• Uncategorized
  • 0

“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় তৃষ্ণা বসাক

ভারতবর্ষের রবীন্দ্রনাথ

আমাকে অত্যন্ত অবাক করে দিয়ে একটি ছোট ছেলে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করলে-
ঐ দেখো মা আকাশ ছেয়ে
মিলিয়ে এল আলো
আজকে আমার ছুটোছুটি
লাগল না আর ভালো।
ঘণ্টা বেজে গেল কখন
অনেক হল বেলা
তোমায় মনে পড়ে গেল
ফেলে এলাম খেলা।
যে দেশের বনানী ও পাহাড় অঞ্চলের ক্ষুদ্র সাঁওতাল গ্রামের ছোট ছেলে রবীন্দ্রনাথে কবিতা আবৃত্তি করে, সে দেশ বাংলা-ভাষী নয়, এ অদ্ভুত মন্তব্য কাদের? তারা এসে যেন দেখে যায়’ ( কালচিতি/ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)
উদ্ধৃতির গদ্যাংশটি এ আলোচনায় প্রাসঙ্গিক নয়, রাজনৈতিকভাবে সঠিকও নয়। আমরা অনেকেই জানি, সাঁওতালি বাংলার থেকে পৃথক একটি ভাষা, অষ্টম তফশিলভুক্ত একটি স্বীকৃত ভাষা যার বাহনও বাংলা লিপি নয়। অলচিকি নামে তাদের একটি নিজস্ব লিপি আছে। 
আমাদের আগ্রহ সেইখানটাতে যখন অন্যভাষার একটি বালক রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা শুনিয়ে আমাদের অবাক করে দ্যায়। এইরকম বিস্মিত হবার, অনেকক্ষেত্রে লজ্জা পাবার অভিজ্ঞতা আমদের প্রায়ই ঘটে। যখন ভারতের অন্য ভাষাভাষীর কণ্ঠে মূল বাংলায় আমরা শুনি রবীন্দ্রনাথ, কিংবা দেখি সেই ভাষায় অনূদিত রবীন্দ্র সাহিত্যের বিপুল সম্ভার, কিংবা ভাষার কাঁটাতার গ্রাহ্যের মধ্যে না এনে কেবলই অনুরোধ আসে রবীন্দ্রনাথের গান শোনার। ‘কালচিতি’ গল্পের একটি অংশে এমন অভিজ্ঞতা ধরা আছে-
-স্কুলের লাইব্রেরি আছে?
 -সামান্য কিছু বই আছে। রবীন্দ্রনাথের কিছু বই আনব এবার।
– কী বই পড়েছেন রবীন্দ্রনাথের? 
-কিছুই পড়িনি। আমি যে মিশনে সেলাই শিখতাম, সেখানকার টিচারদের কাছে ওঁর অনেক বই ছিল। ওঁর গানের বই আমার সবচেয়ে ভালো লাগে।
-রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে পারেন?
