• Uncategorized
  • 0

বাংলাদেশের বিজয় দিবস উপলক্ষে লিখলেন- শাপলা সপর্যিতা

দোহাই, এ মাটিতে মৃত্যুর অপচয় থামা

১৯৪৭ সালে ঘটেছিল এই পাপ। তারই প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছে বাঙালি আজ অবধি। বাংলাদেশের বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপটে কথাটি যে কারণে বলেছি তা বিশ্লেষণ করতে একটু পেছনে ফিরি চলুন;
১৯৩৩ সালে লন্ডনে চৌধুরী রহমত আলীর নেতৃত্বে একদল মুসলিম ছাত্র ‘পাকিস্তান’ শব্দটি তৈরি করেন।
P – PUNJAB, K– KASHMIR, S – SIND, TAN – BALUCHISTAN
এই চারটি পাশাপাশি অবস্থিত মূল ভূখন্ডের প্রথম অক্ষর ও অংশবিশেষ নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠণের চিন্তা করা হয়েছিল। তাতে উত্তর- পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশও বাদ পড়েছিল। পূর্ব বাংলার তো নামই ছিল না। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে সার্বভৌম দেশ গঠণের চিন্তা করা হয়। কিন্তু মুসলিম লীগের একদল নেতা পূর্ব বাংলাকে হাজার মাইল দূরে পাঞ্জাব ও সিন্ধুর সাথে যুক্ত করে একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র গঠণের গো ধরেছিলেন। অবশেষে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে যুক্তিতর্কের সকল পথ এড়িয়ে চরম সাম্প্রদায়িক উস্কানি তুলে শেষ পর্যন্ত হাজার হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভুখন্ড নিয়ে গঠিত হয়েছিল একটি নতুন দেশ – পাকিস্তান। সর্ব ভারতীয় অসাম্প্রদায়িক মুসলিম নেতারা যার কোনো অর্থ খুঁজে পাননি। এই ঘটনার পর পরই মওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন,
‘এটি শুধু ভারতের পক্ষেই নয় মুসলিমদের পক্ষেও হানিকর। ‘পাকিস্তান’ শব্দটিই অরুচিকর একটি শব্দ। এর থেকে মনে হয় পৃথিবীর কোথাও কিছুটা শুদ্ধ আর বাকি সব অশুদ্ধ। শুদ্ধ আর অশুদ্ধ বলে এলাকা ভাগ করা ইসলাম বহির্ভূত; এর সাথে বরং সেই গোড়া ব্রাহ্মণের মিল বেশি যা মানুষ আর দেশকে সূচি আর ম্লেচ্ছে ভাগ করে। গোটা ভারতই আমার ভূখণ্ড। আমি এর রাজনৈতিকক জীবন গড়ে তোলার অংশীদার। একজন মুসলিম হিসেবে আমার এই অধিকার আমি কিছুতেই বিসর্জন দিতে রাজি নই। বাপ-দাদার কাছ থেকে যে সম্পদ আমি পেয়েছি তা ছেড়ে দি্য়ে শুধু এক টুকরো নিয়ে খুশি হওয়া আমার কাছে কাপুরুষতা। বর্তমানের উন্মাদনা কেটে গেলে ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টি বিবেচনা করার সময় হলে আজকের সমর্থকেরা নিজেরাই পাকিস্তানকে মুসলিম স্বার্থের পক্ষে হানিকর বলে অগ্রাহ্য করবে।’
এত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও রক্ষা করা গেলনা। শুধুমাত্র ধর্মকে ভিত্তি করে ভারত ভাগ হয়ে গেল। হাজার মাইলের ব্যবধান। পোষাক খাদ্য ভাষা সংস্কৃতি অর্থাৎ পুরোপুরি ভিন্ন জীবনপ্রণালীতে অভ্যস্ত দুটি ভূখণ্ড কেবল মুসলিম বলে এক হয়ে গেল। জয় হলো কিছু ধর্মোন্মাদ মৌলবাদীর স্বেচ্ছাচারীতার। পাকিস্তানের প্রথম গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ যার পূর্ব পুরুষ ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে এসে করাচিতে অবস্থান নিয়েছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বাস ঢাকায় হওয়া সত্ত্বেও করাচিকে করা হলো পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানী। তারপর থেকেই শুরু হয়ে গেল শোষন শাসন অত্যাচার আর পুরোপুরি আগ্রাসন। এলো ভাষার ওপর আঘাত। পূর্ব পাকিস্তানবাসী আর বাংলায় কথা বলতে পারবে না। শুরু হলো নীলনকশা বাস্তবায়নের প্রস্তুতি। মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ এলেন পূর্ব পাকিস্তানে। ১৯৪৮ সাল। ২১ মার্চ। রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করলেন
URDHU AND URDHU SHALL BE THE STATE LANGUAGE OF PAKISTAN
