• Uncategorized
  • 0

গল্পকথায় মৃদুল শ্রীমানী

করোনা ও কাজলবরণী

প্রতিশ্রুতিবান সাহিত্যিক সৌরভ রায়ের মা মারা গেলেন। ফেসবুকে সহানুভূতির বন‍্যা। সবাই সবাইকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করছেন মাতৃহারা সৌরভের পাশে দাঁড়াতে।
এমন নয় যে সৌরভের মা অতি অল্পবয়সে মারা গেলেন। সৌরভের বয়স এখন সাতান্ন। আর তাঁর মায়ের সাতাশি বছর বয়স হয়েছিল। দুঃখ এই আমার বড়দা, মানে সৌরভের বাবা এখনো পর্যন্ত বেঁচে আছেন। জলদবরণ রায়কে পাড়ার সবাই বড়দা ডাকে। আমিও। তিনি ছিলেন পল্লীর হাইস্কুলের ডাকসাইটে হেডমাস্টার। এলাকার নামীদামী লোকজন অনেকেই তাঁর আমলে ইস্কুলের ছোঁড়া ছিলেন। সবাই নিজেকে বড়দার ছাত্র বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করত। এমনকি, এলাকার মন্ত্রী আর সাংসদ অবধি। সেদিন মন্ত্রী শরৎ সর্দার মশায় মাইকে বলেই ফেলেছিলেন, “আমার এই পিঠে বড়দা কত বেত ভেঙেছেন। তবে না আজ একটু ভদ্রসমাজে মিশতে পারছি।” আমি বড়দার মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম যে, বড়দা মন্ত্রী মশায়ের কথার বিন্দু বিসর্গও বুঝতে পারছেন না। একেবারে সব সময় যাঁরা কাছে কাছে থাকেন, তাঁদের ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে আন্দাজে কাজ চালান বড়দা। সেদিন নবাগত আইএএস এসডিও সাহেবকে তিনি বলে বসলেন, “কিরে, তুই কত সালে পাশ করেছিস্? ” এসডিও সাহেব বড়দার মুখে তুইতোকারি শুনে হতভম্ব। আমরা পরিস্থিতি সামাল দিতে বড়দার কানে চেঁচিয়ে বললাম, উনি খড়্গপুর আইআইটির ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের নতুন এসডিও।
বড়দা হাসিমুখে বললেন, “ভাল ভাল, তোরা সবাই মিলে ইশকুলের মুখ উজ্জ্বল ক‍র্। “
আমাদের বড়দা, মানে জলদবরণ রায়, কাজলবরণী রায়কে যে বৎসর বিয়ে করেন, সে বৎসর এলাকায় বাঁধ ভাঙা বন‍্যা হয়ে নিচু এলাকাগুলি ডুবে গিয়েছিল। তখন হেডস্যার হিসেবে তিনি স্কুলের ক্লাসঘরগুলি দরিদ্র মানুষের জন্য খুলে দেন। নববিবাহিতা কাজলবরণী দেবী সর্বসমক্ষে নিজের ভারি সোনার বালাজোড়া খুলে স্বামীর হাতে দিয়ে বলেছিলেন, এই গহনা দিয়ে আপনি এঁঁদের খাবারের ব‍্যবস্থা করুন। অমনি এলাকার ভদ্রলোকেদের চোখে জল। সবাই টাকা যোগালেন। এমনকি বালাজোড়া যে সাউয়ের হাতে বন্ধক দেবার কথা, তিনি হেডস্যারের পা ছুঁয়ে বললেন, ওই টাকাটা আমি এমনি‌ই দিচ্ছি। গহনা বৌমার হাতে থাকুক।