-গান গাইতে জানি নে। কোন গানই নয়। শুনতে ভালবাসি। একটা কথা বলব? এঁদের মধ্যে যদি কেউ গান করেন একটি, তবে, বড় ভালো হয়।’
ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে শুধু সাঁওতালিভাষীর কাছেই নয়, আক্ষরিকভাবেই রবির আলো ছড়িয়ে পড়েছিল কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা। রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় সাহিত্যের জনগণ মন অধিনায়ক, ভাগ্যবিধাতা। ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর সব অংশে একই সময়ে যেমন সমান আলো পৌঁছয় না, রবীন্দ্রনাথের দূর সঞ্চারের ক্ষেত্রেও তেমন ঘটেছে।কোথাও কম, কোথাও বেশি, কোথাও কিছু আগে, কোথাও কিছু পরে। আর রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে অন্য ভারতীয় ভাষাগুলির আহ্নিক ও বার্ষিক গতির নিরূপণ কিন্তু অন্বেষণ হিসেবে কম আকর্ষণীয় নয়।
কাশ্মীরে রবীন্দ্রনাথের গভীর প্রভাব পড়লেও পাঞ্জাবে কিন্তু প্রথম দিকে তেমন সাড়া পড়েনি। যখন পড়ল, তখন আবার প্রগতিশীল সাহিত্যের ধাক্কায় রবীন্দ্র বিরোধী সুর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যদিও প্রভাব একেবারে ছিল না, তা বলা যায় না। গীতাঞ্জলি-র অনুকরণে পাঞ্জাবি কবিতার সংকলনের নাম রাখা হচ্ছিল, যেমন পুষ্পাঞ্জলি। সদ্যোজাত শিশুপুত্র এমনকি শিশুকন্যারও নাম রাখা হচ্ছিল রবীন্দ্র। প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশায় রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের একটি পূর্ণাঙ্গ  আলোচনা হয় ১৮৯৮ সালে।‘উৎকল সাহিত্য’ বলে একটি পত্রিকায় এই আলোচনাটি করেন কবি নন্দকিশোর বালা। ১৯০৬ সালে প্রজাবন্ধু-র সম্পাদক ব্রজসুন্দর দাস রবীন্দ্রনাথের ওপর একটি মনোজ্ঞ প্রবন্ধ লেখেন। ওড়িশার ক্ষেত্রে এত দ্রুত সঞ্চারের কারণ হিসেবে বলা যায়, ওড়িশায় ঠাকুর পরিবারের জমিদারি এবং ব্রাহ্ম মন্দিরের কারণে রবীন্দ্রনাথকে জানার একটা প্রেক্ষিত তৈরি হয়েই ছিল। এই ধারা আরো বেগবতী হয় ১৯১৩-তে নোবেল পুরস্কারের পরে। আরও পরে, সবুজ দলের সাহিত্যিক গোষ্ঠী সাময়িক ব্রাত্য রবীদ্রনাথকে সোল্লাসে গ্রহণ করলেন। অসমিয়া ভাষার ক্ষেত্রেও ভৌগোলিক নৈকট্য ও ভাষাগত নৈকট্যের কারণে গ্রহণ প্রক্রিয়াটি রবি মধ্যগগনে যাবার বহু পূর্বেই শুরু হয়েছিল, যার হোতা ছিলেন কলকাতায় পড়তে আসা তিন অসমিয়া যুবক, পরবর্তীকালে যারা অসমীয়া সাহিত্যের দিকপাল হয়েছিলেন।  এই যুবকদের উদ্যোগে ১৮৮৮ সালে (রবীন্দ্রনাথ তখন ২৭ বছরের যুবক)। কলকাতায় অসমিয়া ভাষা উন্নতি সাধনী সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৮৯  সালে, চন্দ্রকুমার আগরওয়াল, হেমচন্দ্র গোস্বামী এবং লক্ষ্মীকান্ত বেজবড়ুয়া শুরু করেন অসমিয়া সাময়িক পত্র জোনাকি। এঁরাই রবীন্দ্র কাব্যের সুরধুনীকে ব্রহ্মপুত্রের স্রোতে মিলিয়ে দেন।  এই দুটি ভাষায় এবং অন্যান্য কয়েকটি ভারতীয় ভাষাতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির অনেক আগে থেকেই রবীন্দ্র অনুবাদের একটি বিরামহীন ধারা লক্ষ্য করা গেছে। একথা অনস্বীকার্য, নোবেল প্রাপ্তি এবং শান্তিনিকেতনে বিদ্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা রবীন্দ্র সাহিত্যের বহুবিধ চরিতার্থতায় অনুঘটকের কাজ করেছে, কিন্তু তার অনেক আগে থেকে, জাতীয় স্তরে রবীন্দ্রনাথ আদৌ অপরিচিত ছিলেন না। আর এটাও সমানভাবে সত্য, রবীন্দ্রনাথের অনুবাদকরাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, সেই সময়ে বা অব্যবহিত পরে, স্ব স্ব ভাষায় সাহিত্যের উজ্জ্বল সব নক্ষত্র। 
