সপ্তাহান্তের ছুটিতে মাঝে মাঝেই বেড়িয়ে পড়তে হয়,মনের তাগিদে। তাই চেপে বসলাম রামপুরহাট জসিডি প্যাসেঞ্জারে,সাথে তিন সফরসঙ্গী। এই লাইনটা চালু হওয়ার পর থেকেই যাবো যাবো ভাবছি কিন্তু হয়ে ওঠেনি।নতুন ট্রেন রুট চালু হলেই অজান্তে কোনো ইঞ্জিন আমাকে নিয়ে চলে সেই পথে।তো শুরুতেই উত্তরবঙ্গের রাস্তাকে পাশে ফেলে পশ্চিমবঙ্গের সীমানা ছাড়িয়ে আমরা ঝাড়খণ্ডের পশ্চিমমুখে শাল, মহুয়া, খেজুর ও পলাশের জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। এ যেন ঝাড়গ্রাম থেকে ঘাটশিলা বা রাঁচী ঢোকার আগের পথ, মনে পড়ছিল সেই সব ভ্রমনকথা। অসংখ্য বাঁক নিয়ে ট্রেন চললো, কখনও দুরে পাহাড়ের হাতছানি কখনও বা পাহাড় কেটে রাস্তার মধ্যে দিয়ে। এ কোন আদিম জগতে প্রবেশ করলাম, মাঝে মাঝে পাহাড়ি ঝরনা আর তাতে স্নানরত সাঁওতাল কিশোর ও রমনী। জঙ্গলের ফাঁকে আদিবাসীদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নীচু টালির ঘর, গাছের ছায়ায় খাঁটিয়া পাতা একটু জিরোনোর জন্য, একদিন এখানে রাত্রিবাস করতেই হবে, সেদিন সবটাই তাদের মতো করে কাটানো।
দুমকাতে আমাদের যাত্রার ইতি টানলাম, ট্রেন চলে গেলো নিজ গন্তব্যে। রেলস্টেশন শহর থেকে একটু দুরে,আমাদের ফিরতি প্লান বাসে তবেই না সবটা চাখা যাবে। ভোজপুরী গান শুনতে শুনতে ট্রেকারে মেন বাজার এলাম।ওখানের বিখ্যাত পকোড়ি আর চা, জমে গেলো ব্যাপারটা। অর্ডার দিলাম ঠিক এই ভঙ্গিতে ‘বড়িয়া সে চা এ বানাও, ভ্যেস কা দুধ দে কে’, যেন কিছুক্ষনের জন্য অরন্যের দিনরাত্রির রবি ঘোষ ভড় করলো আমার মধ্যে।সাথে দুমকার বিখ্যাত শোনপাপড়ি খাওয়া ও বাড়ির জন্য কেনা হলো, সবই পরিবেশিত হচ্ছে কাচা শাল পাতার তৈরি পাত্রে।
ফিরতি পথের বাসযাত্রা, এ যেন এক অন্য জগত।বাসের কেবিনে লোকাল মহিলাদের সংখ্যাধিক্য চোখে ঠেকছে, কেন এমন? আমাদের ওদিকের বাসে তো দেখা যায়না।পরে মনে হলো হয়তো নিরাপত্তার জন্য এই অভিনব পন্থা। বাস জঙ্গলের বুক চিরে চলতে থাকলো ধীর পায়ে। এতো টার্ন, যে কোন নতুন চালক সাবধানে গাড়ি না চালালে দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে না, সাথে পাহাড়ের বন্ধুরতা।এভাবেই এসে পড়লাম পাতাবাড়ি, আগে আদিবাসীদের ঘরের ছাদ বা চাল শাল, হোগলা বা কোঁয়া পাতা দিয়ে ছাওয়া হতো বলে এই নামকরন, এখন অবশ্য কংক্রিট জায়গা করে নিচ্ছে। এরপর এলো মহুলপাহাড়ী ওখানের খ্রিষ্টান হাসপাতাল আগে খুব জনপ্রিয় ছিল, বহু মানুষ দুর দুরান্ত থেকে আসতো চিকিৎসার জন্য, এখন তার পরতি দশা। পরের শিকারীপাড়াতে ১৫ মিনিট চা পানের বিরতি, নেমেই দেখলাম বাজার বসেছে রাস্তার উপর,সাঁওতাল রমনীরা পসার সাজিয়ে বসে আছে। ওদের ভাষায় ব্যাঙের ছাতা মানে মাসরুম, জঙ্গলের কাঁঠাল, পিয়ারা, আম নিয়ে, সেটাও কেনা হলো, খট্টামিঠা। বাস ছাড়ার পর এলো সারসডাঙা, শুনলাম যে ওখানের এক দিঘিতে সারস পাখির আনাগোনার জন্য এই নাম। মাঝে মাঝেই রাস্তার উপরে পরপর টেম্পোরারি বার, হাড়িয়া নিয়ে বসে দোকানদার, মনে হলো বলি এ বাবু দিবি আধা পওয়া। কোথাও আবার সাঁওতালি বৃদ্ধা টানতে টানতে নিয়ে চললো তার মাতাল মরদকে।
তবে এতো কিছু পাওয়ার মধ্যেও তাল কাটলো, পাহাড়কে ছিন্ন ভিন্ন করে যন্ত্রদানবের আধিপত্য দেখে। হায় রে আধুনিকতা, কিছু শ্রেণীর অসৎ মানুষের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমরা হারাতে বসেছি আমাদের শতাব্দী প্রাচীন ভূ প্রকৃতিকে। কুয়াশার মতো ধুলোয় ঢেকে যাচ্ছে রাস্তা, গাছের পাতাতে ধুলোয় জমে থাকা আস্তরণ, জানিয়ে দিচ্ছে তার বর্নহীনতা। সত্যি কারো কোনো হেলদোল নেই, অবাধেই চলছে এ সব।মাঝে মাঝেই শোনা যায় আদিবাসীরা আন্দোলন করেছে, এটাই তো স্বাভাবিক, তাদের জীবনে ঢুকে পড়ছে এই দূষনের বিষ, পালানোর পথ নেই তাদের। শুধু মাঝে মাঝে চোখ আটকাচ্ছে সিধু কানুর স্টাচুতে, এ যেন পাহাড় চুরির নির্লজ্জ প্রায়শ্চিত্ত।সত্যিই এসব দেখে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো। এরপরও আমরা বর্ষার জন্য চিৎকার করছি। এতো গাছ কাটা, পাহাড় ধ্বংস, এর ফল তো আমাদেরই ভোগ করতে হবে। সত্যিই শেষের সেদিন ভয়ঙকর।
আলো আধাঁরে মেশা দিনটা ভালোই কাটলো। এবার মন চল নিজ নিকেতনে।
ও হ্যা ট্রেন ধরার তাড়ায় ফিরতিতে রামপুরহাট থেকে সাঁইথিয়া বিনা টিকিটে।