সেইদিন কাজলবরণী দেবী সমবেত ভক্তিবিহ্বল মানুষের সামনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নগরলক্ষ্মী। তা শুনে স্কুলের প্রেসিডেন্ট, যিনি এই এলাকার বনেদি জমিদার বাড়ির বড়ছেলে, তিনি বললেন, বন‍্যা মিটে গেলে আমাদের একটা সাহিত্য সভা হবে। স্কুলে কোনো একটা রবিবার বিকেলে সাহিত্যসভা বসবে। সভার নাম হল “পূর্ণিমা সাহিত্যবাসর।” এভাবেই পঁয়ত্রিশ বছর চলার পর,  বছর কয়েক হল, আমরা “বাসর” কথাটি বদলে ‘উদ্ভাস” শব্দটি এনেছি। জমিদারবাবুর প্রথমা স্ত্রী অল্পবয়সে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা যান। তার মাস তিনেক পর জমিদারবাবু পুনরায় দারপরিগ্রহ করেন। প্রয়াতা প্রথমা বধূর নাম ছিল পূর্ণিমা। দুষ্টু লোকজন বলে, সাহিত্যসভার নাম পূর্ণিমা রেখে, তিনি নিজের স্ত্রীর স্মৃতিরক্ষা করলেন। জীবৎকালে জমিদারবাবুই ছিলেন সাহিত‍্যসভার স্থায়ী প্রেসিডেন্ট। তিনি গত হবার পর থেকে জলদবরণবাবু সভার স্থায়ী প্রেসিডেন্ট।
জমিদারবাবু কাজলবরণী দেবীকে চেপে ধরেছিলেন, তাঁর স্কুলে শিক্ষকতা করতে হবে। নববিবাহিতা কাজলবরণী তখন স্বামীর উৎসাহ উদ্দীপনায় সদ‍্য আইএ পাশ করেছেন। বিদ‍্যালয়ের প্রেসিডেন্ট সাহেবের উৎসাহে কাজলবরণী শিক্ষকতায় বৃত হলেন। জলদবরণ ও কাজলবরণী আমাদের মহকুমায় প্রথম শিক্ষক দম্পতি।
তো এত কথা বলার কারণ এই যে , প্রতিশ্রুতিবান সাহিত্যিক সৌরভ রায়, তার বাবা জলদবরণ রায়ের মতোই একজন শিক্ষক এবং সাহিত্যিক। সৌরভের স্ত্রীও একজন বিদ্যালয় শিক্ষক।
কিন্তু জলদবরণ বাবুর মন্দকপাল। দু দুটো ছেলের কেউ তাঁর কাছে থাকে না। ওঁর বড়ছেলে সৌমিত্র কলকাতার একটি কলেজে লেকচারার। আর বৌমাটি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। সৌরভ আর তার স্ত্রী দুজনেই শিক্ষকতা করে দুর্গাপুরে। জলদবরণ আর কাজলবরণী আমাদের বাঁকুড়ায় সাহিত্যিকদের নিয়ে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন।
আমিও শিক্ষক জীবন থেকে অবসর পেতেই বাঁকুড়ার সাহিত্যিককুল আমাকে চেপে ধরল পূর্ণিমা সাহিত্যসভার সম্পাদক আমাকেই হতে হবে। আমি নিমরাজি হয়ে সেই দায়িত্ব নিতেই পল্লীর পাঠাগারটির দায়িত্ব পালনের ভারও আমার উপর চাপানো হল। সাহিত্য সভার সম্পাদক হ‌ওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। রাস্তায় বেরোনো মুসকিল হয়ে যায় মাঝে মাঝে। নতুন কবি যাঁরা, তাঁরা সম্পাদক দেখলেই ঝুলে পড়েন। তাঁর কবিতা শুনতে হবে। শুনে সমালোচনা করতে হবে। বলেন বটে সমালোচনা। কিন্তু ওঁদের লোভ থাকে গ‍্যাদগেদে প্রশংসার দিকে। প্রশংসার ভাগে কিছু কম পড়লেই রুষ্ট হন কবিরা। আর কিছু আছেন গিন্নিবান্নি কবি। তাঁদের অখণ্ড অবসর। স্থূলকায়া, বাত বেদনায় মন্দগমনা এই সব মহিলা কবি আমাকে ফোনে যারপরনাই বিরক্ত করেন। তাঁদের কবিতায় ছন্দ মিলিয়ে দিতে বলেন। পছন্দের ব‌ইটি লাইব্রেরি থেকে তুলে তাঁদের দোতলায় পৌঁছে দিতে পর্যন্ত বলেন। আমি সাহিত্যসেবার স্বার্থে এগুলি অম্লানবদনে করে থাকি।
