১। “আত্মপ্রকাশ” এক বিশেষ রকমের কারু, কর্তাহীন মিলনস্তম্ভ যার কর্ম। এই বেহিসেবী অঘটন, জন্মদাগে টুংটাং, শিল্প মিশ্রিত সাহিত্য, গেঁথে গেঁথে সুদৃঢ় করার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার দায় মাথা পেতে নিতে পেরেছে যারা, কালি-কাগজ-মন’এ শুধু তাদের আধিপত্য।
এই মাত্র মেঘ ধরেছে খুব, হালকা ঝোড়ো বাতাস মেঘের অতিথি হয়ে এসে পাতাদের ঘুম ভাঙিয়ে যাচ্ছে। আমি স্থির দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছি;— একটা সময়(বাচ্চাছেলে) বাতাস চিরে ছুটে চলেছে হৈ হৈ শব্দে। এক বধূর শাড়ির আঁচল বাতাসে কিছুটা সরে গিয়ে মেঘের রঙে আমার হৃদয় ভরিয়ে গেল। এক যুবতী সদ্য স্নান সেরে পুকুরঘাটে চুল মুছে নিচ্ছে কিছুটা নুয়ে; আর আমি পরিষ্কার দেখছি তার জল বিভাজিকা, বিভাজিকা বেয়ে গড়িয়ে যাওয়া বিন্দু বিন্দু জলে একটা নদী তৈরি হচ্ছে।
যদিও নারীদেহে এরকম নদী ও বাঁক, পর্বত ও গিরিখাতের ভাণ্ডার তবুও দ্যাখায় দেখায় তফাৎ অনেক। যেমন আমি দেখতে পাচ্ছি সব কিছু মিলিয়ে প্রকৃতি কেমন সেজে উঠেছে ঝড়-ঝড়, থর-থর, শিড়-শিড়, আর আমিও ভেবে নিতে পারছি, আমি শিলাই প্রেমিক, প্রকৃতি প্রেমিক, তোমারও প্রেমিক।
২। যাক সেসব, এবার বলি কেন এসব কথা বলছি— তখন আমি সদ্য সর্বনাশকে ভালবাসছি, সর্বনাশ’ই; কারণ সেই ভাবতে শিখছি নিজেকে নিজে, ভাবতে শিখছি পড়তে পড়তে, কেন “ছোট খোকা বলে অ আ”। সেই তখন থেকেই আমিই একমাত্র খোকা(আমার দৃষ্টিতে) এবং আমিই শুধু পড়ছি (অ, আ), আর তখন থেকেই আমি হয়ে উঠছি রবীন্দ্রনাথ।
৩।
শৈশবের বেভুল বাগান পেরিয়ে একটা শিশু পা পা করে কৈশোরের আবেগে উপস্থিত হয়েছে। সেদিন এরকমই একটা ঝড়বৃষ্টির দিনে সে পড়ছে ” নীল নব ঘনে, আষাঢ় গগনে” আর সেই উৎফুল্লতার সুর ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে বাতাসে। ভাবতে ভাবতে মূহুর্তে আমি পৌঁছে গেলাম মেঘমদিরার দেশে, সেখানে মেঘের আলপনায় আঁকা পক্ষিরাজ ঘোড়া, ঐরাবতসহ মেঘেদের আরও কত রূপ।
লিখছি সেই তখন থেকেই, আলপনায়, কল্পনায়। হঠাৎ কোনো বজ্রপাতের চোখে চোখ রেখে দিতে দিয়েছি। তখন থেকেই কলম উঁচিয়ে সভ্যতার কাছে “প্রশ্ন” রেখেছি।
৪। ‘প্রশ্ন’ এর সংজ্ঞাও বদলেছে সময়ে সময়ে। কৈশোরে যে রাতকে দুপুর ভেবেছিলাম যৌবনে সেটাই ভগবানের দূত। আমি কিন্তু রবীন্দ্রনাথ হওয়া বন্ধ করিনি কবেও। প্রথা ও প্রথাবিরোধ এসেছে, পুরুষ ও নারীর দূরত্ব বেড়েছে, আসলে সেটা দূরত্ব ছিল না ছিল আকর্ষণ, ঠিকঠাক বলতে গেলে দেখার চোখ পাল্টে যাওয়া।
“জল পড়ে পাতা নড়ে” থেকে “বুক ভরা মধু বঙ্গের বধূ” -তে স্থানান্তর হয়েছে মন। এভাবেই আমি রবীন্দ্রনাথ হয়েছি প্রতিদিন।
যৌবনের সঙ্গম যেমন হয় মৈথুনে, তেমনই আমিও রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছি দিনে দিনে ভাবনায়-কল্পনায়।
৫।
