সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শাশ্বতী নন্দী (পর্ব – ৪)

নিশিভোর

পর্ব – ৪

আগে যা ঘটেছে
রাজ্যের কুখ্যাত বাবাজী, শিব শম্ভু মহারাজ বর্তমানে পলাতক। তাকে গ্রেফতারের জন্য গঠিত হয়েছে ব্লু হেভেন মিশন। লেডি আই পি এস, গৌরী সিনহাকে, এই মিশনের শীর্ষ নেতৃত্বে রাখা হয়েছে। কিন্তু নিজের টিম নিয়ে গৌরী যখন অপারেশন চালাবার জন্য প্রস্তুত, তখনই একটা ভিডিয়ো ক্লিপিংস সোর্স মারফৎ হাতে আসে। গত বছর বাবাজীর জন্মদিন উদযাপনের একটি ছবি। সকলের ধারণা ওই জন্মদিন পালনে এবারও বাবাজী উপস্থিত হবে কোনও ছদ্মবেশে। এদিকে গৌরীর স্বামী, আইপিএস, অনুভব সিনহা, প্রথম থেকেই স্ত্রীর এই মিশনে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে বিরুদ্ধাচরণ করে যায়। সুতরাং ঘরে বাইরে যুদ্ধ করেই ওকে এগোতে হচ্ছে।
অন্য আর এক দিকে সুমনা, সেই সাংবাদিক মেয়েটি, যার সঙ্গে আলাপের সূত্রপাত বাবাজীর কাজকর্মের সূত্র ধরেই, সে এখন গৌরীর খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছে। কিন্তু সুমনাকে নিয়েও একটা ভয় দিন দিন বাড়ছে। গৌরীর সিক্সথ সেন্স বলছে, সুমনাকে খবরের টোপ দিয়ে বাবাজী ক্রমশ তার ঝিলমিলপুরের আশ্রমের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
(৬)
বদলির অর্ডার অনুভবের হাতে পৌঁছতেই সে ফোন করে গৌরীকে, ‘কাল সকালেই উইথ ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজেস দার্জিলিং রওনা দিচ্ছি। এবার একা সামলাও তোমার ঘর, বাড়ি, সংসার’।
গৌরী প্রস্তুতই ছিল, আগেই কানে এসেছে খবরটা। আই পি এস, অনুভব সিনহাকে একটা স্পেশল সেলের দায়িত্ব দিয়ে দার্জিলিং পাঠানো হচ্ছে।
-দুটো ভার তোমায় দিয়ে যাব। -অনুভবের গলায় হাসি। -এক, আমার বাবা। – বলেই সামান্য দম নিল ও। – দিনান্তে একবার অন্তত ফোন কর। আর দ্বিতীয়, ওই কুচো দুটোর, আমার আশা আর ঊষা। কিছুই করে যেতে পারলাম না ওদের জন্য’।
অনুভবের কথায় একটা মন খারাপের সুর। যেন চিরকালের জন্য দেশ ছেড়ে ও অনত্র চলে যাচ্ছে।
গৌরীর চোখ কমপিউটর স্ক্রিনে, মাউস ঘোরাতে ঘোরাতে উত্তর দেয়, ‘তোমার বাবার অ্যাটিটিউড টুওয়ার্ডস মি, তোমার অজানা নয়। তারপরেও …
-ইয়েস বলছি। কারণ বাবা এখন সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া এক মানুষ। বিলিভ মি। ওই অসুখটাই বাবাকে …
কানে লাগল কথাটা। – ‘কোন অসুখ?’ গৌরী স্ক্রিন থেকে মুখ তোলে।
অনুভব চুপ।