শিক্ষকতা থেকে অবসরপ্রাপ্ত জীবনে আমার মূল কাজ দাঁড়িয়েছিল বড়দাকে সকালে তিন তিনটি কাগজ পড়ে শোনানো। ইদানীং তাঁর কান একেবারে জবাব দেওয়ায় খবরের কাগজের হেডলাইনগুলি কোনো মতে দেখে রেখে দেন। তার পর ওঁর লেখা যে সব পত্র পত্রিকায় সম্প্রতি বেরিয়েছে, তা বের করে দেখাতে হয়। প্রকাশিত লেখাগুলির উপর তিনি পরম মমতায় হাত বুলান। তারপর পুরানো ডায়েরি বের করতে হয়। সেখানে নানা লেখালেখির খসড়া। সেগুলি নেড়েচেড়ে দেখে বলেন, লেখাগুলি সেরে ফেলে জলদরচনাবলী বের করতে হবে।
এরপর তিনি বাজারে বের হন। রোজ তাঁর তিন চার রকম মাছ কেনার হুকুম হয়। অনেক আগে তিনি ভোজন রসিক ছিলেন। এখন পেট জবাব দিয়েছে। পেঁপে ও কাঁচা কলা সহযোগে শিঙিমাছের ট‍্যালটেলে ঝোল ছাড়া কিছুই সহ‍্য হয় না। তবুও বায়না ধরেন মাছ কিনব। মাছ‌ওয়ালা চেনে বড়দাকে। আমার অনুরোধে মাছ‌ওয়ালা মাছ বিক্রি করার অভিনয় করে। খাওয়ার পাতে রকমারি মাছ না দেখতে পেলে বড়দা রাগারাগি শুরু করেন। তখন পোষা বিড়ালের উপর চুরির অপবাদ দিয়ে সমস্যা সমাধান করতে হয়।
বড়দা ব‍্যাঙ্কে যেতে ভালবাসেন। আমি যত বলি, আপনি আর বৌদি দুজনে মিলে অনেক কটা টাকা পেনশন পান। ফিক্সড ডিপোজিটও বিস্তর। সুদ বাড়ছে না কমছে অত আর হিসাব রাখার প্রয়োজন নেই। পেনশনের টাকার পাঁচ ভাগের একভাগ খরচা করে উঠতে পারেন না। সুদের টাকায় তো হাত‌ই পড়ে না। তবু তিনি মাঝে মাঝেই বায়না ধরেন ব‍্যাঙ্কে যাবেন। প্রথম প্রথম ব‍্যাঙ্কের ম‍্যানেজার সম্মান দেখিয়ে সব কথার উত্তর যত্ন করে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করতেন। এখন আমি রিকশা করে বড়দাকে ব‍্যাঙ্ক দেখিয়ে আনি। আর ম‍্যানেজার সাহেবের ঘরে উঁকি দিয়ে আসার অভিনয় করে বলি ম‍্যানেজার সাহেব এনপিএ কমাতে ডিফল্টারদের বাড়িতে তাগাদা দিতে গেছেন।
রিকশা চালককে কিছুতেই পাঁচটি টাকার বেশি ভাড়া দিতে চান না বড়দা। আমি তাকে চোখটিপুনি দিই। ইঙ্গিতে বলি পরে আমি বাড়তি টাকা দেব। সে আমাকে খুব চেনে ও অগাধ বিশ্বাস করে। আমি বড়দার টাকা টেবিলে গুছিয়ে রেখে তার থেকে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট নিয়ে রিকশাওলাকে দিলে সে অত্যন্ত খুশি হয়ে চলে যায়। বড়দা আমাকে বলেন, যার যা প্রাপ‍্য তাকে তার বেশি দেওয়া উচিত নয়।
কিন্তু ছোটছেলে সৌরভকে তিনি অত্যন্ত ভালবাসেন এবং তার ছেলের পড়াশোনার খরচের জন‍্য মাসে মাসে কুড়ি হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন।
আমি যত তাঁকে বোঝাই সৌরভ এবং বৌমা দুজনে মিলে মাসে একলক্ষ টাকার উপর বেতন পান, তাই সন্তানের পড়াশোনার খরচ তাঁরা ভালভাবেই সামলাতে পারবেন, বড়দা সে কথা মোটেই বুঝতে চান না। আমি বলি এইটাকায় অনেকগুলি আদিবাসী ছাত্র ছাত্রীকে পড়ার খরচ যোগানো চলে, বড়দা সে কথা কানে তোলেন না।
