জন-জনি জনার্দন সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে তৃষ্ণা বসাক (পর্ব – ২০)

পাতাবাহার, পাম কৃষ্ণচূড়া, মন্টু ও মনুমামা

পর্ব ২০

খেয়াল করলে দেখব, আমাদের মহাকাব্যগুলোর নায়ক নায়িকা শুধু রাম, সীতা, অর্জুন,দ্রৌপদী বা কৃষ্ণই নন, অলক্ষ্যে কয়েকটি গাছও। ভেবে দেখুন তো অশোক গাছ ছাড়া রামায়ণ কোথায় থাকত? অর্জুনের চেয়েও উচ্চতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শমী বৃক্ষটি, যার গাছে বাঁধা অস্ত্র ভারতযুদ্ধের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করল। ভাবুন তো, অর্জুন যদি একটি খেজুর গাছে অস্ত্র বাঁধতে যেতেন, কি কেলেংকারিটাই না হত! খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধা যায়, তার বেশি কিছুর দায়িত্ব এ গাছ নিতে পারে না। শমী বৃক্ষ আমি দেখিনি, কিন্তু একদিন গীতাঞ্জলি মেট্রোয় নেমে যাচ্ছি, সোনালি পার্কের মোড়ে রিক্সা একটি গাছের তলায় গিয়ে থামল, যেকোন অচেনা মাচো মাচো গাছ দেখলেই আমি হাঁ করে দেখে থাকি, রিক্সাওলা আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে বলল ‘চেনেন না বুঝি? এ তো অর্জুন গাছ’ আমার তখন চিত্রাঙ্গদার অবস্থা। অর্জুন তুমি অর্জুন! বীরের মতোই গাছটি, রুক্ষ, পুরুষালি চেহারা। রিক্সাওলারা সে গাছের নিচে বসে গুলতানি করে, সাট্টার পেন্সিল লেখে। অহো কি দুঃসহ স্পর্ধা, অর্জুনে যে করে অশ্রদ্ধা!আরেকবার রিক্সায় চেপে রিক্সাওলাকে কদমতলায় যাবার নির্দেশ দিতে সেই পরম বিজ্ঞ রিক্সাওলাটি আমায় শুধিয়েছিল ‘কদমতলায় গেলে কি কৃষ্ণের দেখা মিলবে?’
অনেক পরে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে যখন অশোক গাছ দেখলাম, দুহাতে জড়িয়ে ধরেছিলাম। এই গাছ নাকি শোক হরণ করে। সীতার বিবেচনাকে তারিফ না করে পারিনি। অসহযোগ অবস্থানের জন্যে এক অনন্য মমতাময় গাছ বেছে নিয়েছিলেন। এবং সীতা যে কতটা গ্রিন অর্থাৎ ইকো বন্ধু ছিলেন, তার প্রমাণ তিনি রাবণকে প্রতিহত করার জন্যে তাঁর আর রাবণের মাঝে রেখেছিলেন এক গুচ্ছ তৃণ!
রবীন্দ্রনাথ শেষের কবিতায় লিখেছিলেন বিশেষ মানুষকে দেখার জন্যে বিশেষ পরিবেশ চাই। লাবণ্য আর অমিতের তাই দেখা হয়েছিল শিলং পাহাড়ে, যদি তার বদলে ড্রয়িংরুমে দেখা হত, নিবারণ চক্কোত্তির অত কবিতা লেখাই হত না। ‘রবীন্দ্রনাথ কালির দোয়াত মাথায় ঠুকে হতেন কুপোকাত, রাম পাম পাম’ (আমি না, অঞ্জন দত্ত লিখেছেন)
সেরকম বিশেষ বিশেষ গাছকে দেখার জন্যে বিশেষ বিশেষ জায়গা চাই। তার জন্যে বিস্ময় জমিয়ে রাখতে হয় জীবনভর।চট্টগ্রামে পাহাড়ের ওপর একটি আশ্রমে পারিজাত গাছ দেখে আমার অপার বিস্ময় জেগেছিল। সাদার সঙ্গে গোলাপির আভা মেশানো ভঙ্গুর পাপড়ির ফুল , সত্যিই স্বর্গের ফুলের মতোই অলীক। একইরকম বিস্ময় জেগেছিল  রাঁচির জোনা ঝরনার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে পিয়াল গাছ আবিস্কার করে। পিয়াল ফুল ঠিক স্বপ্নের মতো, তার রঙ বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
সেইরকম মুকুটমণিপুর থেকে রানিবাঁধ যাবার পথে হঠাৎ এক বসন্ত বিকেলে একটি উন্মনা ময়ূর নিজের খেয়ালে আমাদের গাড়ির সামনে পেখম মেলে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে ফোকাস ঠিক করার আগেই সে নেমে গিয়েছিল বসন্তের পথে, সেখানে দাঁড়ানো অগণিত কুসুম গাছ, তাদের পাতা খুনখারাপি লাল। কুসুমবীজ থেকে তেল তৈরি হয় জানি, ফুলও নিশ্চয় ফোটে, তবে সে ফুল আমি কখনো দেখিনি।যার পাতা এত সুন্দর, তার খামোখা ফুল ফোটানোর দরকার কী বুঝি না। পাশে কয়েকটা মহুয়া গাছও ছিল, গোধূলি বেলায় তার মাদক গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল হাওয়ায়। মহুয়া আমার একেবারে অচেনা নয়। আমাদের পাড়ায় লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে একটি মহুয়া গাছ আছে, তার ডালে বারবার উড়ে আসে দুটি হরিয়াল।
মণীন্দ্র গুপ্তের আত্মকথা ‘অক্ষয় মালবেরি’ তে আছে কালোজাম গাছ ঘিরে বালকবালিকার উন্মাদনার কথা।
‘ধন দিদির ঘরের কোণ ঘেঁষে ছিল এক সটান উঁচু কালোজাম গাছ। সেই গাছে কর্ত্রীর অনুমতি ছাড়া ওঠা যেত না। কিন্তু একবার অনুমতি পেলে কখন নামছি তাও কেউ দেখত না। জাম খেতে খেতে জিভ বেগুনিনীল এবং পুরু হয়ে যেত। তখন ডালে হাল্কা ঝাঁকুনি দিয়ে গাছের তলায় অপেক্ষমান বালিকাদের জন্যে হরির লুট দিতাম।’
খাওয়ার রস যে শুধু রসনাই পেত তা নয়, সমগ্র দেহ মন জুড়ে তার ক্রিয়া চলত, এমনকি যৌনতার প্রথম চেতনাও চালতা খেতে গিয়ে।
‘চালতা ছিল মেয়েদের প্রিয়, কিন্তু আমি রহস্যময় ভাবে আকৃষ্ট হতাম চালতার ফুলে। বিরাট গাছে, উঁচুতে, জমাট টুকরো টুকরো জ্যোৎস্না দিয়ে গড়া যেন স্বপ্নের দেশের ফুল। তার শুভ্রতা আর পাপড়ির গঠন দেখতে দেখতে কোন গভীর সৌন্দর্যের কথা অস্পষ্টভাবে মনে পড়ে, নির্জ্ঞান মনের মধ্যে অন্য কোন দূর জন্মের স্মৃতি ফুটব ফুটব করেও অন্ধ হয়ে যায়। আমি আস্তে আস্তে তার পাপড়িতে হাত বোলাই।’
এসব পড়তে পড়তে, শুনতে শুনতে আমার মনে হয়েছে আমাদের পুরাণ ইতিহাস সাহিত্য গাছেদের বাদ দিলে অসম্পূর্ণ। ভাবুন তো সলতেখাগী আম গাছ বাদ দিলে পথের পাঁচালি কেমন নড়বড়ে হয়ে যায় না?
আমার জীবনও  আসলে কয়েকটি গাছের জীবন ছাড়া কিছু নয়। প্রথমেই মনে পড়ে সেই আইকনিক ছবিটার কথা। মামাবাড়ির উঠোনে থেকে বারান্দায় ওঠার সিঁড়ির পাশে সেই পাতাবাহার গাছ। যার একটি পাতা ধরে হেলে বাঁকাবিহারী হয়ে দাঁড়ানো আমার সেই ছবি। সেই পাতাবাহার গাছটির কাছে আমার শৈশব গচ্ছিত আছে।
ছবিটা সম্ভবত তুলেছিল সেই বিখ্যাত মনুমামা, যার একটা সাধারণ ফোকাস ঠিক করতে ঘণ্টা তিনেক লাগত। তার স্টুডিও ছিল রাজা নরেন্দ্র দেব বয়েজ হাই স্কুলের সামনে একটি বাড়ির দোতলায়, নিচতলায় ছিল মণিহারি দোকান। লোহার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে হত। সেই জানলাহীন ঘর, এসির প্রশ্নি ওঠে না (গ্রামে তখন বিদ্যুতই আসেনি), সেই ঘরে মনুমামার ফোকাসসাধনায় তার শিকার ঘেমেনেয়ে একাকার হত, যেমন হাল আমার হয়েছিল একবার কুমারী পুজোর পর যখন আমার সাজানো গোজানো মূর্তিটি  সিলভার ব্রোমাইডে ধরে রাখার সাধ হয়েছিল আমার মেজমাসীর। মেজমাসীর আমাকে নিয়ে এমন পুতুলখেলা প্রায়ই হত, শুধু আমি কেন, গ্রামের যত বালক বালিকাকে ধরে ধরে তাদের নাচ গান আবৃত্তি শিখিয়ে বিজয়া সম্মিলনী, রবীন্দ্র জয়ন্তীর জন্যে তৈরি করা ছিল তার নেশা। আশির দশক অব্দি ফাংশনে নাচ গান করতে গেলে সবাই এই মেজদির শরণ নিত।গতারপর বড়বুড়ি বলে এক তরুণী তুর্কির আবির্ভাব হলে মেজমাসী সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে। আমার এখনো মনে পড়ে হেমন্ত-লতার সেই অসামান্য ডুয়েট ‘দে দোল দোল দোলে’র কি দুর্দান্ত কোরিওগ্রাফি করিয়েছিল মেজমাসী।তখন অবশ্য কোরিওগ্রাফি কথাটা আমরা কেউ শুনিনি। এর একটা বাংলা চালু ছিল-যাকে বলা হত নাচ তোলানো। আমাকেও নাচ তোলানোর মরিয়া চেষ্টা করেছিল আমার মহীয়সী মেজমাসী। আমি সেজেগুজে হাতে গলায় ফুলের মালা জড়িয়ে হাতে নাড়ু পাকিয়ে ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে’ করেছি। কে যেন একবার বলেছিল রবীন্দ্র নৃত্য মানে নাকি বাল্ব খোলা আর বাল্ব লাগানো! যারা নাচ মানে বোঝে মিস্টি মুখ আর বিয়ের কনের মতো সাজগোজ, তাদের কাছে হয়তো সেটাই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু গ্রামের লোককে অত সহজে ভোলানো যায় না। দু একটা অনুষ্ঠান দেখার পরেই তারা বুঝে গেল আমি পদিপিসির বর্মি বাক্সের সেই অবাধ্য গরুদের মতো, মোটেই নড়তে চড়তে রাজি নই, লেজ মুচড়েও আমাকে দিয়ে  কোমর ঘোরানো যাচ্ছে না। ফলে মেজমাসী আমাকে নাচ থেকে আবৃত্তিতে পাঠিয়ে দিল। তাতে বেশ ভালই হচ্ছিল। প্রতিবছর ফার্স্ট প্রাইজ , যেটা ছিল একটা মোটা বংগলিপি খাতা আর একটা পেন্সিল, সেটা আমার বাঁধা ছিল। এমনকি একবার রবি ঠাকুরের ‘রবিবার’ কবিতাটা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে দর্শকদের দিকে চেয়ে পাক্কা আটচল্লিশ সেকেন্ড মিটিমিটি হেসেছিলাম কোন অজ্ঞাত কারণে, তাতেও আমার ফার্স্ট হওয়া আটকায় নি। এতে স্বভাবতই সবাই স্বজন পোষণের গন্ধ পেয়েছিল। তাতেও মেজমাসী দমেনি। তবে সে জীবনে বড় ধাক্কা খেয়েছিল মন্টুর কাছে।মাছের ভেড়ির পয়সায় সম্পন্ন মণ্ডলবাড়ির ক্লাস ফোর ড্রপ আউট মন্টুকে মাসী অনেক কসরত করে শেখাল -কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি, রবীন্দ্র জয়ন্তীতে বলার জন্যে, মন্টুর মুখে এ কবিতা এত বার শুনেছি যে আমার কুমোরপাড়া মন্টুকে বাদ দিয়ে নয়। তো সেই বালক মাসীকে হতবাক করে মঞ্চে গিয়ে বলে এল কালিদাস রায়ের ‘ছাত্রধারা’। সেই বর্ষে বর্ষে দলে দলে… নেমে আসার পর মাসী মন্টুকে এই মারে তো সেই মারে। ‘হতভাগা, আজ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে তুই কালিদাস রায়ের কবিতা বললি কেন?’ এর উত্তরে অবিচলিতভাবে মন্টু বলেছিল ‘রবীন্দ্রনাথ তো অনেক বড়, বলেছি তো কী হয়েছে?’ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল এক মহাসমুদ্র, যার নাম রবীন্দ্রনাথ, যার মধ্যে কত ছোট বড় নদী বিলীন হয়ে যাচ্ছে! কিংবা রবীন্দ্রনাথ সেই বটবৃক্ষ, যার বিশালতায় ঢাকা পড়ে গেছে কত প্রতিভাবান কবির কীর্তি।
পাতাবাহার ছাড়াও পার্শবচরিত্র গুলিও উল্লেখের দাবী রাখে।  বকফুল, আম, পেয়ারা, খিড়কির ধারে বাতাবিলেবু, কলকে , শিরিস ফুল, সামনের রাস্তায় বট,  পথ জুড়ে অজস্র লাল বটফল। আমাদের উঠোনের কামিনী গাছ, কোশাঘাটের ধারের বকুল।তবে যে গাছটি, বলা ভাল গাছেরা আমাকে আজীবন আচ্ছন্ন করে রাখল তা হল রাসমাঠের একসারি পামগাছ। এই পামগাছের মাথার  ওপর দিয়ে মেঘ উড়ে আসত, আমি ছাদে দাঁড়িয়ে দেখতাম। তিনতলার চিলেকোঠার ঠাকুরঘরের মেঝেতে খাতা কলম নিয়ে আমি যখন কবিতা লিখতাম, তখন একপাল নিরীহ ঠাকুর আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত, জানলার গরাদে থুতনি ঠেকিয়ে আমাকে দেখত বৃষ্টি।
‘আমার কতকগুলো পোষা ঠাকুর আছে,
রোজ সকালে
তাদের ছোলা-জল খাওয়াতে
তেতলার চিলেকোঠায়
উঠতে হয়!
ওপরে গেলেই
আমি অন্যমনস্ক হয়ে যাই,
জানলায় থুতনি ঠেকিয়ে দেখি
রাসমাঠে পামগাছের সারি,
পামগাছের মাথায়
বাসা বেঁধেছে মেঘ,
রাজহাঁস উঠে আসছে কোষাঘাট থেকে…।
আমি ছোলাগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে দিই,
বলি ‘চরে খাও বাছারা,
আমার সঙ্গে কোন
চালাকি চলবে না!’
কেউ কেউ না শোনার ভান করে
দুলতে থাকে হাওয়ায়,
কেউ বা তাকিয়ে থাকে, আমার মতোই, মাঠের দিকে,
পামগাছের মাথায় ততক্ষণে,
নতুন নতুন মেঘ,
জানলা দিয়ে ঢুকে আসছে
নতুন নতুন বৃষ্টি!’
(যে পুজোর যা)
আর ভুললে চলবে না, মামারবাড়ির স্কুলমাঠের সেই কৃষ্ণচূড়ার কথাও, মনুমামার ফোকাস ঠিক করার তিনঘন্টার ফাঁকে পালিয়ে গিয়ে যার ডাল ধরে ঝুলছিলাম। হঠাৎ একটি মোটা ডাল ভেঙে আমার মাথায় পড়ল। সেই থেকেই বুঝলেন কিনা মাথাটা কেমন বুজগুম্বুল টাইপ হয়ে গেছে! and it made all the difference. যদি গাছটি কৃষ্ণচূড়ার বদলে তিন্তিড়ি বা বেল হত, ইতিহাস অন্যরকমভাবে লেখা হত!

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।