নিয়ামক ১৯১৩ আসার আগেই বেশ কিছু রবীন্দ্র রচনা অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়। উর্দুতে অনুবাদ করা হয় কিছু গল্প ও কবিতা। পি আর মেনন কয়েকটি গল্প মালয়ালমে অনুবাদ করেন। টি সূর্য নারায়ণ রাও চোখের বালি (নয়ন কাঁটাকামু) তেলুগুতে অনুবাদ করেন ১৯১১ সালে। অন্ধ্রপ্রদেশে অবশ্য ব্রাহ্ম সমাজ একটা অনুকূল পটভূমি আগেই তৈরি করে রেখেছিল। তেলুগু ক্লাসিকাল স্কুলের তিরুপতি শাস্ত্রী রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গল্প তেলুগুতে অনুবাদ করেন। কথা ও কাহিনী-র বৌদ্ধ ভাবনা নির্ভর কিছু কবিতা অনুবাদ করেন ভেলুরি শিবরামা শাস্ত্রী।
এখানে উল্লেখ করতেই হচ্ছে, ব্রাহ্ম সমাজের উপস্থিতি সত্ত্বেও ওড়িশায় অদ্ভুত একটি ঘটনা ঘটেছে। বিশ্বখ্যাতি পাবার আগেই সেখানে রবীন্দ্রনাথের একটি অনুগামী দল গড়ে উঠেছিল, যার অন্যতম কবি মধুসূদন রাও, আধুনিক ওড়িয়া সাহিত্যের তিন স্থপতির অন্যতম। ব্রাহ্ম মধুসূদন রবীন্দ্র শৈলীতে বেশ কিছু দেশাত্মবোধক ও ভক্তিমূলক কবিতা লেখেন। কিন্তু পরবর্তী কবিদের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেনি। কবি পদ্মচরণ পরে স্বীকার করেন, তিনি ইচ্ছা করেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়তেন না, পাছে প্রভাবিত হয়ে পড়েন।আর একটা কথা, ওড়িয়া কবিতার একটা বাস্তববাদী ধারা সূচনা থেকেই ছিল। ফকিরমোহন সেনাপতি ও অন্যান্য কবিরা সেই ধারা থেকে সরে এসে রবীন্দ্রকবিতার রোমান্টিক জগতে হারিয়ে যেতে চাননি। তাছাড়া হয়তো অভিজাত পরিবারের রবীন্দ্রনাথের রোম্যান্টিকতা মধ্যবিত্ত পরিবারের ওড়িয়া কবিদের আকর্ষণ করেনি। এইসব কারণে , বিশ শতকের আগে ওড়িয়া কবিতায় রবীন্দ্রনাথের তেমন প্রভাব দেখা যায় না। ইংরেজি রোম্যান্টিক কবিতা, সেইসঙ্গে রবীন্দ্রসৃষ্টিতে দীক্ষিত হলেন নতুন যুগের ওড়িয়া কবিরা, যাঁরা বিখ্যাত সবুজ দল নামে। তা সত্ত্বেও স্বাধীনতার আগে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ওড়িয়া ভাষায় অনুবাদ হয়নি। আর কোন ভারতীয় ভাষার ক্ষেত্রে যা ঘটেনি। এর কারণ হতে পারে, এই সময় ওড়িশাবাসীরা অনেকেই বাংলা পড়তে ও বলতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা মূল থেকে পড়তে পারতেন বলেই কি অনুবাদের দরকার হয়নি?
স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে, ওড়িশায় রবীন্দ্র সাহিত্যের অনুবাদে এগিয়ে আসেন প্রথিতযশা ওড়িয়া সাহিত্যিকরা , যেমন কালিন্দীচরণ পাণিগ্রাহী, ফকিরমোহন সেনাপতি। কিন্তু তাঁদের অনুবাদ কি সন্তুষ্ট করতে পেরেছিল উৎসাহী পাঠককে, কিংবা আকর্ষণ করতে পেরেছিল নিরুৎসাহী পাঠককে?