তখন কলেজে পড়ছি, আরও রঙিন হচ্ছে আমার পৃথিবী, আমি আরও আরও রবীন্দ্রনাথ পড়ছি, রবীন্দ্রনাথ হচ্ছি। “মানসী”র মানসকন্যাদের দেখছি ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে, “পুনশ্চ”-র প্রেমে পড়ছি। “চোখের বালি”-র বিনোদিনীকে অযথাই বড্ড বেশি ভালবেসে ফেলছি, তার আঢাকা স্তনের ভিতর থেকে যেন আমি অচেনা “গুপ্তধন” খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
তখন মাঘ মাস। কলেজ থেকে আয়োজিত একটি ট্যুরে যাচ্ছি শান্তিনিকেতন, আমার নিজের ঘর। লালমাটির দেশ কালো রাস্তার প্রলেপে যেন অচেনা লাগছিল কিছুটা, তবু্ও নিজের ঘর তো স্বর্গই। ঘুরতে ফিরতে গিলে নিচ্ছি শৈশব কৈশোর যৌবনের যৌক্তিক সমস্ত কল্পনা। যেন এখানেই চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে “মেঘদূত”, ” শকুন্তলা” আর “কাদম্বরী”-রা।
৬।
কলেজ শেষ, বাস্তবে সাহিত্যের জন্য কলম ধরেছি সেই প্রথম। লিখে ফেললাম প্রথম লেখা—
” আমি ততটা উপরে উঠতে চাই, যেখানে দ্বেষ হিংসা আমাকে ছুঁতে পারবে না, যেখানে অবুঝ সঞ্চয়, শুধু সঞ্চয়।”
এখান থেকেই যাত্রার শুরু। সাহিত্য সবদিনই অবুঝ, কখন, কোথায়, কীভাবে বাঁক নেয় কে বলতে পারে! তাই এরপরেই কবিতার ছলে লিখে ফেললাম নষ্ট প্রেম—
“করতাম যদি তোমায় আমি
নষ্ট প্রেমের গোপন প্রেয়সী
পারতে না আজও ভুলতে আমায়
হতে না কবেও শরীর পিয়াসী।”
আবার কখনো অন্য খেয়ালে লিখেছি —
“একদিন ঠিক পাল্টে যাব আহত শতাব্দীর বুক চিরে।”
৭।
এসব কথাদের ভীড়ে আস্তে আস্তে পাল্টেছি আমি, পাল্টেছে সময়, পাল্টেছে দেখার চোখেও, এমনকি রবীন্দ্রনাথের সংজ্ঞাও পাল্টে গেছে আমার কাছে সময়ে সময়ে। যেটুকু রয়ে গেছে তা হল কিছু টুকরো স্মৃতি, কিছু ভাবনা, কিছু কল্পনা আর কিছু নাছোড় দাগ।
এখনো আমি লিখি। প্রথা ভেঙে ও প্রথা গড়ে, আলোচনা ও আলোচকদের পেরিয়ে, এখন কখনও একটা ধূসর ডাকে আমাকে আবার কখনও একটা শুভ্র সকালও ডাকে। আমি কখনো লিখি নিমকি মেঘের চিঠি, কখনো লিখি ধ্বংসস্তুপের কবিতা, কখনো লিখি সভ্যতার প্রবন্ধ, কখনো লিখি নগ্নতার উপন্যাস। আমি লিখি রবীন্দ্রনাথ হয়ে, আমি লিখি প্রেমিক হয়ে—
“বোনানো সব্জীর মতো প্রেমে
কতটা উর্বর হলে মাটি
জলবায়ু অবেদনবিদ প্রেমিকা হয়।”
আবার কখনো লিখে ফেলি—
“তুমি বৈশাখ আঁকতে বলে
ছিঁড়ে দিয়েছিলে পাতা
আমি শুষ্কতায় বৈশাখ পরে নিয়েছি।”
রবীন্দ্রনাথের মতো করে রবীন্দ্রনাথকে ভাঙতে গিয়ে নিজেকেই টুকরো করে ফেলেছি কতবার “শেষের কবিতা” য়
” এরকম বছর একটা একটা আসে
আর আমি নিজেকে নিজের মতো ভাঙি
নিজেরই অ্যাতো বহিষ্কার। “
এরকমই ভাঙতে গড়তে, হারতে হারাতে অজান্তেই কখন যেন আমি নিজে একটা রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছি।
এভাবেই তো হয়ে ওঠা যায় রবীন্দ্রনাথ? এভাবেই তো বলা যায় আমিও রবীন্দ্রনাথ? তাই না!
তাঁর সাথে আমার তুলনা এই শেষ দুটি লাইনে এবং এভাবেও আমি রবীন্দ্রনাথ’ই হয়েছি —