অথচ সৌরভ বা বৌমা, দুজনের কেউই বড়দা বা বৌদিকে ফোন করে না। বড়দা রোজ দুবেলা ফোন করে খবর নেন। ইদানীং বড়দা ফোন করলে সৌরভের ফোন যান্ত্রিক কণ্ঠে বলে চলে যে সৌরভ ব‍্যস্ত। বৌদি ফোন করলে সৌরভ বলত সে কোনো সাহিত্য সভায় রয়েছে বা প্রবন্ধ লিখছে। এইসব সময় আমি বড়দার থেকে ফোন চেয়ে নিয়ে কাল্পনিক সংলাপ জাল বিস্তার করে সৌরভ যে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার যাত্রা নির্বাহ করছে, সে কথা বলি। বড়দা খুশি হন।
সপ্তাহে অন্ততঃ একবার বড়দা ও বৌদির ঝগড়া হয়। গীতবিতান বা সঞ্চয়িতা ব‌ইখানা ঠিক যেখানে থাকার কথা, সেখানে নেই কেন, অথবা ব‍্যাঙ্কের পাশব‌ই কোথায় গেল, বা এল‌আইসি পলিসি বণ্ড কোথায় আছে, ইত‍্যকার ছোট ছোট বিষয় নিয়ে দুজনের রাগারাগি। অথচ কে বলবে, আমাদের অল্প বয়সে আমরা সর্বদা ওঁদের হাসিখুশি দেখতাম। তখন আমি আসরে নেমে অল্পক্ষণের মধ‍্যে পাশব‌ই বা পলিসি বণ্ড বা ইনকাম ট‍্যাক্সের ফাইল খুঁজে হাতে ধরিয়ে দিলে বড়দা খুব খুশি হতেন। পাঁচ মিনিট পরেই বুড়ো বুড়ি স্বামী স্ত্রীর মধ‍্যে আবার খুব ভাব হয়ে যেত।
ঝগড়া বাধত আমার সংসারে। গিন্নি রাগ করতেন তিন দিন হল তোমাকে বলেছি গোলমরিচ গুঁড়া ফুরিয়ে গেছে, তুমি আনার সময় পাও না। আমি তখন রান্নাঘরে আলমারিটি খুঁজে একটি গোলমরিচ গুঁড়ার অক্ষত প‍্যাকেট বের করে দেখিয়ে দিলে গিন্নি বলেন, সারাদিন তুমি যদি বাইরে বাইরে কাটাবে ভেবে থাকো, তাহলে আমায় কোনো বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসো। ওঁর চোখে জল দেখে আমারও কান্না পায়। আমি কান্না আটকাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ধরি। কান্না আমার গলা দিয়ে না বেরিয়ে দুচোখ ভাসিয়ে বেরিয়ে আসে।
পরদিন সকালে আবার ফিরে যেতাম এক‌ই ঘটনাবৃত্তে। একবার বড়দাকে নিয়ে ভারি বিপদে পড়লাম। বিডিও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল নিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, আইসিডিএস কর্মী আর আশাকর্মীদের মিটিং ডেকেছেন। আমি এলাকার উৎসাহী সাহিত্য কর্মী, তথা অবৈতনিক লাইব্রেরিয়ান আর অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হিসেবে বিডিও সাহেবের সাথে যোগাযোগ রাখতাম। স্বাস্থ্য বিষয়ক সভার কথা শুনে ওঁকে বলে বসলাম আমাদের জলদবরণ রায় মশায়কেও সভায় ডাকুন। কোথাও যাওয়া হয় না ওঁর। আজকাল সাহিত্য সভাতেও বিশেষ লোক জোটে না। নিজের লেখাটা পড়েই সকলে কাজের বাহানা করে কেটে পড়ে। এখানে অনেক লোকের সমাগম দেখে উনি খুশি হবেন।
বিডিও বললেন, ওঁর বয়স হয়েছে, ওঁকে কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে?