বিশিষ্ট ওড়িয়া লেখক-সমালোচক যতীন নায়েকের ‘ওড়িয়া অনুবাদে রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক একটি ভাষণ শোনার অভিজ্ঞতা এই প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ওড়িশার এক গ্রামের স্কুলে পড়া নায়েক তাঁর স্কুল পাঠ্য বইতে পেয়েছিলেন এইসব অনুবাদের যেগুলো তাঁর মনে হয়েছিল প্রাণহীন। তবু কি পৌঁছে যান নি রবীন্দ্রনাথ, সেই সুদূর প্রান্তে? নইলে গ্রামের কোন হাড়কঞ্জুষ বুড়োকে দেখলে নায়েক ও তাঁর সহপাঠীরা কেন ‘যজ্ঞনাথ কুণ্ডু যজ্ঞনাথ কুণ্ডু’ (পুত্রযজ্ঞ, গল্পগুচ্ছ) বলতে বলতে পেছন পেছন ছুটতেন?
শুধু ওড়িয়া  নয়, রবীন্দ্র-অনুবাদ আরও অনেক ভাষাতেই মূলের মান রক্ষা করতে পারেনি। যেমন উর্দু। অনেক অজ্ঞাতপরিচয় , অযোগ্য হাতে পড়ে বহু গল্প ও উপন্যাসের উর্দু তর্জমা মরা বাছুরের মূর্তি ধরেছিল। প্রকাশকের লোলুপতা অনেক কৌতুককর অনর্থও ঘটিয়েছিল। চারখণ্ডের গল্প সংগ্রহ উর্দুতে দাঁড়িয়েছিল ৩০ খণ্ডে, কেননা অনেক কাহিনিমূলক কবিতাকে গল্প বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল! 
তবে এসব অনুবাদই বিচ্ছিন্ন, এলোমেলো হাওয়া, কখনো রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিমায়া, কখনো ব্রাহ্মসমাজ, কখনো বা যুগের আগে এসে পড়া ব্যক্তিবিশেষের উদ্যম- এগুলির চালিকাশক্তি। এই হাওয়া ঝড়ে পরিণত হল নোবেল প্রাইজ পাবার পর। নোবেল প্রাইজ এবং গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদে ইয়েটসের লেখা ভূমিকা, রবীন্দ্রনাথকে শুধু বাংলা নয়, আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যের ভাগ্যবিধাতা করে তুলল। 
শুধু নোবেল পুরস্কার নয়, শান্তিনিকেতন রবীন্দ্র অনুবাদের ব্যপ্তিতে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল। শান্তিনিকেতনে ‘গুরুদেবের’ কাছে তীর্থযাত্রায় এসেছিলেন ভারতের নানা প্রান্তের কবি লেখক। যেমন কন্নড় কবি মস্তি, কৃষ্ণকুমার কাশ্যপ, পি বি নারাগেল, নারায়ণ মঙ্গল, এস জি কুলকার্নি প্রমুখ। তখন শান্তিনিকেতনের একেবারেই শৈশবাবস্থা। অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে এসেছিলেন  বি গোপালারেড্ডি (পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী), এ চালামাইয়া, এম বিশ্বেশ্বর রাও। আধুনিক তেলুগু কবিতার পথিকৃৎ এন সুব্বারাও ১৯১৬ সাল শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। মালয়ালম ভাষার বিখ্যাত লেখক কে জি পিল্লাই তো শান্তিনিকেত্নের ছাত্রই ছিলেন। তিনি মূল বাংলা থেকে রবীন্দ্রনাথের অনেক রচনা মালয়ালমে অনুবাদ করেছিলেন। এমনকি ত্রিবান্দ্রমে ফিরে গিয়ে তৈরি করেছিলেন টেগোর অকাদেমি। গুজরাতি লেখক এন আই পটেলও শান্তিনিকেতনে কিছুদিন ছিলেন। তিনি নৈবেদ্য গুজরাতিতে অনুবাদ করেন। 
ছাত্র হিসেবে যারা শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন, তাঁরা অনেকেই বাংলা শিখে, মূল রচনা থেকে নিজের নিজের ভাষায় রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করেছেন। এইভাবে রবিকৃতির সৌরভ ব্যাপন প্রক্রিয়ার মতো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। শুধু কবিতা, গল্প বা উপন্যাস নয়, কবির নাটকও অনুবাদ হতে থাকে, যার মধ্যে বি গোপাল রেড্ডির চিত্রাঙ্গদা এবং বিসর্জন উল্লেখযোগ্য অনুবাদ।
