গল্পকথায় শর্মিষ্ঠা সেন
দাম্পত্য
সুমনার ঘুম ভাঙে সকাল ছ’টায় ৷ সে যত রাতই হোক না কেন শুতে ৷ পুঁটি বলে মায়ের শরীরে ইনবিল্ট ঘড়ি আছে ৷ আজ ন’টা বাজতে চলল কেউ এখন চা খেতে আসেনি ৷
“কি গো ?
শুনছো ? কি হলো ! সাড়া দিচ্ছ না কেন? এই কি রে , তোর বাবা কোথায় ?” সুমনা অধৈর্য হয়ে ডাকে ৷
“মা, একটু দাড়ি ,কমা দেবে তো ! বাবা কলে আছে , কানে ইয়ারফোন !” পুঁটি সোফায় বসে বলে ৷
“সকাল সকাল ল্যাপটপ খুলে বসে গেছে ! কখন চা খাব ! তোদের মতো তো ন’টায় তো উঠিনি ! সব নবাবের মতো বেলাদুপুরে উঠবে আর আমি সকাল থেকে রান্নাঘরে খেটে মরব ! যেন আমার অফিস, আমার স্কুল ! শুধু খুন্তি নেড়েই জীবনটা শেষ হয়ে যাক আমার ! ব্রাশটাও করেনি তোর বাবা ৷ কী মানুষের সাথে ঘর করছি ! এরপর বেলা দশটায় বাজার যাবে , বারোটায় আসবে, রান্না খাওয়া শেষ হতে হতে আমার বারোটা বাজবে ! কোন নিয়ম কানুন নেই এই বাড়িতে ! এই , তুই ব্রাশ করেছিস ? জল খেয়েছিস ?”
“মা, মা, প্লিজ্ কাম ডাউন ! আজ শনিবার ৷ কেউ কোথাও যাবোনা আজ ! রোজই তো সকাল সকাল উঠি , শুধু শনিবার রবিবারই তো একটু…..” পুঁটি কথা শেষ করতে পারেনা ৷
“জানিস, বেলা করে শুয়ে থাকলে কী হয় ? শরীরে টক্সিন জমে যায় ! এমনিতেই তোর মুখে এত ব্রণ ! পেট পরিষ্কার না থাকলে কন্সটিপেটেড হয়ে যাবি , তারপর পাইলস হবে , তারপর রক্তশূণ্যতা ! একটার পর একটা রোগ লাইন দিয়ে আসবে !৷
“মা , মা গো ! আমার হয়েছে ৷”
“কী? ”
“পেট পরিষ্কার ৷
চেঁচিয়ো না আর ৷ চা করে খেয়ে নাও ৷ ” পুঁটি শান্ত স্বরে বলে ৷
“চেঁচাই তো তোদের ভালোর জন্য ৷ নইলে আমার কী ? আমি সারাজীবন নিয়ম মেনে চলেছি , আমার শরীর খারাপ করার মতো রোগ এখনও জন্মায় নি ৷”
“মা, নোভেল করোনা কিন্তু মারাত্মক ছড়িয়ে পড়েছে ! দিল্লীতে দুজনার খোঁজ মিলেছে…”
“রাখ তোর করোনা পারোনা….” সুমনা আবার মেজাজ হারায় ৷ খিদে পেলে আজকাল মাথা গরম হয় চট করে ৷ বয়স হচ্ছে ৷
“আরে সকাল সকাল পাগলের মতো এত চ্যাঁচাচ্ছো কেন ? রামানুজের সাথে একটা কল ছিল , মঙ্গলবার সাবমিশন , এমনিতেই শালা বাঁশ ঢুকে রয়েছে , তার মধ্যে তোমার শ্রিল্ ভয়েস….মাথাটায় চাপ ধরে গেল !” সুশান্ত শোবার ঘর থেকে অবশেষে বেরোয় ৷