আমি লক্ষ্য করেছি কোনো পত্র পত্রিকা এলে বড়দা আগে জানতে চান সেখানে তাঁর লেখা আছে কিনা। বৌদি বোঝান, তুমি কি লেখা দিয়েছ, যে তারা ছাপাবে? বড়দা আশা করেন যে লিটল ম‍্যাগাজিন সম্পাদক তাঁর বাড়ি এসে হাত কচলাতে কচলাতে লেখা চাইবেন, আর তিনি পুরোনো ডায়েরি থেকে একটা লেখা কপি করে নিয়ে যেতে বলবেন। পাড়ায় কোনো স‍্যুভেনির বের হলে বড়দা চান যে সেখানে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর নাম থাকবে। তো এই জনস্বাস্থ্যসভার সুযোগে বড়দাকে একটু খুশি করতে চেয়ে বিডিও সাহেবকে বললাম, বুড়ো হয়েছেন বলেই লোকজন দেখতে পেলে খুশি হন।
উপরোধে ঢেঁকি গেলার মতো করে বিডিও রাজি হলেন বড়দাকে আসতে বলতে। একটা কমপিউটারে মুদ্রিত বাংলালিপির আমন্ত্রণ পত্র‌ও তিনি বাহক মারফত বড়দার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। পরদিন সকালে বড়দার কাছে যেতে বড়দা খুব তৃপ্তির হাসি হেসে আমায় আমন্ত্রণ পত্রটি দেখালেন। বললেন, বিডিও ছেলেটি খুবই ভাল। বয়স্ক লোককে মান‍্যগণ‍্য করে। আমি হাসি চেপে চিঠি হাতে নিয়ে অবাক হবার ভান করলাম।
দুপুরবেলা মিটিং। বড়দা এদিন আর দিবানিদ্রাকে প্রশ্রয় দেন নি। আমার হাত ধরে ঠুক ঠুক করে বিডিও অফিসের ভিতরে হল্ এ ঢুকলেন আর ঢুকেই অন‍্যান‍্য অফিসারদের অবাক করে তিনি সোজা স্টেজে উঠে পড়লেন। আমি অপ্রস্তুত। বিডিও আমার দিকে মুচকি হাসি হেসে বললেন, প্রবীণ মানুষ। থাক। উনিই মাঝখানে বসুন।
হলে খুব বড় করে একটি বিদ‍্যাসাগর মহাশয়ের প্রতিকৃতি ছিল। সভার সূচনা হতেই বিডিও সাহেবের সামনে থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে বড়দা বিদ‍্যাসাগর ও বিধবা বিবাহ আন্দোলন  এবং তাঁর হোমিওপ্যাথি চর্চা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শুরু করে দিলেন। হাসপাতালের ডাক্তাররা ব‍্যস্ত মানুষ। স্বাস্থ্য বিষয়ক সরকারি সভায় তাঁরা বিদ‍্যাসাগর মহাশয়ের হোমিওপ্যাথি চর্চা শুনবেন কেন? পিছনে আশাকর্মীদের মধ‍্যেও চঞ্চলতা দেখা গেল। জয়েন্ট বিডিও সাহেব বড়দাকে বলতে গেলেন, এই সভা বিদ‍্যাসাগর মহাশয়কে নিয়ে নয়। এই বলতে গিয়ে প্রাক্তন প্রধান শিক্ষকের কাছে তিনি প্রবল ধমক খেলেন।
বড়দা কড়া গলায় বললেন, আমি যা বলছি মন দিয়ে শোনো। তাহলে তোমাদের মানুষ হতে সুবিধা হবে।
বিডিও সাহেব মাথায় হাত দিয়ে বসে র‌ইলেন। এমন সময় নিরুপায় হয়ে আমি বড়দার পিছনে গিয়ে বললাম, বাড়িতে সৌরভ এসেছে। বৌমাও এসেছে। কিন্তু নাতিকে আনে নি বলে, চলে যাবার জন‍্য ছটফট করছে।
অমনি বড়দা ঝটপট করে মাঝপথে বক্তৃতা থামিয়ে বাড়ির দিকে র‌ওনা হলেন। আমাকে ভার দিয়ে গেলেন বাকি কথাটা বলে দিতে। আমি বিডিওর মুখের দিকে চাইতে পারছিলাম না।