উৎকণ্ঠা বাড়ে গৌরীর। জ্যোতিপ্রিয় অসুস্থ! কই, কানে আসে নি তো আগে! অবশ্য সে শ্বশুরমশাইকে সব সময় এড়িয়েই চলে। বিয়ের পর থেকেই দুজনের সম্পর্কে এত বিষ মিশে গেছে! তবু এই মুহূর্তে ধাক্কা লাগল।
-বাবার ক্যানসার ধরা পড়েছে। থ্রোট ক্যানসার, ফোর্থ স্টেজ। জাস্ট দিন সাতেক আগে রিপোর্ট বেরিয়েছে। আমায় না জানিয়েই ডাক্তার বদ্যি করেছিল। কিন্তু বায়োপসি রিপোর্ট পেতেই ভেঙে পড়েছে। আমি তখনই জানতে পারলাম।
শেষ কথাগুলো বলার সময় অনুভব নিজেও ভেঙেচুরে যাচ্ছিল বোঝা যায়। -মস্ত বড় ভুল হয়ে গেল, জানো গৌরী। এ অবস্থায় বাবাকে ছেড়ে যাচ্ছি, কিন্তু অর্ডারটা অফিশিয়ালি বেরিয়ে গেছে, কিছু করার নেই। আমায় যেতেই হবে।
কয়েকটা কথা গৌরীর মুখ থেকে ঠেলেঠুলে বেরিয়ে আসতে চাইছে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে কথাগুলোকে সে অর্গলে বেঁধে রাখে। একসময় জ্যোতিপ্রিয় সিনহা তাঁর প্রতি বহু অবিচার করেছেন। ঘরের বউ পুলিশে চাকরি করবে, মানেন নি একেবারেই। অথচ মুখে বলতেন তিনি সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে গলা ফাটাতেন নারী স্বাধীনতা, নারী আন্দোলন নিয়ে।
মুখ আর মনে যারা আলাদা, গৌরী সযত্নে এড়িয়ে চলে সেই মানুষগুলোকে। বছর কয়েক আগে একটি মহিলা ঘটিত ব্যাপারেও জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। মিডিয়া খুঁচিয়ে আরও ঘা করল। অনুভব মাথা না গলালে, আজ জ্যোতিপ্রিয়র জায়গা হত গারদের ওপাশে।
তাই ওই মানুষটার প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন ঘৃণা তার মধ্যে আছে। যদিও এই মুহূর্তে মায়া লাগল। হয়তো জ্যোতিপ্রিয়র চাইতেও অনুভবের প্রতি বেশি। নিজের অজান্তেই কখন যেন মুখ থেকে বেরিয়ে এল এক অঙ্গীকার, ‘তুমি নিশ্চিন্তে তোমার নতুন জায়গায় জয়েন কর, আমি আছি’।
এদিকে বাবাজীর জন্মদিনের তারিখ ক্রমশই এগিয়ে আসছে। গৌরী ভেতরে ভেতরে অস্থির। এখনই কি অপারেশন শুরুর সঠিক সময়? যদি তাদের দিকভ্রান্ত করে দেওয়ার জন্য এটা একটা নতুন চক্রান্ত হয়!
নইলে শিবশম্ভুর মতো হার্ড কোর ক্রিমিনাল এতখানি কাঁচা কাজে নামবে! সে ভালই জানে তাকে ধরার জন্য চারিদিকে থিক থিক করছে পুলিশ। তারপরেও সে আসবে ঝিলমিলপুরে জন্মদিন পালন করতে! না। হিসেবে কোথাও ভুল হচ্ছে।
ওদিকে অ্যাকশন প্ল্যানটাও অ্যাপ্রুভ হয়ে চলে এসেছে ডিজির দফতর থেকে। ফোনও এসেছে তাঁর কাছ থেকে, ‘এগিয়ে যাও গৌরী। আই উইশ ইওর সাকসেস। আর কোনও সাহায্যের দরকার হলে, প্লিজ ডোন্ট হেসিটেট’।
