ ভিজলে তো আর চলবে না।”
একবুক শান্তি নিয়ে বিপাশার কোলে মাথা রেখে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে অনুরাগ বললো——” আচ্ছা বিয়াস!”
‎বিপাশা—-” হু!”
‎অনুরাগ—–” ‘অণু’ মানে কি?”
‎বিপাশা —–” ছোটো।”
‎অনুরাগ———” আর তুমি আমায়  ‘অণু’  বলে ডাকো। তাই আমি কোনোদিনও বড় হবো না। ওইসব দায়িত্ব -টায়িত্ব তুমিই নিও। আমি আর আমার সন্তান দুজন মিলে তোমার ভালোবাসার ছত্রছায়ায় থাকবো!”
‎ওর কথা শুনে হাসলো বিপাশা,  তারপর ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললো—–” আচ্ছা আমার অণু, তাই হবে। চলো এবার ঘুমিয়ে পড়ো।”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।