বাড়িতে ফিরে সৌরভকে ফোন করলাম। কয়েকবারের চেষ্টায় তাকে ধরে ফেললাম। সব শুনে সে বলল, বাবাকে বাড়ির বাইরে অন‍্য লোকজনের সঙ্গে আর কথা বলতে দিও না। এটাকেই ভীমরতি বলে। বাড়ির মধ‍্যে সামলে সুমলে রাখো।
আমি তাকে বললাম, তা তুমি তোমার বাবা মাকে এবার কাছে নিয়ে রাখো। দুজনেই খুব অবুঝ হয়ে উঠেছেন।
প্রতিশ্রুতিবান সাহিত্যিক সৌরভ বলল, সুদীপদা, এই তুই আমায় ভালবাসিস? জানিস না, আমি ডক্টরেট করছি, আর বুড়ো এখন এখানে এসে ঘাঁটি গাড়লে আমার পিএইচডি’র দফারফা হয়ে যাবে।
আমি বললাম, দ‍্যাখো, তোমাদের কাছে পাবেন বলে ওঁরা ছটফট করেন। তুমি একটু ফোনে কথা বললেও তো সন্তান হিসেবে কর্তব্য পালন হয়।
সৌরভ আমায় বলল, সুদীপদা তুইও শেষ পর্যন্ত একটা জ্ঞানদাচরণ হয়ে গেলি? জানিস্, নামের আগে একটা “ডঃ” না লাগালে আজকাল কেউ পাত্তা দেয় না? একটা “ডঃ” না লাগিয়ে আমি অন‍্য কোনো দিকে তাকাব না।
পরদিন সকালে আমি বড়দার বাড়ি গিয়ে দেখা করতে তিনি বললেন, সুদীপ, তুমি দরকারি খবরটা দিতে বেশ একটু দেরি করেছিলে। ওরা অনেকক্ষণ বসে থেকে আমার দেরি দেখে চলে যেতে বাধ‍্য হয়েছিল। বৌদি আমায় আড়াল থেকে চোখ টিপলেন।  তারপর বড়দা বললেন, ওরা ভাল ভাল মিষ্টি এনেছিল। তুমি তো জান, আমার পক্ষে মিষ্টি খাওয়া বারণ। তবুও ছেলে বৌমা এনেছে বলে কথা। কাজল, বৌদিকে হাঁক পাড়েন বড়দা, কোথায় গেলে, সুদীপকে একটু মিষ্টি দাও। খাক্।
বিশীর্ণ হাতদুটো একটা স্টিলের প্লেটে বাড়ির পাশের দোকানের মিষ্টি আমার হাতে তুলে দিল। কাজলবরণী রায়। আমাদের সর্বজনপ্রিয় বৌমণি। যে বৌদি একদিন মুখ ফসকে একটা কথা বললে, পাড়ার যে কোনো তরুণ যুবক, যে কোনো কাজ করতে একপায়ে খাড়া হয়ে যেত, আজ নিজের পেটের ছেলেরা তাঁর খোঁজ খবর রাখে না। বাপ মায়ের পেনশনের টাকা নিতে ওদের বাধে না, কিন্তু ফোন করলে ব‍্যস্ততার ভান দেখায়। এই কি প্রাপ‍্য ছিল কাজলবরণী মায়ের?
আমি চোখভরা জল নিয়ে অন‍্যদিকে চেয়ে র‌ইলাম। রাতে সৌরভকে ফোন করে বললাম, তোমার ডিগ্রি লাভ হয়েছে, সুখ‍্যাতি লাভ হয়েছে, আজ নানা জার্ণালে লিখে তোমার অনেক প্রশস্তি। এবার বৃদ্ধ বাপ মাকে শেষের কটা দিন একটু দেখাশুনা করো। ওঁরা তোমাকে পৃথিবীতে এনেছেন, এখন সুপুরুষ হয়েছ। বাপ মাকে শেষের দিনগুলো একটু দয়া করো।
সৌরভ বলল, সুদীপ দা, একটা ভালো দেখে বৃদ্ধাশ্রম দ‍্যাখ্। বাবা মায়ের টাকার তো অভাব নেই।
মনে মনে বললাম, সৌরভ, দেড় কোটি টাকার বেশি ফিক্সড ডিপোজিট আছে ওঁদের। তার উপর এল‌আইসি। আবার এই বাড়ি। সব‌ তো তোমরাই দুভাই পাবে। নিজের বাপ মাকে নিজেরা দেখবে না?
