গৌরাম্মা এখন বসে আছে এক বিলাসবহুল ঘরে। একটা বড় সোফায় ও গা এলিয়ে দিয়েছে। বিশাল ঘরের মাঝে একটা পালঙ্ক, চারটে দেওয়াল সমান জানলা ঘরে। সার্সির পাল্লা খোলা রয়েছে বলে আলো আসছে খুব। সাদা পর্দা গুলো হাওয়ায় দুলছে এমনভাবে যেন কোন ভৌতিক সিনেমার দৃশ্য দেখছে ও। কোথাও কোন শব্দ নেই এই মাঝদুপুরে। জানলা দিয়ে যেটুকু খোলা জায়গা চোখে পড়ছে, সুবুজ ঘাসে ছাওয়া সেখানেও কেউ নেই আপাতত। যেন দেশের মতো দুপুরে সবাই ভাতঘুম দিচ্ছে। মনে করেই চোখে জল এলো গৌরাম্মার। আজ থেকে ও একা। তার কোন দেশ নেই। নিজের বাড়ি নেই। এই প্রাসাদ তার বাড়ি হতে পারে না কিছুতেই। এখানে নিজের মনের মতো কিছু নেই, নিজের বলে কিচ্ছুটি নেই আর। বাবা তাকে রানীর জিম্মায় রেখে চলে গেল খুশি মনে। একটুও ভাবল না ওর কথা। আজ হঠাৎ করে নিজের জগত থেকে উপড়ে এনে ওকে ফেলে দিল এই বিলেতের প্রাসাদে। যেখানে নিজের ভাষাটুকু পর্যন্ত রুদ্ধ হয়ে গেল। নিজের ধর্ম ছেড়ে দিতে হল তাকে। তার নিজের মাকে ভুলে মাদার সম্বোধনে ডাকতে হবে ওই মোটা, ধুমসি রানীকে! ভাবতেই বিতৃষ্ণায় মুখ তেতো হয়ে গেল গৌরাম্মার। সাদা ফ্যাটফ্যাটে চামড়া, তার ওপর বেঁটে, পোয়াতি পেট উঁচু ঢিবির মতো ফুলে আছে। সেই অবস্থায় একটা টাইট গাউন পরেছেন, উপচে পড়ছে বিশালাকৃতি স্তন, একগা গয়না আর মুকুট পরা সেই রানীকে দেখে গৌরাম্মার একেবারেই ভক্তিশ্রদ্ধা এলো না। যদিও রানী ওকে খুব আদর আহ্লাদ করলেন, গালে চুমু খেলেন চকাস করে। ওর চেহারা, দৈর্ঘ, চুল, চোখের ভূয়সী প্রশংসা করলেন বারেবারে। কিন্তু এসবেও গৌরাম্মার মন ভাল হয়নি। বারবার কেবল মনে হয়েছে, এই রাজপ্রাসাদে আসলে তাকে এখন থেকে বন্দির জীবন কাটাতে হবে। তার ইচ্ছে মতো চলার স্বাধীনতা নেই। রানীর ইচ্ছেয় তাকে উঠতে বসতে হবে। আলো পড়ে আসছে দ্রুত। গৌরাম্মা মনে পড়ল, এখনই ওকে ইংরেজি শেখানোর জন্য একজন টিচার আসবেন। অনিচ্ছেয় সোফা ছেড়ে উঠল ও। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এলানো খোঁপা তুলে বাঁধল। শীত শীত করছে হঠাতই। কেঁপে উঠল ও। ওকে নিশ্চই নজর রাখছিল কেউ বাইরে থেকে। একটি মেয়ে এসে ওকে নতুন একটি গাউনের ওপর কোট পরিয়ে দিয়ে, মুখে হাল্কা প্রসাধনের চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেল। নিজেকে দেখে কেমন হাসি পেল গৌরাম্মার। ওর এই রূপ দেখলে মা কী বলত কে জানে! মায়ের মুখটা ভেসে উঠতেই মনের ভেতরটা মুচড়ে উঠল গৌরাম্মার। আর তখনই দরজায় শব্দ হল। ঘরে প্রবেশ করলেন ভিক্টোরিয়া গৌরাম্মার টিচার।
