• Uncategorized
  • 0

করোনা এবং আপাত তুচ্ছ কিছু বিষয়ে শর্মিষ্ঠা সেন

দক্ষিন আফ্রিকার লিম্পোম্পো প্রভিন্স ৷ অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য স্থানটির সর্বত্র ৷ এর অনেকটাই জুড়ে রয়েছে বিশ্ব বিখ্যাত ক্রুগার ন্যাশনাল পার্ক ৷ আশির দশকের প্রথম দিকের খরা কাটিয়ে উঠেছে অভয়ারণ্যগুলি ৷ হঠাৎ করে ‘কুডু হরিণ’ মারা পড়তে লাগল এদিক ওদিক ৷ সংখ্যাটা একসময় তিনহাজারে পৌছে গেল ৷ তদন্তে এলেন বায়োলজিষ্ট ভ্যান হোভেন ৷ জানা গেল এই বিপুল সংখ্যক কুডুর মৃত্যুর জন্য দায়ী অ্যাকাশিয়া গাছ ৷ ঐ সংরক্ষিত অরণ্যে গাছের তুলনায় হরিণ .বেড়ে গিয়েছিল ফলে গাছেরা নিজেদের জন্য একটা ডিফেন্স মেকানিজম তৈরী করে নিয়েছিল ৷ ওরা ইথিলিন গ্যাস নির্গত করছিল যা ছড়িয়ে যেত ৪৫মিটার অবধি৷ এবার আশেপাশের অ্যাকাশিয়া গাছগুলি পাতায় ট্যানিনের মাত্রা বাড়িয়ে দিত বহু পরিমানে ৷ হরিণ বা অন্য তৃণভোজী প্রাণীর লিভারের ক্ষমতা আছে স্বল্পমাত্রার ট্যানিন ছেঁকে বাইরে বার করার , কিন্তু পাতায় ট্যানিনের মাত্রা বেশী হয়ে যাওয়ায় শরীরে বিষক্রিয়ায় একের পর এক মৃত্যু !
এটি একটি উদাহরন মাত্র ৷ প্রকৃতিজগতে অনবরত ঘটে যাওয়া এমন ঘটনাপ্রবাহের খবর আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কানে পৌছয়না ৷ আমরা ভাবি , সকালে উঠে অফিস করলাম বা ব্যাবসা করলাম,বাড়ী ফিরে খেলাম দেলাম, ছেলে মেয়েকে ভাল স্কুলে পড়ালাম, গাড়ী বাড়ি করলাম; পি পি এফ , মিউচুয়াল ফান্ড শেয়ার বাজারে টাকা খাটালাম; বছরে একবার বিদেশ ভ্রমন , ফেসবুক ট্যুইটার করলাম – ব্যাস ! এই তো জীবন ! একদন্ডও আমরা ভাবিনা কোথায় আছি ! আমাদের ইট কাঠ কংক্রিটের জঙ্গলের বাইরে অসম্ভব শক্তিশালী এক জগত আছে ! ঠান্ডা মেশিনের হাওয়া খাওয়ার সময় একবারও ভাবিনা ঘূর্ণাবর্তের কথা ! পৃথিবী যথেচ্ছ গরম হোক , আমার ঘরটি ঠান্ডা থাকলেই হলো !
২০১৯শে আমরা ভয়ংকর দাবানল দেখেছি বিশ্বজুড়ে ৷ আমাজন পুড়েছে মাসের পর মাস ! বলা ভাল পোড়ানো হয়েছে ! অষ্ট্রেলিয়া পুড়েছে …লক্ষাধিক উদ্ভিদ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ! আমরা দেখেছি বন্যপ্রাণের করুণ পরিণতি ৷ জীবজগতের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যা ক্ষতি হয়েছে তা আমার আপনার ধারণার বাইরে ৷ ইউনাইটেড নেশানস এর হিসেব অনুযায়ী এক মিলিয়ন প্রানী চিরতরে বিলুপ্তির পথে ! ইকো সিস্টেমের মাথায় বসে আছে বলে মানুষ নিশ্চিন্ত কিন্তু ভেবে দেখিনি পায়ের তলার মাটিটা সরে গেলে পিরামিডের চূড়োর বসে থাকা মনুষ্যপ্রজাতিও রেহাই পাবেনা !