তবু গৌরী আতান্তরে। এর মধ্যেই একদিন রোহিত হাঁপাতে হাঁপাতে খবর দিল, ‘ম্যাডাম, সেই প্রাইভেট কার ড্রাইভার, যে ইনফর্মার সেজে বাবাজীর ভিডিয়ো ক্লিপিংস পাঠিয়েছিল, তার নম্বর যতবার ট্রাই করছি, বলছে সুইচড অফ’।
গৌরীর মুখে হাসি, ইঙ্গিতে বোঝাল এরকম একটা ঘটনা হওয়ারই ছিল। রোহিত ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, পেছন থেকে ডাকল সে, ‘আমাদের যে টিমটা দার্জিলিং থেকে নেওয়া হবে, তার মধ্যে ওই লোবো তেনজিং আছে, না? ওর নাম আর নম্বর দুটোই আমায় একটু লিখে দাও তো’।
রোহিতের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখ। আমতা আমতা করছে, ‘লোবোর ফোন কিন্তু চালু আছে ম্যাডাম। ছেলেটা ভাল। এই তো সেদিনও কথা হল’।
-তুমি আজ আর একবার কথা বল ওর সঙ্গে, ওর নাম, নম্বর দুটোই জেনে আমায় জানাও। আর আজকের পর থেকে ওর সঙ্গে আর কোনও কথা বলবে না। অপারেশনের ব্যাপারে তো নয়ই। গট ইট? এবার এসো’।
মনটা আজকাল সব সময় কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে গৌরীর। এই অপারেশনটা নিয়েও স্বস্তি পাচ্ছে না। অনেকগুলো সূত্র কাছে এসেও যেন দূরে চলে যাচ্ছে। তাই কি আত্মবিশ্বাসেও আজকাল চিড় ধরছে? একটা ভীতি চেপে বসতে চাইছে। পারবে কি সে এত বড় একটা মিশনে সফল হতে?
অনুভব চলে যাওয়ার পর আজকাল বাড়িটাও ফাঁকা ফাঁকা লাগে। দুটো মাত্র প্রাণী, সে আর বটুকদা। একবার ভেবেছিল, আশা আর ঊষাকে নিয়ে আসবে এখানে, বটুকদা রাজি হল না। বলে, ‘ওই দুটো কচি মেয়ে, কার ভরসায় থাকবে সারা দিন? ওর বাবা মা তো যে যার রোজগারে বাইরে বাইরে থাকবে’।
কথা ঠিক। গৌরীও তাই আর এগোয় নি ও ব্যাপারে। ওদিকে অনুভবকে দেওয়া কথা রাখতেই, জ্যোতিপ্রিয় সিনহাকেও সে প্রতিদিনই একবার করে ফোন করে। কিন্তু কোনদিনই উনি ফোন তোলেন না।
অনুভব শুনে হেসেছে, ‘অভিমান, অভিমান। যাওয়ার বেলায় মানুষ বড় অভিমানী হয়ে যায়’।
আজকাল রোজই কথা হয় অনুভবের সঙ্গে, দিনে তিনবার কখনও চারবার। অবাক লাগে, আগে কখনও এত ফোনাফুনি হয়েছে কি? হয়তো, এটাই সত্যি। দূরে চলে গেলেই মানুষ সব চাইতে বেশি কাছাকাছি আসে।
 এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন সুমনার ফোন। -কেমন আছো? – গলাটা ভীষণ নিস্তেজ শোনাচ্ছিল।
গৌরী হাসে, ‘আমি ভাল মন্দর মাঝখানে। সো সো। তবে তোমার মনটা এত খারাপ কেন? ভিকি কি ফিরে গেল?
সুমনা হাসে, ‘হ্যাঁ। আবার আসবে, ডিসেম্বরে ওর বিয়ে। মেয়ে পছন্দ হয়েছে।