বড়ছেলে সৌমিত্রকে বলতে সে বললো আমাদের কলকাতার ফ্ল্যাটে জায়গার কোনো অভাব নেই। কিন্তু আমাদের সময় কোথায়? আমাদের বাড়িতে রান্নাবান্নার পাট নেই। হোম ডেলিভারি। মা বাবার মুখে রুচবে না। আর আমাদের লাকি ডগিকে বাবা মা পছন্দ করবে না।
সৌমিত্রকে মনে মনে বললাম, তোমার ফ্ল্যাটে কুকুরটা প‍র্যন্ত লাকি। শুধু জন্মদাতা জনক জননী আনলাকি।
বৌদি ইদানিং ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কিডনি বিকল হয়ে গেছে। ডায়ালিসিস করাতে নিয়ে যেতে হয় জেলার সদর হাসপাতালে। লিভার খুব বড় হয়ে ঠেলে উঠেছে। আমার দিকে চেয়ে হেসে বললেন, ঠাকুর পো, এই অসুখগুলো সব তাঁর চিঠি। তিনি এবার ডাক দিয়েছেন। তোদের দাদাটার দায়িত্ব তোকেই দিয়ে যাব। বলতে বলতে বৌদির গলা কেঁপে গেল। কাজলবরণী। যাঁকে বালক বয়সী আমি গোপনে ভালবাসতাম। আমার বয়সী সকলেই ভালবাসত। আজ তাঁর যাবার সময় এল। সৌরভ সৌমিত্র কাউকে তিনি কাছে পাবেন না।
বৌদিকে দেখাশুনার জন‍্য দুজন মহিলাকে নিয়োগ ক‍রলাম। শাড়ি আর সামলে উঠতে পারেন না। তাই ম‍্যাকসি পরিয়ে রাখার বন্দোবস্ত হল। অন্তর্বাসহীন ম‍্যাকসি পরে কাজলবরণীর সে কি সংকোচ। শুয়েছিলেন। তবু গায়ে বাড়তি কাপড় চাপাতে হাতড়ে বেড়ান। আমি তাঁর কপালে চুমো খেয়ে বললাম, বৌদি তুমি আমার কোন্ ছোটবেলায় হারানো মা। বৃদ্ধার চোখের কোণ দিয়ে জল পড়তে লাগল।
পরদিন দুপুরে গিয়ে শুনলাম সৌরভ তার মায়ের যত্ন নিশ্চিত করতে তার বাড়ির কাছে নার্সিং হোমে নিয়ে গিয়েছে। সেখানে চব্বিশ ঘণ্টা মনিটরিং। মুহুর্মুহু রক্ত মূত্র লালা পরীক্ষা করে রোগ নির্ধারণ করার ব‍্যাপক আয়োজন। আমি মনে মনে হাসলাম। কাজলবরণী গো, ছেলের হাতের আদর চেয়েছিলে, দ‍্যাখো পাও যদি।
ডাক্তার ফিরিয়ে দিল কদিন বাদেই। মাল্টি অরগ‍্যান ফেলিওর।  নল গুঁজে যে কদিন চলে। আমরা স্বামী স্ত্রী পালা করে রাত জাগছি। কাজলবরণী বড়খোকা ছোটখোকার সাথে দেয়ালা করেন। পড়তে বসো। দুষ্টুমি করতে নেই। বাবা এলে বলে দেব। তখন বাবা আর আদর করবে না।
আমি দরজার বাইরে মাটিতে থেবড়ে বসে আছি। জলদবরণ আবৃত্তি করছেন, “আর কতদূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী, বলো কোন্ পার ভিড়িবে তোমার সোনার তরী… ” একের পর এক রবীন্দ্র কবিতা আনমনে বলে যেতেন অর্ধচেতন জলদবরণ, এক সময়ের ডাকসাইটে হেডমাস্টার। তাঁর ছাত্র এখন মন্ত্রী। স্বপ্নের ঘোরে তাঁকে ডাকেন। বলেন, তোকে কতবার বলেছি এখানে হাসপাতালের উন্নতি কর্, কথা শুনিস না কেন? কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক্ ।  আরেক ছাত্র এম পি। তাকে ডাকেন। এম পি ল্যাড থেকে টাকা দিয়ে ভাল অ্যাম্বুলেন্স কিনে দে। আমি না হয় পারছি। আমার অভাব নেই। কিন্তু গরিব গুরবোকে যদি না দেখবি তো ভোটে দাঁড়িয়েছিলি কেন, হতভাগা? বেতের বাড়ি মেরে লাল করে দেব।
কাজলবরণী কী যেন বলছেন। আমার কান খাড়া। শ্রীমতী একটু ঝিমিয়ে পড়েছেন। তাঁকে বলি, শোনো তো কি বলছে?