এবার ২০২০ ৷ নতুন বছরের শুরুতেই উপহার করোনা ভাইরাস ৷ চীনের উহান প্রদেশে ২০১৯শে সর্বপ্রথম যার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা ৷ অনেকেই দায়ী করছেন চীনাদের খাদ্যাভাসকে ৷ কিন্তু ভাবুন একবার ,জনসংখ্যার নিরিখে চীন সবার আগে, তাঁদের এই খাদ্যাভাস, জীবনযাপন শতাব্দী প্রাচীণ, আমাদের ভাবতে হবে অতি সম্প্রতি পৃথিবীর কী কী পরিবর্তন আমরা করেছি ৷ নগরায়নের দোহাই দিয়ে একফোঁটা মাটি রাখিনি শহরাঞ্চলে! জলস্তর নেমে গেছে হু হু করে ! ভেবে দেখিনি অ্যাকোয়াগার্ডে সাত লিটার জল ফিল্টার করতে সাত লিটার জলই নষ্ট করি ৷ আউটলেটের জল সবসময় ধরা হয়ে ওঠেনা ৷ মাসে কত লিটার জল এভাবে নষ্ট হয় হিসেব করাটা কী খুব কঠিন ? করোনা এসে আমাদের অন্তরাত্মাকে নাড়িয়ে দিয়েছে বলে যদি ভাবেন – আপনি ভুল ভাবছেন ৷ করোনা সুযোগ করে দিয়েছে ঘরে বসে ‘মস্তি’ করার, মদ-মাংস খাওয়ার, মিম বানানো আর শেয়ার করার ৷ আমার কী ? আমি তো দিব্যি চাকরি করছি, সবেতন ছুটি ৷ দায় সব ডাক্তার বাবু আর নার্সদিদিদের, স্বাস্থ্যকর্মীদের ; পুরকর্মীদের, যারা এখনও আমার বাড়ীর ময়লাটা নিয়ে যাচ্ছেন! দায় তো মাষ্টার মশাই দিদিমণিদের – যারা বাচ্চাদের খাবার বিলি করতে কার্ফু লঙ্ঘন করে স্কুলে যাচ্ছেন ! দায় তো পুলিশ প্রশাসনের – যারা আমার পাড়ার মোড়ে পাহারা দিচ্ছেন ! দায় তো এমাজেন্সি সার্ভিসের লোকেদের , যাদের দৌলতে আমার মাথার ওপর ফ্যানটা ঘুরছে এখনও ৷ আমি জানি আজ গ্যাস ফুরিয়ে গেলে বাড়ী বয়ে এসে সার্ভিস প্রোভাইডার সিলিন্ডার দিয়ে যাবে ৷ দায় ফোন কোম্পানী আর মিডিয়ার – যারা আমার মনোরঞ্জনের জন্য সদা সর্বদা প্রস্তুত ৷ আর দায় আমার মুখ্যমন্ত্রীর, যিনি কালও এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতাল ছুটে বেরিয়েছেন অসাবধানে বা গা জোয়ারি করে আমরা যারা রোগ বাঁধাবো তারা যেন চিকিৎসার সুযোগটা পাই !
আমার নিজেকেই প্রশ্ন , আমি কী এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার যোগ্য ? ভার বাড়ানো ছাড়া এ পৃথিবীকে ফেরত কিছুই দেইনি আজ পর্যন্ত ! করোনা ভাইরাস নিয়ে সরকার যথেষ্ট প্রচার চালাচ্ছেন , কী করা উচিত , কীভাবে থাকা উচিত তা সবাই জানি , এ নিয়ে বেশী কিছু বলবনা ৷ মানুষ এযাবৎ ম্যাড কাউ ডিজিজ ,বার্ড ফ্লু, ইবোলা, সার্স দেখেছে ৷ করোনার সাথে সাথে আবার ‘হান্টা’ নামের আরেকটি ভাইরাস চীনে সংক্রমন শুরু করেছে ৷ তবে আশার বিষয় হান্টার প্রতিষেধক আছে, করোনার এখনও পর্যন্ত নেই , অদূর ভবিষ্যতে তা ও আবিষ্কার হবে ; ততদিনে হয়ত এক বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে ! বয়স্ক মানুষেরা পারবেন না এর সাথে লড়াই করতে ৷ এযেন বই এ পড়া ডারউইনের থিয়োরি “সারভাইভ্যাল অফ দ্য ফিটেষ্ট” ৷ যাদের ইমিউনিটি কম করোনা তাদের বাঁচতে দেবেনা ৷
কিন্তু এর পর কী ? করোনা পরবর্তী ভয়ঙ্করতা মোকাবিলার জন্য আমরা প্রস্তুত তো ? গ্রীসের অর্থনীতি ভেঙে পড়ার পর গোটা ইউরোপ ধাক্কা খেয়েছিল ৷ এবার যখন বিশ্বজুড়ে আর্থিক মন্দা আসবে আমরা কি পারব সামাল দিতে? এবার কী শিক্ষা ব্যাবস্থায় পরিবর্তনের কথা ভাববো ? যেখানে হাতে কলমে মাটির সাথে শিশুর নাড়ীর টান তৈরী করা যাবে ? আজকের শিশু কিশোর মোবাইল গেম এ ফসল ফলায়, ফসল তোলে ৷ গাল ভরা কত নাম – ফার্মভিল, কান্ট্রি এসকেপ, হে ডে ! বাচ্চাদের এক্সট্রা কারিকুলারে কেন বলা হবে না টবে একটা গাছ লাগিয়ে যত্ন করে দিনলিপিতে তুলে রাখ ! কেন শুধু মুখস্তবিদ্যার চাষ ? আত্তীকরণ কী কখনই করব না?
এখনও বোধকরি সময় আছে ৷ দূরে যখন পাখীর কিচির মিচির শুনি, মনে হয় , প্রকৃতি মা নিষ্ঠুর নন , আমাদের অবিমৃষ্যকারিতার শাস্তি যেমন দিচ্ছেন তেমন আবার বুকেও টেনে নেবেন ৷ অবোধ, অকৃতজ্ঞ মানবজাতিকে নিজের ভুল শুধরে নেবার আর একটি সুযোগ দেবেন ৷
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।