-তাই মন খারাপ? আরে এটা তো তুমি অ্যাকসেপ্ট করেই নিয়েছিলে। তবে তোমাদের মধ্যে যে বন্ধুত্ব, ওটা তো কোনদিন হারাবে না। এক কাজ কর, আমার বাড়ি ফাঁকা, কদিন কাটিয়ে যাও। ভাল সময় কাটবে।
-সো সরি, গৌরী। আমি আজই রাতের ট্রেন ধরছি, দার্জিলিং মেল। তোমাকে শুধু খবরটা জানিয়ে গেলাম।
দার্জিলিং মানে! গৌরী চমকে ওঠে। মেয়েটা কি জীবনটাকে নিয়ে ছেলেখেলা করছে! পদ্মা নিশ্চয়ই আবার কোনও ছলে বলে ওকে উসকে চলেছে। অসম্ভব, সুমনাকে এখন কলকাতা ছাড়তে দেওয়া যাবে না।
কিন্তু সে কিছু বলার আগে, সুমনা বলতে শুরু করে, ‘সরি, আমাকে আটকানোর চেষ্টা কর না গৌরী। যেতে আমাকে হবেই। অন্তত কয়েকটা দিন এই শহরটা থেকে পালাতে হবে। ভিকির সঙ্গে এ কদিনে এত স্মৃতি জমা হয়েছে!  নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। বড্ড পাগল পাগল লাগে। বিলিভ মি। এরকম কখনও হয় না। ভিকি আসে, যায়। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে আর কখনও ভিকির সঙ্গে দেখা হবে না’।
গৌরী গম্ভীর, ‘হেঁয়ালি রাখো। তুমি সিরিয়াস? যাবেই?  কোথায় উঠছ?’
-হিল কার্ট রোড। হোটেল বুকিং হয়ে গেছে। -সুমনা হাসল। -একটা কথা বলব? রাগ করবে জানি, তবু বলি। -পদ্মা আমায় ফোন করেছিল। কান্নাকাটি করছিল। বাবাজীর লোকেরা ওকে ধরে ফেলেছে। তারপর অকথ্য অত্যাচার চলেছে, মারধর, ভয় দেখানো। কিন্তু আশ্রমের ছোট মামনির নাকি এই নির্যাতন দেখে করুণা হয়েছে। সে ওকে ছেড়ে দিতে চায়।
গৌরী ধমকে ওঠে, ‘আবার গল্প! আচ্ছা সুমনা, তুমি ওদের ছকটা ধরতে পারছ না?’
সুমনা হাসল, ‘শোন, আমি যেটা শুনেছি, তোমায় বলে যাই। বাবাজীর জন্মদিন নাকি এবারও ধূমধাম করে হচ্ছে। অসংখ্যা ভক্ত সমাগম, নিমন্ত্রিত থাকবে কয়েক হাজার।  বাবাজী আসবে এক নিমন্ত্রিতর সাজে। সুটেড বুটেড সাহেব। আড়ালে আবডালে অপেক্ষা করবে তার বাহিনী। যদি দেখা যায়, ওখানে পুলিশ ঢুকে পড়েছে এবং বাবাজী গ্রেফতার হতে চলেছে, তাহলে একটা এস এম এস ছড়িয়ে দেওয়া হবে সব বাহিনীর কাছে।‘টম্যাটো ফোড়ো’। অর্থাৎ ভেঙে চুরে সব মাঠ করে দাও। এই ডামাডোলের মধ্যেই ছোট মামনি পদ্মাকে আশ্রম থেকে বার করে দেবে।
গৌরী হতবাক। এ তো রীতিমত থ্রিলার। হাততালি দিয়ে বলে ওঠে,  ‘সাবাস! দারুণ! আ ভেরি গুড স্টোরি। সুমনা, আই অ্যাম ভেরি সরি টু সে, তুমি আমাকে হতাশ করলে। এত ঝকঝকে একজন সাংবাদিক হয়েও শেষ কালে তুমি ওদের চালটা ধরতে পারছ না!’
  সুমনা ফোন কেটে দিল। গৌরী বুঝল ওকে রোখানো যাবে না। ও দার্জিলিং যাবেই।

ক্রমশ…

Spread the love

You may also like...

error: Content is protected !!