প্রতিবাদে ফেটে পড়ল পূর্ব পাকিস্তান। সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে প্রতিষ্ঠা করার পেছনেও ছিল এক দুরভিপ্রায়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগনকে স্কুল কলেজ চাকরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে অবদমিত করাই ছিল মূল লক্ষ্য। পূর্ব পাকিস্তানবাসী মেনে নেয়নি সেটা। কিছু তাজা প্রাণ বিসজর্ন হলো। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও বহু বাঙলা ভাষাভাষির রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তান ফিরিয়ে দিল বাংলাকে আবার পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। জিন্নাহর মৃত্যুর পর আইয়ুব খান পাকিস্তানের নেতা হলেন। তার জন্মস্থান পাঞ্জাব। অতএব রাজধানী পাঞ্জাবে স্থানান্তরিত করা হলো। তারপর রাওয়ালপিণ্ডি হয়ে ইসলামাবাদে। এভাবে তিনবার রাজধানী বদলানো হলো। আর খরচ হলো কেন্দ্রের কোটি কোটি টাকা। আইয়ুব খান ছিলেন একজন স্বেচ্ছাচারী অপরিণামদর্শী নেতা। তিনি উপরে ইসলামের লেবাসধারী একজন বর্বর শাসক ছিলেন। কোরআন কিংবা সৃষ্টিকর্তার কোনো স্থান তার পৃথিবীতে ছিলনা। কখনো জুম্মার নামাজ পড়তেন না। পানাহার ধুমপান এবং শুকরের মাংসে আসক্তিতেই তিনি দিন কাটাতেন। আইয়ুব খানের আমল থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর আগ্রাসন মারাত্মক রূপ ধারণ করতে শুরু করে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সময়ে ‘এক পাকিস্তান অর্থনীতি তত্ত্ব’ নামে পশ্চিম পাকিস্তান অর্থনৈতিক সংহতির কথা প্রকাশ করেন। আর ভেতরে ভেতরে অবস্থা হয়ে পড়ে ভিন্ন। পশ্চিম পাকিস্তানের বিপুল পরিমান ব্যয় শোধ হতে লাগলো পূর্ব পাকিস্তানের ধনাত্মক আয় থেকে। এভাবে বছরের পর বছর পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হতে থাকে। ভেতরে ভেতরে দানা বাঁধতে থাকে অসন্তোষ। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠলে শেখ মুজিবর রহমান ছয় দফা উত্থাপন করেন। ১৯৬৬ সালে লাহোরে ছয় দফা পেশ করার সাথে সাথে করাচিতে এসে তিনি অপমানিত হন। এমনকি তাকে হত্যার চেষ্টাও করা হয়। ৭ই জুন পূর্ব পাকিস্তানে ৬দফার সমর্থনে হরতাল আহবান করা হয়। এই হরতালে আইয়ুব সরকারের ভিত কেঁপে ওঠে। হরতালের খবর সারাদেশে প্রচার করার জন্য দৈনিক ইত্তেফাক নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়। সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয়। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবর রহমানকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে গ্রেফতার করা হয়। দেশি বিদেশি সাংবাদিক ও টেলিভিশনের সামনে শেখ মুজিবর রহমানের বিচার কার্য পরিচালনা করা হয়। প্রতিদিন সংবাদ পত্রের পাতায় এই মামলার রাজবন্দি শেখ মুজিবের মামলার জবানবন্দি ও জেরা প্রকাশিত হতে থাকলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানবাসী আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠতে থাকে। মিছিলের পর মিছিলে ছাত্র জনতা রাজপথ কাঁপিয়ে তোলে। জারি হয় ১৪৪ ধারা। ছাত্র জনতার মিছিলে গুলি, নির্যাতন, গ্রেফতার, স্নোগানে স্লোগানে প্রতিবাদের ধ্বনি প্রতিধ্বনিতে টলমল করে ওঠে আইয়ুবের গদি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এভাবেই বাংলার স্বাধীনতাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দেয়। চলতে থাকে একটানা ধরপাকড়। সকল দলের ঐক্যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠণ করা হয়। এবং ছয় দফার পরিবর্তিত সংস্করণ ১১ দফা প্রণয়ন করে সাধারণে প্রকাশের জন্য ডাকসু কার্যালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলন ডাকা হয়। ১৯৬৯ সালে ১১ দফা ঘোষণার পর পরই বিক্ষোভ সমাবেশে আবার উত্তাল দেশ। আবার ১৪৪ ধারা জারি হয়। পুলিশের গুলিতে নিহত হন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আসাদুজ্জামান। সাথে সাথে সারা দেশজুড়ে শুরু হয় তুমুল অসহযোগ। ইডেন কলেজ থেকে মেয়েরাও শোক মিছিলে বের হয়ে আসে। ফেব্রুয়ারি মাসে সেনানিবাসে ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হয়। সরকারের