কুপিল্লা ভাবছিল তার নিজের কথা। গৌরাম্মা বাড়ি ছেড়ে গিয়ে পড়েছিল রানীর ঘরে। আর সে বাড়ি ছেড়ে এসে পড়েছে এক গ্যারাজে। কী বৈপরীত্য! অবশ্য দুজনেই পড়েছে বিধর্মীর ঘরে, এখানেই তাদের মিল। লেনিন যে কে, কোথা থেকে এলো এই গ্রামে, কেউ জানে না। ওকে জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দেয় না। ওর ঘরে অবশ্য একটা যীশুর মূর্তি আছে। আর ওই নাম…কে যে দিয়েছিল ওকে, আর তার পুরো নামই বা কী, কিছুই আজ অবধি বলেনি লেনিন। ক্ষ্যাপাটে হলেও মানুষটা সরল সোজাই। কারুর সাতে পাঁচে থাকে না। মেকানিকের কাজে অবশ্য তার দক্ষতা সন্দেহাতীত। সেই জন্যই বোধহয় ওর গ্যারাজে কাজের অভাব নেই। অনেক দূর থেকে লোকজন আসে এখানে। এই কদিনে কাজ শিখেছে কিছুটা ও। উপার্জন যা হচ্ছে বা হবে, নিজের চলে যাবে ঠিকই। কিন্তু আর কদ্দিন এভাবে লেনিনের ঘাড়ে বসে থাকবে ও? কিন্তু একটা ঘর ভাড়া করতে যা খরচ, কুপিল্লা এই আয়ে সামলাতে পারবে না। কিন্তু উপায়ই বা কী আর! মুষড়ে পড়ে মাঝেমাঝে এই সব ভাবলে। বিদ্যার কাছে ঘনঘন যাওয়া হয়ে যাচ্ছে আজকাল, ফলে ওর গ্রামে এই নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে। একদিন নাকি বিদ্যার মা ওকে কুপিল্লার সঙ্গে মিশতে বারণও করেছে। কী যে আছে কপালে…এই সব ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়েছিল কুপিল্লা। এই দুপুরে খদ্দেরপাতি কমই থাকে। কখন যে একটা বাইক ঢুকেছে ও খেয়াল করেনি। লেনিনের ডাকে চমক ভাঙল ওর।
এগারো বছর বয়সী এক ভারতীয় কিশোরী, যে কিনা প্রথমবার বিদেশে এলো, আর এসেই সংস্পর্শ পেল রানীর অন্দমহলের। ফলে সম্পূর্ণ ভারতীয় রীতিরেওয়াজে মানুষ হওয়া এক মেয়ের পক্ষে সেখানে মানিয়ে নেওয়া যে সহজ হবে না, এ তো বোঝাই যায়। যতই সে রাজপরিবারের মেয়ে হোক না কেন, তাদের আদবকায়দার সঙ্গে খোদ বৃটেনের রানীমার আদবকায়দার আকাশপাতাল তফাৎ থাকবেই। ভিক্টোরিয়াকে প্রাথমিক ভাবে অপছন্দ করেছিল গৌরাম্মা। ধীরে ধীরে অবশ্য সময়ের নিয়মে মানিয়ে নিয়েছিল ওঁর সাহচর্য্য। এছাড়া আর উপায়ই বা কী ছিল ওর? খোদ রানী যখন তার পালক মাতা, তাকে মানিয়ে চলতে তো হবেই। রানীমাও স্বভাবে খুবই কোমল তার পালিত ছেলেমেয়েদের ওপর। যদিও এই কোমলতার ধারটির প্রত্যক্ষ স্বরূপ তারাই কেবলমাত্র অনুধাবন করতে পেরেছিল। ওপরে ওপরে কোমল, মধুর স্বভাব দেখালেও ভিক্টোরিয়া ছিলেন একেবারে একরোখা স্বাভবের। তাঁর কথা বা আদেশ, নির্দেশের বাইরে পালিতদের একচুলও নড়ার ক্ষমতা ছিল না। স্নেহ কোমল বটে, কিন্তু রাজতন্ত্রের সর্বোচ্চ শিখরে বসে থাকা একজন রানীর কর্তৃত্ব শেষ কথা বলেছে সবসময়ে। রানীর স্বামী অ্যালবার্ট মানুষটি অবশ্য অনেক নমনীয়। কিন্তু সর্বময় কর্তৃ ভিক্টোরিয়ার আজ্ঞাবাহী।