যারা শান্তিনিকেতনের প্রত্যক্ষ ছাত্র ছিলেন না, এমন অনেকেও ভগীরথের মতো রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গেছিলেন নিজের নিজের ভাষায়। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য –
নিরালা- হিন্দি
মধুরা চিনা –কন্নড়
এস ভারতী, টি এন কুমারস্বামী, টি এন সেনাপতি-তামিল
হরিনারায়ণ আপ্তে- মারাঠি প্রমুখ
শুধু অনুবাদ নয়, সমালোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের, ভিন্ন ভাষায় সাহিত্য সমালোচকদের কলমে। যেমন –
বিজরোনি, মাখদুম – উর্দু
মস্তি- কন্নড়
চালমাইয়া –তেলুগু
এইভাবে নানা ছলে নাম বলার মধ্যে দিয়েই জাতীয় স্তরে রবীন্দ্রনাথের ভেদ্যতা বাড়ছিল। ব্যাপারটা যত সহজ শোনাচ্ছে, তত সহজ নয়। পরাধীন ভারতে মানুষের আবেগ যে দুটি চিরাচরিত ধারায় বয়ে যেত, তার  একটি যদি স্বাধীনতা হয়, অন্যটি অধ্যাত্মবোধ। একটিতে গান্ধীজি, অন্যটিতে স্বামী বিবেকানন্দ ও শ্রী অরবিন্দ জনমানস অধিকার করেছিলেন। এঁদের রচনার সংখ্যাও কম ছিল না। এমনও হয়েছে, অরবিন্দ, বিবেকানন্দের দিকে ঝুঁকে অনেকেই রবীন্দ্রনাথের অনাস্বাদিত আনন্দের জগত, যে আনন্দে প্রাণ লাবণ্যে ভরে ওঠে, সে জগতের দরজা খুঁজে পাননি, বা পেলেও খুলতে চাননি। যেমন কন্নড় কবি কুভেম্পু। 
এক্ষেত্রে বাঙালি লেখকদের সঙ্গে তাঁকে প্রতিযোগিতায় পড়তে হয়েছে, সমকালে এবং উত্তরকালেও। সবচেয়ে বেশি অনূদিত বাঙালি লেখক হিসেবে নাম করতেই হবে শরৎচন্দ্র, বিমল মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী প্রমুখের। বাংলার বাইরে  শরৎচন্দ্রের এমনি প্রভাব যে তেলুগু ভাষার অনেক পাঠকই সন্দেহাতীত ভাবে জানেন শরৎবাবু তেলুগু ভাষারই লেখক। অন্যান্য অনেক ভারতীয় ভাষাতেও তাই। এই ঘটনা কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বেলায় ঘটেনি। যদিও অষ্টম তফশিল ভুক্ত প্রায় সব ভাষাতেই অন্তত তাঁর গীতাঞ্জলির অনুবাদ বেরিয়েছে। যেমন বোড়ো ভাষাতে গীতাঞ্জলি অনুবাদ করেছেন বিশিষ্ট বোড়ো কবি স্বর্ণপ্রভা চাইনারি।  অষ্টম তফশিল বহির্ভূত  ককবরক ভাষায় গীতাঞ্জলি অনুবাদ করেছেন বিখ্যাত ককবরক কবি চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং ২০১১ সালে। সাহিত্য অকাদেমি থেকে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় পাওয়া যায় ২১টি ছোট গল্প, রবীন্দ্র চয়নিকা, গোরা, চোখের বালি, তাসের দেশ, প্রবন্ধ সংকলন ইত্যাদি। এদের মধ্যে হিন্দিতে ২১ টি ছোটগল্প (ইক্কিশ কহানিয়া) তো প্রায় বেস্ট সেলারের পর্যায়ে পড়ে। তবু রবীন্দ্রনাথ টার্গেট ল্যাঙ্গয়েজের পাঠকের কাছে শরৎবাবুর মতো রবীন্দ্রবাবু কখনো হতে পারেননি। অবাঙ্গালি পাঠকের আগ্রহ ঘোরাফেরা করেছে তাঁর কয়েকটি সীমিত কবিতার মধ্যে, যেগুলোকে ঠিক তাঁর প্রতিনিধিত্বমূলক বলা যায় না। 
যেমন ‘ভজন পূজন সাধন আরাধনা’ (ধূলিবসন)
‘ওরা কাজ করে’
এইসব কবিতার মানবতাবাদ আকর্ষণ করেছে কাশ্মীরি কবি আজাদ, মাস্টারজীকে। ঈশ্বর দুহাতে ধুলো মেখে সাধারণ মানুষের সঙ্গে রৌদ্রে জলে কাজ করছেন- এই ইমেজারি মুগ্ধ করেছে প্রখ্যাত গুজরাতি কবি উমাশংকর যোশীকে। কখন গীতলতা, কখনো প্রকৃতি বন্দনা, কখন মিস্টিসিজম, কখন উপনিষদের সৌরভ-কবির বিভিন্ন দিক বিভিন্ন ভাবে আকর্ষণ করেছে বিভিন্ন  ভাষার কবি লেখকদের। কৌতূকজনক ঘটনাও কম ঘটেনি।উর্দু কবি আকবর এলাহাবাদি টেগোরের প্রতিকৃতির মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন খাম্বাজ রাগিনীর রূপ! 
