সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে দেবব্রত রায় (পর্ব – ১)
ভুলভুলাইয়া-র হাট
(পর্ব – ১)
সেবার কোনো নামিদামি জায়গায় বেড়াতে যাব না ভেবেই হিমালয়পর্বতমালার দেশ নেপাল আর, বিহারের ঠিক মাঝামাঝি একটা অখ্যাত গ্রামে গিয়ে উঠলাম। বিভূঁই জায়গায় ভরসা বলতে বন্ধু রবিউলের নানাসাহেবের একখানা টালি-ইঁটের তৈরি পুরানো কোঠাবাড়ি। সেটাকে আশ্রয় করেই কয়েকদিনের জন্য সস্ত্রীক ডেরা নিলাম। সঙ্গে বৃদ্ধ চাকর কাম গার্জেন রামদীন।
শহুরে চোখে গ্রামটাকে আর পাঁচটা গ্রামের মতোই সাধারণ মনে হলেও, রবিউলের নানাসাহবের কোঠাবাড়িটা কিন্তু প্রথম দর্শনেই আমার ভালো লেগে গেল। এখানে পৌঁছানো ইস্তক সমস্ত বাড়িটা-ই ঘুরে ঘুরে দেখে নিচ্ছিলাম। টুকরো টুকরো রঙিন কাঁচের জাফরি দিয়ে ঘেরা প্রসস্ত বারান্দাসহ অপূর্ব নক্সা-সমৃদ্ধ খিলান দিয়ে তৈরি ভেতর-বাড়িটা যেন এই অজ পাড়াগাঁয়ে পৃথক একটা দ্বীপভূমির মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। লক্ষ্য করলাম, বাড়িটার ঠিক সদর দরজার পাশেই রয়েছে লাল ইঁটের তৈরি একখানা পাতকুয়ো। পাতকুয়োটা সম্বন্ধে রবিউল বলেছিল, এ গাঁয়ের সবাই এই পাতকুয়োর জল খেয়েই তৃষ্ণা মেটায়। রোগ-জ্বালা হলে গাঁয়ের লোকজন হাকিম- বদ্যি-র কাছে যায় না। মনে মনে মানত করে কুয়োর জল খেলেই নাকি, তাদের সব ব্যাধি সেরে যায়। কুয়োটাকে আসপাশে-র সমস্ত গ্রামের মানুষজন-ই পীরবাবার কুয়ো বলে মান্যি করে, পুজো-আচ্চা দেয়। প্রতি শুক্কুরবার শুক্কুরবার সিন্নি চড়ায়।
আমি কুয়োটার ভিতর উঁকি মেরে দেখলাম , কাকচক্ষু-জল ভিতরে টলটল করছে।
জোরে গাড়ি চালিয়ে আসায় একটু সকাল-সকাল-ই রবিউলদের গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিলাম। হাতে প্রচুর সময় থাকায় ভাবলাম, কাছেপিঠে নিশ্চয় বাজার-হাট আছে , খোঁজখবর নিয়ে যাই একবার ঘুরে আসি। যদিও, মনে মনে ঘুরে আসার কথা ভাবলাম বটে কিন্তু, যাবো কীসে! এই চিন্তা মাথায় নিয়ে-ই বাড়িটার এদিক ওদিক ঘুরে দেখতে দেখতে হটাৎ-ই নজরে পড়লো পিছনের রসুইঘরের বারান্দায় একখানা পুরানো আমলের বাই-সাইকেল ঠেসানো আছে।
সাইকেলটা হাতের সামনে পেতেই, খিলান দিয়ে সাজানো সেই ভারি ভারি থামগুলোর আড়াল থেকে যেন একটা ছোট্ট ছেলে খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠলো। আমি মনে মনে ভাবলাম, জীবনে এই প্রথমবার একটা জিনিস অন্তত সময় মতো হাতের কাছে পাওয়া গেল ! সাইকেলটা ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখলাম। প্রায় সব-ই ঠিক আছে শুধু, পিছনের চাকাটা-য় একটুও হাওয়া নেই। স্ত্রীকে রামদীনের জিম্মায় রেখে সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। নিশ্চয় কাছাকাছি কোথাও সাইকেল সারানোর দোকান থাকবে। প্রয়োজনে কাউকে জিজ্ঞাসা করে নেবো, এই ভেবে রাস্তায় বেরিয়ে একটু এগোতেই একজন লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। লোকটাকে আমার সমস্যার কথা বলতেই, সে তার সাইকেল থেকে নেমে এসে ভালো করে আমার সাইকেলটা দেখলো তারপর, ঠিক শিশুর মতো-ই লোকটা তার একমুখ হলদেটে দাঁতে-র হাসি ছড়িয়ে বললো, ” ইকটুক দূর আছে বটে।”
এতদূর জায়গায় এসেও যে একজন দেহাতি মানুষের মুখে নিজের মাতৃভাষা শুনতে পাব এ-যেন ভাবতে-ই পারিনি! মনে মনে খানিকটা নিশ্চিন্ত হলাম। ভাবলাম, যাইহোক, একজন দেশোয়ালি মানুষকে অন্তত, প্রয়োজনে কাছেপিঠে পাওয়া যাবে!
আমি কিছু বলার আগে লোকটাই যেন আমার মনের কথাগুলো বুঝে ফেললো।বললো, ” এঁজ্ঞে, ইখেনে পেরায় সকলেই আমরা বাংলাদেশের মানুষ। আমাদের দাদা-পরদাদারা বাঁকড়ো, ফুরুল্যা, মেদিনীফুর থিক্যা গাই-গরুর খাটাল লিয়ে ইখেনে এসে ডেরা বেঁধেছিল!
লোকটার কথা বলার ধরনটি আমার বেশ ভালো লাগলো। আমি হেসে বললাম, “তাই!”
পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ থাকে যারা একবার কথা বলতে শুরু করলে আর যেন থামতে পারে না, একনাগাড়ে বকেই চলে।লক্ষ্য করলাম, এই লোকটাও সেই ধরনের বক্তিয়ারবাজ!আমিও যেন লোকটার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার সমস্যার কথাটা ভুলেই গেলাম। কিন্তু, হটাৎ-ই কোথার থেকে একঝলক ঠান্ডা বাতাস জঙ্গলের পর্ণমোচী পাতায় ঝরঝর শব্দ তুলে আমার গায়ে এসে লাগতেই, এই অজানা-অচেনা জায়গায় বাড়ি ফেরা আর, সাইকেল সারানোর চিন্তাটা আবার আমার মাথার ভিতরে নড়েচড়ে উঠলো। আমি সাইকেলটার দিকে তাকিয়ে তাকে বললাম, “….কিন্তু, এটার কী হবে?” আমার কথা শুনে লোকটা এবার একটু থামলো তারপর, আগের মতোই তার সেই হলদেটে দাঁতগুলো বের করে হাসিহাসি মুখে বললো, ” সাইকিল সারানোর দুকানট ইকটুক দূর আছে বটে। তা আপুনি অই পুব পানে তাকিয়ে দাঁড়ান কেনে, উই পথ-ই সজা আপনেকে সাইকিল সারানোর দুকানটতে পৌঁছি দিবেক! “
তারপর, নিজের মনেই সে বিড়বিড় করে বলে উঠলো। ,….তব্যা, সিখেনে যাবার সময় পুটুলিতে করে ইকটুক লবণ লিয়ে যাবেন। দু-চারটা কড়ি অদবা, কয়েকটা জালখাটি যদি পেতেন…. ”