যদিও এতদিনে গৌরাম্মা এটুকু বুঝে গেছে যে, অ্যালবার্টের সঙ্গে রানীর দাম্পত্য প্রেমের বাঁধন খুব মজবুত। রানী তাঁর স্বামী ছাড়া আর কোন পুরুষমানুষকেই বিশেষ পাত্তা দেন না। অ্যালবার্ট রানীর মহলে এলে রানীকে আর পাওয়া যায় না তেমনভাবে। তাঁরা দুটিতে এই বয়সেও সারাক্ষণ প্রেমে ব্যস্ত থাকেন। অবশ্য নয় নয় করেও এখন রানীর অষ্টমগর্ভ চলছে। ফলে শারীরিক অসুবিধের কারণে অ্যালবার্টের ওপরই রাজকার্যের ভার চাপিয়ে দিয়ে রানী বিশ্রাম নিচ্ছেন। রানীর সাত ছেলেমেয়েরাও যেমন ভিক্টোরিয়াকে এই কারণে অন্দরমহলে পেয়ে যাচ্ছেন, তেমনি পালিত ছেলেমেয়েরাও রানীকে কাছ থেকে দেখছেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, ভিক্টোরিয়া গৌরাম্মাকে বিশেষ স্নেহের চোখেই দেখেন কেন কে জানে। একান্তে কথাবার্তাও বলেন মাঝেমাঝে। বেশিরভাগ সময়েই তার পড়াশুনো, শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে জিজ্ঞাসা আর তার বৃটিশ ঘরানার এটিকেট শিক্ষার হালচাল সম্বন্ধে আগ্রহ দেখান। আর এই সময়ে রানীর দৃষ্টি দেখলে গৌরাম্মার কেন জানি খুব অস্বস্তি হতে থাকে। ভিক্টোরিয়ার এখন বয়স প্রৌঢ়ত্বের কাছাকাছি। তায় নিজে গর্ভবতী। সাতটি সন্তানের জননীর হাবভাব দেখে গৌরাম্মার কখনই রানীকে মাতৃস্থানীয়া মনে হয় না। আদর করার ছলে তাঁর হাতের স্পর্শ গৌরাম্মার পিঠে, বুকে, কোমরে ঘুরতে থাকলে, সেই স্পর্শে স্নেহের পরশ পায় না গৌরাম্মা। বরং কেমন যেন এক অস্বস্তি হতে থাকে। ঘিনঘিন করে ওঠে শরীর। নিজের মায়ের থেকেও বয়সে বড় একজন রমণীর ছোঁয়া যে এরকম হতে পারে, ওর ভাবনাতেও ছিল না এমনটা। অথচ দোষের কিছু খুঁজে পায় না, হিসেব মতো তিনিও ওর মা, মা তো মেয়েকে আদর করতেই পারে! কিন্তু তবুও…কী এক অজানিত শঙ্কায় গুটিয়ে নেয় নিজেকে গৌরাম্মা। মনের ভেতরে তার উথালপাথাল চলে। সে চেষ্টা করে রানীকে এড়িয়ে চলতে। কিন্তু একান্তে ডাক এলে তার না গিয়েও উপায় থাকে না। আজই যেমন ছিল সেই দিন! অথচ এই ঘটনা কারুর সঙ্গে আলোচনা করবে, এমন মানুষও তার ধারেকাছে নেই। এমিলিকেও বলতে ভরসা পায়নি ও। মা, মাগো! ডুকরে কেঁদে ওঠে গৌরাম্মা। এ তোমরা আমায়, কার হাতে ফেলে রেখে গেলে! যে গৌরাম্মা কিছুদিন আগেও ভিক্টোরিয়া গৌরাম্মা হওয়ার আনন্দে, গর্বে উচ্ছসিত ছিল, কয়েক মাসের মধ্যেই তার সেই উচ্ছাস, আনন্দ আজ গভীর বিষাদে পরিণত হচ্ছে। নিজেকে কারারুদ্ধ বন্দি ছাড়া তার আর কিছুই মনে হয় না। এভাবেই কি এই রানীর কব্জায় তার জীবন কাটিয়ে দিতে হবে? আর কোন উপায় নেই এই পৃথিবীতে?