“ও এখন আমার ভয়েস শ্রিল্ ! এই আওয়াজ শোনার জন্য বারো বছর আগে আটশো নশো করে টেলিফোন বিল দিতে মনে নেই ? এখন তোমার কোকিল চিল হয়েছে ! নরম কোলবালিশ মরা খেজুর গাছ হয়েছে ! শুষ্কং কাষ্ঠং ! শুনছিস তো পুঁটি ? দ্যাখ মেয়েমানুষের এই তো দাম ! যতই নামের পরে ডিগ্রী থাকুক সবসময় পুরুষমানুষের মন বুঝে চলা ! ধুর নিকুচি করেছে সংসারের ! এবার থেকে হোটেল সিস্টেম চালু হবে এই বাড়িতে ৷ যার যার তার তার ৷ খাবার দাবার থাকবে , যে যে যার যার মতো বেড়ে বেড়ে খাবে “৷ সুমনা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে ৷
“মা, বাবা, এস তো , চা খেয়ে নাও “৷ পুঁটি ওরফে পত্রালিকা চা নিয়ে আসে ৷
“তোর মায়ের প্রবলেমটা কী বলতো পুঁটলি ? শনিবারও শান্তিমতো ঘুমোতে দেবে না ! আর আজ তো মিটিং এ ছিলাম ৷ সাড়ে আটটায় উঠে আগে অফিসে ঢুকেছি ! আমার তো ছুটির দিন বলেও কিছু নেই আর ৷”
“আর আমার ছুটি আছে ? আমি তো টোয়েন্টি ফোর ইন্টু সেভেন ! ” সুমনা ফোঁস করে ৷ “আমি শুধু চাই তোমরা একটু ডিসিপ্লিন্ড্ ওয়ে তে চলো ৷” এই যে তুমি মুখ না ধুয়ে চায়ে চুমুক দিলে এটায় কত জীবাণু পেটে চলে গেল তোমার ধারনা আছে ?”
“আমি রাতে ব্রাশ করে শুয়েছি আর তা ছাড়া গরম চা জীবাণু মেরে ফেলে “৷ সুশান্ত ফুট কাটে ৷
“পুঁটলি কী খাবি বল ? চিকেন অর চিংড়ি ?”
” বাবা, আজ নিরামিষই হোক ৷ ঘরে যা আছে তা ই খাই ” পুঁটি সবদিক সামলে বলে ৷
“নিরামিষ কী করবো ? ডাল, আলুসেদ্ধ যে করব তাও হবেনা …একটাও আলু নেই ! এখন পৌনে দশটা , তোর বাবা কখন বাজারে যাবে ? কখন কী আনবে ? জলখাবার কখন হবে ? দশটার মধ্যে জলখাবার খেতে হয় ! খাবি আজ দুধ রুটি !” সুমনা বলে ৷ এখন আওয়াজ অনেক নরম ৷
“আমি বাইরে খেয়ে নেব ৷ শনিবার রুটি খেলে পাপ হয় ৷ রসরাজ থেকে কচুরি তরকারি আর গরম জিলিপি খাব ৷” সুশান্ত বলে অপেক্ষা করে পরবর্তী বোমার জন্য ৷
কিন্তু সুমনা কিছু বলে না দেখে সাহস পেয়ে পুঁটি বলে , “বাবা, আমিও যাব৷”
তারপর বাপ বেটি প্রায় পৌনে বারোটায় বাজার নিয়ে ফেরে ৷ অনেক সব্জী ,শাক -পাতা আর মায়ের পছন্দের দেশী মুরগী ৷ সুশান্ত মাংস ধুয়ে ম্যারিনেট করে দেয় ৷ পুঁটি সব্জী ধুয়ে আলাদা আলাদা কাপড়ের ব্যাগ এ পুরে ফ্রীজ এ ঢোকায়৷ সুমনা রান্না করে সজনে ফুলের বড়া, আর তেল গরগরে-লাল টকটকে দেশী মুরগীর পাতলা ঝোল ৷ দুপুর বেলা আড়াইটের মধ্যে খাওয়া দাওয়া সারা ৷ গরম ভাতে ঘি দিয়ে মচমচে বড়া ভাজা, মাংস আর সর্ষে পোড়া দিয়ে আমের টক ৷
বাজারে আজ সুন্দর আম উঠেছিল ৷