শুধু অনুবাদ নয়, প্রভাবের দিকটিও আছে। অনেক লেখক, নিজের শৈলী বজায় রেখেও রবীন্দ্রনাথের প্রভাব এড়াতে পারেননি। যেমন
মহাদেবী বর্মা – হিন্দি
সুরেন্দ্র ঝা সুমন –মৈথিলী
মাস্টারজি- কাশ্মীরি
তালিকা দীর্ঘ করে লাভ নেই। মনে রাখতে হবে, এঁরা প্রত্যেকেই স্ব স্ব ভাষার বিশিষ্ট লেখক। তাই একটা প্রশ্ন না জেগে পারে না, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক কেন শুধুই একমুখী থেকে গেল? তাঁদের লেখার অনুবাদ দূরে থাক, পাঠ, শ্রবণ বা কীর্তনের মাধ্যমে সহলেখকদের লেখার স্বাদ নেওয়ার যে ধারা আছে, তা সেভাবে দেখা গেল না কেন রবীন্দ্র জীবন প্রবাহে? ‘দিবে আর নিবে’-সেভাবে হল কই? কাশ্মীরে গিয়ে কাশ্মীরি কবি মজহরের প্রশংসা ছাড়া আর কোন ভারতীয় কবি লেখকদের লেখার উল্লেখ কেন পাই না সেভাবে তাঁর লেখায়? সেভাবে হিন্দি না জেনেও তিনি তো মধ্যযুগের হিন্দি সাহিত্যের স্বাদ পেয়েছিলেন।
‘আমি হিন্দি জানি না, কিন্তু আমাদের আশ্রমের একটি বন্ধুর কাছ থেকে আমি প্রাচীন হিন্দি সাহিত্যের আশ্চর্য রত্ন সমূহের কিছু কিছু পরিচয় লাভ করেছি’ (সাহিত্যের পথে, সভাপতির অভিভাষণ, ১৩৩০ জৈষ্ঠ) , এই আশ্রমবন্ধু বলা বাহুল্য ক্ষিতিমোহন সেন।
সেইভাবে অনেক ভারতীয় ভাষার স্বাদ তো তিনি পেতেই পারতেন শান্তিনিকেতনে বসে, যে শান্তিনিকেতন আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠেছিল ভারতের মহামানবের সাগরতীর। এই প্রশ্ন, রবীন্দ্রভুবনের অনালোকিত এক অংশের অস্পষ্ট নকশা যেন তুলে ধরে চোখের সামনে। আমাদের যাত্রা এইবার শুরু হবে। 
তথ্যসূত্র – 
১। Tagore’s Influence on Modern Indian Poetry, V K Gokak, Indian Literature : Vol 4, 1961
২। Tagore on Odia and Assamese Literature, Dr Jyotsna Biswal Rout
৩। বিভূতিভূষণ রচনাবলী, একাদশ খন্ড, মিত্র ও ঘোষ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।