সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব – ৬)
পদাতিক
পাখিপাখালির দল বেশ কিছুক্ষণ হলো তাদের ঘরে ফিরেছে। আমার বাঁদিকে কিছু গাছগাছালির ফাঁক গলে মন্দিরের সন্ধ্যারতির আওয়াজ এসে পৌঁছোচ্ছে। সামনে আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন বিবেকানন্দ। সাথে সিস্টার নিবেদিতা। একটু দূরে লম্বা আলখাল্লা পরে দাঁড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। পথের বাঁকে বাতিস্তম্ভের আলো মাথার ওপরকার আম গাছের ঘন পাতার চৌখুপির ফাঁক গলে যেন আমাদের সভায় প্রবেশের প্রবেশাধিকার চাইছে। সন্ধ্যারতির আওয়াজ শেষ হতেই পেছনের প্রার্থনা কক্ষ থেকে শিশুদের সমবেত প্রার্থনা সংগীত ভেসে এলো —
” মঙ্গল দীপ জ্বেলে
অন্ধকারে দুচোখ আলোয় ভরো প্রভু –”
গানটা এমনভাবে ভেসে আসছে যেন এই গানটা শেষ হলেই আমাদের সভা শুরু হবে। রবীন্দ্রনাথ যেন পায়চারি করে বেড়াচ্ছেন, কখন সভা শুরু হবে সে কথা ভাবতে ভাবতে।
ঝাঁকড়ামাথা আমগাছটার তলায় বাঁধানো বেদীতে আমি আর বৌদি বসে আছি, বৌদির কাছে পুরোনো দিনের কথা শুনবো বলে। এমন সময় হাতে ট্রে করে দু’কাপ চা আর চারটা ব্রিটানিয়া বিস্কুট নিয়ে মিনু এসে সামনে দাঁড়ালো। আমার চা প্রিয়তা এখানকার সবাই বোধহয় জেনে গেছে। বৌদি ওর হাত থেকে ট্রেটা নিয়ে বেদীতে নামিয়ে রাখলেন।
চা খাওয়া শেষ হতে প্রার্থনা সংগীতও শেষ হয়ে গেলো। সামনে দাঁড়িয়ে তিন মহাপুরুষ আর বেদীর ওপর বসে আমরা দুজন।
–” এই যে মিনুকে দেখলেন দাদা, ওরও একটা ইতিহাস আছে। ”
আমি নড়েচড়ে বসলুম। কেমন যেন মনে হলো তেনারাও এসে সামনে দাঁড়ালেন।
–” কীরকম? ”
আমার স্বাভাবিক প্রশ্ন।
— ” আমাদের চাইতেও বেশী গরীব ছিলো ওরা। মিনু চিরটাকালই এরকমই শান্ত প্রকৃতির মেয়ে। কতোদিন যে একসাথে শাকপাতা তুলতে যেতাম। যেচে এসে আশ্রমের কাজ করে দিতো। তখন একেই আমাদের নিজেদেরই হাঁড়ির হাল। তিন মেয়ে আর আমরা দুজন ছাড়াও তখন মোটামুটি সাতজন আশ্রমিক। কোনোরকমে সবাই মিলে টিকে আছি। আপনার দাদার ওপর রাগও হয় খুব, কখনও আবার ভাবি – খারাপ তো কিছু করছে না লোকটা। দুখী, দরিদ্র শিশুদের জন্য পাগলের মতো নাওয়াখাওয়া বাদ দিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। কোত্থেকে দুমুঠো চাল পাওয়া যায়, দুটো পরনের ফ্রকজামা জোগাড় করা যায় কিনা! আশেপাশের মানুষগুলো যখন শুধু নিজেদের নিয়ে ভেবেই অস্থির তখন এই মানুষটা মানুষের পাশে দাঁড়াতে দিনরাত একাকার করে ফেলছেন। আপনাকে মিথ্যে কথা বলবো না দাদা, মানুষটার ওপর রাগও যেমন হতো, শ্রদ্ধাও কম হতো না। গর্বে বুক ফুলে উঠতো। শুয়ে শুয়ে কাঁদতাম আর ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানাতাম, ভগবান মানুষটাকে শক্তি দাও, যে ব্রত নিয়ে ও নেমেছে ও যেন ওর সেই স্বপ্ন পূর্ণ করতে পারে। ”
কথাগুলো বলে বৌদি চোখ থেকে চশমাটা খুললেন। আমি মনে মনে ভদ্রমহিলাকে প্রণাম করলাম। একজন তথাকথিত অশিক্ষিত অথবা স্বল্প শিক্ষিত গ্রাম্য মহিলা নিজেও যে দাদার সাথে একইরকম ভাবে লড়াই করে গেছেন। এই কর্মকান্ডে এই মহিলার অবদানও যে তিলমাত্র কম না!
বৌদি আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ পরিষ্কার করলেন। পেছনে অন্ধকার পুকুরের জলে ছলাৎ করে মাছের ঘাই মারার শব্দ ভেসে আসছে।
–” যাকগে, যে কথা বলছিলাম দাদা, মিনুর এক সন্মন্ধ এলো। এই গাঁয়েরই ছেলে। ভীষণই সৎ আর পরিশ্রমী। বিয়ের পর আমার শ্বশুরের নৌকোয় সহকারী হিসেবে কাজ করতে শুরু করলো। নৌকোয় পাড়ানির কাজ। যা কিছু যাত্রীদের কাছ থেকে উঠতো, সেটুকু দুজনে মিলে ভাগ করে নিতো। ওই যে রাজুকে দেখেন ও তখন সবে ওর কোলে এসেছে। ”
— ” কোন রাজু? ওই বাচ্চাটা? আমার ঘরে পড়তে আসে? ক্লাশ ফাইভের রাজু? সে কি মিনুর ছেলে নাকি? ”
আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করি।
— ” হ্যাঁ গো দাদা। ওই রাজু। তখন সবে ওর কোলে এসেছে। তখনও বোধহয় দুবছরও হয় নি। হঠাৎ একদিন রাতে পাড়াময় লোকেরা দৌড়োদৌড়ি শুরু করেছে। আমি তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। মিনুর বরের বুকে প্রচন্ড ব্যথা। সবাই মিলে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতেই, ব্যাস, সব শেষ। কী বলবো দাদা, মিনুটা কাটা পাঁঠার মতো বুক চাপড়াচ্ছে। আর ক্ষণেক্ষণে মুর্ছা যাচ্ছে।
ক্রমশ