এই পৈশাচিকতায় জনতা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। অন্যদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শামসু্জ্জোহাকে বেয়োনেটের আঘাতে রক্তাক্ত করে ফেলে রেখে গেলে হসপিটালে নেবার পর তিনি মৃত্যু বরণ করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঊনসত্তরের এই গণঅভ্যুত্থানে বাঙালি জাতি রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয়। কৃষক শ্রমিক ছাত্র নেতা সকলের মিলিত অভুত্থানে পশ্চিম পাকিস্তানের পতনের শেষ রেখা টেনে দেয়া হয়। পরবর্তীতে শোষন আর অত্যাচারের মাত্রা ক্রমউর্ধ্বগতির কারণে ৭ই মার্চ রেসকোর্সে ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন। যার যা আছে – লাঠি বৈঠা বল্লম নিয়ে যুদ্ধে নামার জন্য প্রস্তুত হতে বলেন দেশবাসীকে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর পশ্চিম পাকিস্তান বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ চালায়। ২৬ মার্চ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে ঘোষনা করলে শুরু হয় নয় মাসের লাগতার মুক্তিযুদ্ধ। অসংখ্য সাধারণ মানুষ ঘরছাড়া হয়। দলে দলে হিন্দু-মুসলিম পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। সাধারণ যুবক ছাত্র নারী পুরুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বন্ধুরাষ্ট্র ভারত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। অজস্র মায়ের বুকের তাজা রক্ত, অসংখ্য নারীর সম্মানহানি, বাঙালি জাতিকে বুদ্ধিজীবী শুন্য করার বর্বরতম বিকারগ্রস্থ ভয়ানক এক কালো অন্ধকারের নয় মাস পার করে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের বিজয় অর্জিত হয়। ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণের দলিল হস্তান্তরের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান বাংলাদেশের প্রাপ্য অধিকার ফিরিয়ে দেয়।
এই হলো বাংলাদেশের বিজয়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। যে ধর্মীয় চেতনার দোহাই দিয়ে একদিন ভারত থেকে আলাদা করে কেবল মুসলিম বলে পূর্ব পাকিস্তানকে যুক্ত করা হয়েছিল আর একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে। সেই ধর্মের বাতাবরণ শোষক মুসলিমের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি নির্যাতিত মুসলিমদেরকে। অথচ এই গোয়ার্তুমির দায় ভোগ করছে আজও অসংখ্য বাঙালি, বাংলাদেশবাসী। অসংখ্য মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পরদেশবাসী হয়েছে। শেকড় ছেড়ে যাবার বেদনা বহন করে আজও ভারত বাংলাদেশের অসংখ্য বাঙালি মুসলিম ও হিন্দু হৃদয়বিদীর্ণ স্মৃতিতে জর্জরিত হয়ে আছে। কি লাভ এই আগ্রাসনে! কি লাভ এই জাতিভেদ আর ধর্মভেদে! যুগে যুগে ধর্মকে অবলম্বন করে যত যুদ্ধ যত হানাহানি হয়েছে আজও চলছে তার সমপরিমান আর কোনো কারণ নেই যুদ্ধের ইতিহাসে। ধর্ম একটি ব্যক্তিগত বিষয়। আমার বাড়িতে আমি কি দিয়ে ভাত খাব, কি কাপড় পড়বো সেটা যেমন একা আমার রুচি আর পছন্দ অনুযায়ী হবে ধর্ম পালনও ঠিক তেমনি। একটি ব্যক্তিগত আইন পালনকে কেন্দ্র করে ধর্মাধর্মের ক্ষুরধার পথ আর কত রক্ত নেবে! এর দায়ভার একদিন এ মানবজাতিকেই শুধতে হবে। এই ভাবনাটা মাথায় রেখে আজ বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের মাহেন্দ্রক্ষণে সকল মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মা বোন ভাইদেরকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম্। অবশেষে দেশে দেশে মানুষের শুভ চেতনা উদয়ের অভিপ্রায় রেখে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কথাটি আর একবার বলতে চাই,
খুনের দোহাই লাগে দোহাই ধানের
দোহাই মেঘের আর বৃষ্টি জলের
দোহাই, গর্ভবতী নারীর দোহাই
এ মাটিতে মৃত্যুর অপচয় থামা।
জাতির রক্তে ফের অনাবিল মমতা আসুক
জাতির রক্তে ফের সুকঠোর সততা আসুক
আসুক জাতির প্রাণে সমতার সঠিক বাসনা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।