তিনি বলেন, বিকারে বলছে।
আমি বললাম, কি বলছে শোনোই না।
শ্রীমতী বললেন, ওগো মিষ্টি খেতে চাইছে। তুমি এখনি টাটকা মিষ্টি আনো।
আমি বললাম, সে হয় না সুস্মিতা।
তিনি বললেন, শেষ ইচ্ছেটুকু পূরণ করে দাও গো। জন্মের শোধ।
কঠিন হয়ে বললাম, না, মিষ্টি বৌদিকে দেওয়া যাবে না। খুব হাই সুগার। ওঁর পক্ষে বিষতুল‍্য।
সুস্মিতা কাঁদছেন। বলছেন বড়দাকে ডাকো। গলা ঘড়ঘড় করছে। আর বেশিক্ষণ উনি থাকবেন না শরীরে।
বড়দা আচ্ছন্নের মতো কাছে এসে বসলেন। সুস্মিতা বড়দার সামনে সর্বদা দূরত্ব রাখতেন। আজ বড়দার একেবারে কাছে এসে তিনি বললেন বড়দা গীতা বলুন,
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ
নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা নো ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন‍্যতে হন‍্যমানে শরীরে।।
সুস্মিতার কথা কানে না নিয়ে বড়দা বললেন ,
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে,
হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত;
তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।
তোমার জ্যোতিষ্ক তারে
যে পথ দেখায়
সে যে তার অন্তরের পথ,
সে যে চিরস্বচ্ছ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তারে চিরসমুজ্জল।
বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু,
এই নিয়ে তাহার গৌরব।
লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত।
সত্যেরে সে পায়
আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে।
কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে,
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে
আপন ভাণ্ডারে।
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।
সুস্মিতা কেঁদে উঠে বললেন, বড়দা গীতা বলুন। আমার সঙ্গে বলুন
নৈনং ছিন্দতি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত‍্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ
সুস্মিতাকে বললাম, তুমিই গীতা বলো। বড়দা তাঁর গীতা ঠিকঠাক বলছেন।
রাত নয়টার দিকে সৌরভ এসে পৌঁছনোর পর আমরা মৃতদেহ সৎকার করতে স্থানীয় শ্মশানে যাবার উদ্যোগ নিতে এলাকার কিছু লোক বলল, করোনার মড়া এখানে পোড়াতে দেব না।
সৌরভ ফুঁসে উঠল, কে বলল, আমার মা করোনায় মরেছে?
সৌরভকে এলাকার লোক চেনেই না। বিডিও এলেন। থানার ওসি এলেন। উন্মত্ত জনতা বুঝতে চায় না। শেষ কালে বিডিও সাহেব আমার মুখ চেয়ে শববাহী গাড়ি করে জেলা সদরে ইলেকট্রিক চুল্লীতে মরদেহ পাঠাবার ব‍্যবস্থা করে দিলেন।
রাত তিনটার দিকে কাজলবরণীকে অগ্নিশুদ্ধ করে আমি শ্রীমতীকে নিয়ে নিজের ঘরে ফিরলাম।
সকালে উঠে দেখি ফেসবুক পাড়ায় হ‌ই হ‌ই। প্রতিশ্রুতিবান সাহিত্যিক সৌরভ রায়ের মাতৃবিয়োগে তার বন্ধুরা ভার্চুয়াল জগতে পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমি সকালেই বড়দার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সৌরভ বলল, সুদীপ দা, বাবাকে দেখিস। বলতে ইচ্ছে করল, সে তুমি বললেও দেখব, না বললেও দেখব।
সুদীপ বলল, এখন করোনার সময়। এখন বাড়ি ছেড়ে থাকা শক্ত। আমায় যেতে হবে বাবা। তোমার বৌমা আর নাতি একলা আছে।
বড়দা তার কথায় কান না দিয়ে বললেন, বয়সে বড় হলে তার অশৌচ লাগে না। সুদীপ, আমি মাছ মাংস সব খাব। তুই নিয়ে আয়।
আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *