শহর কলকাতা, মহানগর কলকাতা। যার অলিগলি , পাঁজর বের করা প্রাসাদ, ট্রামলাইনে ফিসফিস করে কথা বলে ইতিহাস। কোনো একদিন জোব চার্ণক বলে এক ইংরেজ নোঙ্গর ফেলেছিলেন বুনো ,জংলী সুতানুটির বন্দরে।
বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন , হুগলির চেয়েও এই গ্রামে বাণিজ্য করতে পারলে লাভবান হবেন।
শুরু হলো নতুন অধ্যায়।
সেই সুতানুটির সাথে যুক্ত হয়ে কলকাতা, গোবিন্দপুর যে মহানগরীর জন্ম দিল তার ইতিহাস বিশ্লেষণ করেছেন বহু ঐতিহাসিক,
গবেষক। বিতর্কও হয়েছে বিভিন্ন প্রশ্নে।
কলকাতা গবেষক তারাপদ সাঁতরা বাংলার পুরাতাত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণে ব্রতী আজীবন কাল। বাংলার লোকসংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান সর্বস্তরে সুবিদিত। আনন্দবাজার পত্রিকা, ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট, এক্ষণ, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা কলকাতা বিষয়ক রচনাগুলির সংকলন হল ‘কীর্তিবাস কলকাতা’ বইটি।
বইটির কিছু জায়গা গবেষণাকারীদের কাছে উল্লেখযোগ্য। যেমন , কলকাতা নামটির বুৎপত্তি নিয়ে বিতর্ক । বেশ কয়েকটি মতামত আলোচনা ও যুক্তি সহকারে তা খন্ডন ও সত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ।
সাথে সাথে সাধারণ পাঠকের জন্য রয়েছে, কলকাতার প্রাচীন সরনী বেয়ে ফেলে আসা কাল কে ছুঁয়ে দেখার নানা ইঙ্গিত। চিৎপুর রোড, সট্রান্ড রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে আপনি কোন অবহেলিত শিলালিপির কাছে পৌঁছে যাবেন তা বুঝতে পারবেন না। কত স্মৃতিস্তম্ভ, স্থাপত্য লুকিয়ে আছে স্মৃতভার বুকে নিয়ে তা জানলে অবাক হতে হয়।
কলকাতার সাথে হাওড়া জেলার সংযুক্তিতে হাওড়া ব্রিজের ভূমিকা নিয়ে কোনো মতবিরোধ থাকা উচিত নয়। কত পরিকল্পনার মধ্যে দিয়ে ভাসমান সেতু থেকে আজকের রবীন্দ্র সেতু তৈরি হলো সেই ইতিহাস পড়তে বেশ ভালো লাগে।
বইতে উল্লেখকরা হয়েছে একটি মর্মান্তিক জাহাজ দুর্ঘটনার। ১৮৮৭ সালের মে মাসে উড়িষ্যার বালেশ্বরগামী ‘স্যার জন লরেন্স’ জাহাজ ডুবি হয়ে ছয়শো’র বেশি যাত্রীর মৃত্যু হয়। লেখক প্রায় গোয়েন্দার মতন অনুসন্ধান করে ঘটনাটি তুলে ধরেছেন ও ঔপনিবেশিক ইংরেজ সরকারের নিস্পৃহ ভাব কে স্পষ্ট করে দিয়েছেন তৎকালীন খবরের ভিত্তিতে।
বইটি পড়তে পড়তে একটা জিনিস আমার মনে হয়েছে, ইতিহাস আসলে আমাদের চারপাশেই লুকিয়ে থাকে। তাকে খুঁজে বের করা কেবল গবেষকের ই কাজ নয়। একজন সাধারণ অনুসন্ধিৎসু মানুষও পারে খুঁজতে। শুধু দেখার চোখটা দরকার। সেই চিহ্নগুলো তারাপদ বাবু রেখে গিয়েছেন তাঁর বইতে, পুরোনো কলকাতার গন্ধ মাখতে আপনাকে বইটি সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। ঠিক খুঁজে পাবেন ডেভিড হেয়ার সাহেবের বাড়ি, পুরোনো ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের সীমারেখা বা কার্জন পার্কের উত্তর-পশ্চিম কোণের মার্বেল পাথরের ফোয়ারাযুক্ত স্মৃতিসৌধ।