ভিক্টোরিয়ার একশোর ওপর পালিত পুত্রকন্যা। সবাই যে এমন বিশেষ স্নেহ লাভ করেছে, তাও না। রানীর নেকনজরে পড়ার জন্য ছেলেমেয়েদের মধ্যে যেন গোপন প্রতিযোগিতা চলত। কে কত আগে রানীর কাছে পৌঁছতে পারবে, গা ঘেঁষে বসতে পারবে, রানীমাকে নরম কথায় তুষ্ট করতে পারবে এই নিয়ে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হত সবসময়ে। আর এই সব থেকে শত হস্ত দূরে থাকত গৌরাম্মা। আর এই কারণেই হোক বা তার নিজের চেহারার গুণেই হোক, রানীর নজর এড়িয়ে চলা গৌরাম্মার সম্ভব হত না। সেই সময়ে এই প্রাসাদের থেকে কিছুটা দূরে আরেক রাজপ্রাসাদে্র এক রাজকীয় ঘরে, রাজকীয় ভাবে বেড়ে চলেছে একটি কিশোর। একা এবং সম্পূর্ণ নজরবন্দি সে। তার সঙ্গে কারুর মেশার অধিকার নেই। সারাদিনে কথা বলার কেউ নেই তার। খেলাধুলোর সঙ্গী নেই কোনও। ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজা রণজিৎ সিঙের ছোট পুত্র সে। দশ বছর বয়স থেকে রানীর নজরবন্দি হয়ে রয়েছে। বালকের মানসিকতার বিকাশ হয়নি। তার সঙ্গে নিজের পরিবারের কারুর দেখাসাক্ষাৎ সম্পূর্ণ বন্ধ। দেশ থেকে কোন খবরাখবর এলে বা কেউ সাক্ষাতপ্রার্থী হলে, রানীর অনুমতি নিতে হয়। রানী তাকেও নিজের ছেলে মেনেছেন। তবে অন্যান্য ছেলেমেয়ের মতো সেই ছেলেকে সামনে আনেননি কখনও। সবার চোখের আড়ালে কেটে যাচ্ছে সেই কিশোরের জীবন। এই পুত্রকেও রানী বিশেষ স্নেহের চোখে দেখেন। তাঁর ইচ্ছে মতো সেই কিশোরকে রানীর সামনে নিয়ে আসা হয় গোপনে। দলিপ সিং ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে রাজার মতো আদবকায়দায়। সম্পূর্ণ বৃটিশ আবহে, রয়্যাল ফ্যামিলির মর্যাদায়।
লেনিন সেদিন ওই বাইকধারীর সঙ্গে কুপিল্লার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘এই ছেলেটাকে কিছু কাজকর্ম জুটিয়ে দিন। পড়াশুনো জানে, ব্রাহ্মণ সন্তান। ওর কি এসব কাজ সাজে?’ লোকটাকে দেখে সম্ভ্রান্ত ঘরের বলেই মনে হয়েছিল। সে চলে যাওয়ার পরে শুনেছিল, তার নাম গোপীকৃষ্ণান আইয়ার। গোপী নামেই ওকে একডাকে সবাই চেনে। বড় ব্যবসায়ী। দুচোখে আবার আশা আর স্বপ্নের চাষ বুনতে শুরু করেছিল কুপিল্লা। যদি এবার একটা ভাল কাজ জুটে যায়……