যে ঘরটার সাথে জন্মের প্রথম স্মৃতি, তার লাল রঙের মেঝে। আসবাবের এমন কোনো বিশেষত্ব ছিল না, যা মনে রাখা যায়। শুধু আমার ওই গুটগুটে বেলার সাইজের এক রবি ঠাকুরের ছবি ছাড়া। তা ঐ গুটগুটে বেলাতে রবি ঠাকুরকে চিনলাম কি করে! সে বেশ মজার গল্প। আমার সাহিত্যপ্রেমী বাবা একটা ছড়া সব সময় শোনাতো,
নাম রেখেছি বাবলারানী, একরত্তি মেয়ে
হাসিখুশি চাঁদের আলোয় মুখটি আছে ছেয়ে।
বাবলা ছেড়ে নাম দিয়েছিল বাবলি। কিন্তু কাকুর দেওয়া ‘ মৌ ‘ নামটাই বেশি আদর পেল। বাপি কিন্তু হাল ছাড়েনি। বাবলা থেকে গুবলা। অফিস থেকে ফিরেই বলত, “গুবলাটা কই ? দেখছি নাতো! “
তো এই ছড়াটা নাকি রবি ঠাকুরের লেখা। তাই? আরো বল। খুব মুখস্থ করতে পারতাম। লুকোচুরি, বীরপুরুষ – আরো অনেকগুলো শিখিয়েছিল বাপী। আর আমি কি করতাম! বাড়িতে কেউ বেড়াতে আসলে সেগুলো ধরেবেঁধে শুনিয়ে শুনিয়ে কান ঝালাপালা করে দিতাম।
আমাদের ইউটিউব ছিলনা, স্টারমেকার ছিল না। ছিল রোজ সন্ধ্যের লোডশেডিং আর ছাদে গানের লড়াই। ‘ অন্তক্ষ্যারি ‘ কথাটাও তখন জানতাম না। যৌথ পরিবারে অনেক ভাই-বোন এমনকি পাড়াতুতো দিদি বোনদেরও ডাকা যেত অনায়াসেই। আকাশ ভরা তারার নিচে বসে আমরা শুধু রবি ঠাকুরের গান গাইতাম।
একটু বড় হয়ে নৃত্যনাট্য। ‘কালমৃগয়াতে ‘বনদেবী, ভানুসিংহের পদাবলীর ‘ গহনকুসুমকুঞ্জমাঝে ‘ নীল শাড়িতে আমাদের প্রত্যেকের রাধা হয়ে ওঠার গল্প। তখন নবম শ্রেণী। স্কুলে অনেক অনুষ্ঠান হতো। প্রথমবার অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ায় আনন্দে আমরা নবম শ্রেণী তখন আকাশ ছুয়েছি। ১৫ ই আগষ্ট স্বাধীনতা দিবস। আমি গান গাইলাম, “ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা” তখন আমাদের হেডমিস্ট্রেস হাসিকনা রায়। ব্যক্তিত্বে থমথমে মুখ। শুনেছিলাম ফ্রিডম ফাইটার ছিলেন। জেলও খেটেছেন। পরেরদিন হঠাৎ তলব বড়দিমনির অফিসঘরে। শান্তশিষ্ট মানুষ আমি। তেমন কিছু অন্যায়, অঘটন ঘটাইনি কখনো। লেখাপড়ায় ভালো বলে একটু খ্যাতিও আছে। তবু বুক দুরদুর নিয়ে চললাম এটেনডেন্ট বীরু দার সাথে। “আসবো দিদি? “
“এসো। তুমি কাল গেয়েছিলে গানটা? আবার শোনাও।”
গাইলাম । আমার কচি গলায় যতটা সম্ভব দরদ ছুঁইয়ে। বরাবর চোখ বন্ধ করে গান গাওয়া আমার অভ্যাস। চোখ খুলে দেখি ওই রাশভারী চোখে ভারতবর্ষের সমস্ত সুখ, দুঃখ, আনন্দ, লজ্জা সব বয়ে যাচ্ছে শ্রাবণের অঝোর ধারায়। আমি হতবাক। একটা মানুষ কত ভাবে মানুষকে গড়ে, বেঁধেছেন, ঘাড় ধরে ভালোবাসিয়েছেন – সব যেন তাঁর কাছে পুতুল খেলা।
এখনো সব প্রশ্ন তার কাছে। সব ব্যথা জমা রাখি, সব সুখ উজাড় করে দিই তার কাছেই। জানি, শেষ দিনটি অবধি নিজের সত্বার সাথে মিশে থাকা ঐ আদ্যিকালের বদ্যিবুড়োকে জানা আমার ফুরাবে না। কক্ষনো না।