মা টাকা পয়সা যা দেবে দাও মা,সঙ্গে একটু ভাত দিও…।এমন কাতর আবেদন নিশ্চয়ই অনেক মানুষই একটা সময় শুনেছেন।আমি আশির দশকের কথা বলছি।তখনো ফ্ল্যাট কালচার পাড়াগুলোকে গ্রাস করে নেয় নি।গেটের সামনে পেয়াদা মজুদ করা শুরু হয়নি।সকাল থেকেই বাড়ির সদর দরজায় তালা লাগানো,নাম ঠিকানা লিখে গেটের ভিতর প্রবেশের দরকার হয়ে পড়েনি।ভোরে কাগজ,দুধ কিংবা ঘর মুছতে আসা মেয়েটির জন্য সেই যে খোলা হত,নেহাত দরকার না পড়লে তা খোলাই থাকত রাত অবধি। ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল,আমার মতো দুষ্টু পাড়াচড়ানি মেয়েকে বাড়িতে বিশেষ করে ছুটির দিনের দুপুরে আটকে রাখার জন্য দরজা বন্ধ হত। কিন্তু সে মাঝেমধ্যে, কালে ভদ্রে।কারন,মায়েরাও জানত এরা আর যাই হোক পাড়া ছেড়ে অন্য পাড়ায় যাবে না।লক্ষ্মণের গন্ডী কাটার মত বলে রাখা হত যে,বেপাড়ায় গেলেই ঝোলায় করে চুরি করে নিয়ে চলে যাবে ছেলে ধরা।আর কখনো বাড়ি ফিরতে পারব না। ছেলে ধরা একবার যদি জানতে পারে এই মেয়েটা রোজই বাড়ির বাইরে একা একা দুষ্টুমি করে তবে তো কথাই নেই। আমার চুরি হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। এই ছেলেধরা লজেন্স, আইসক্রিম বা অন্য যা কিছু খাবারের লোভ দেখিয়ে চুরি করতে পারে,নাকের সামনে গন্ধ মাখা রুমাল চেপে ধরতে পারে,আর নইলে পিছন থেকে ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে তুলে নিয়ে যেতে পারে।আর একবার তুলে নিয়ে গেলে হাত পা ভেঙে ভিক্ষা করাতে পারে,নিষিদ্ধ পল্লিতে বেছে দিতে পারে,জিভ কেটে বোবা বানিয়ে দিতে পারে আর সবচেয়ে ভয়ের যেটা সেটা হল আমার চোখ, কিডনি,সব খুবলে নিতে পারে।ও হ্যাঁ, আরেকটা ভয়ংকর ঘটনাও ঘটতে পারে।আমার শরীরের সব রক্ত ড্রাকুলার মত চুষে নিতে পারে।তা এত কিছু যখন হতে পারে তখন সাবধানে থাকাই ভালো,বলে বড়রা ভয় দেখানোয় দাঁড়ি টানত।
তবে আমাকে এসব ভয় বিশেষ কাবু করতে পারত না।কারন,আমি কোনোভাবেই বাড়িতে বসে সময় নষ্ট করার মেয়ে নই।আর বড়জোর এসব হলে আর বাড়ি ফিরতে পারব না।কিন্তু বাড়ির বাইরে যে আস্ত পৃথিবী পড়ে আছে সেখানে আমার অবাধ বিচরণ তো আর ছেলেধরারা বন্ধ করতে পারবে না।তাই আমার মা এসব ভয় না দেখিয়ে আমার হাতে তুলে দিত নানান বই।ছোটোদের বই,বড়দের বই…কোনোটাই বাদ যেত না। আমি সব ভুলে সেই এক আশ্চর্য পৃথিবীতে হারিয়ে যেতাম।আর মা আমাকে পাশে বসিয়ে উল কিংবা সেলাই করত।
কিন্তু এতো ছেলেধরা বা আমার গল্প নয়।সেই যে ভোরবেলা থেকে ভিক্ষা চাইতে আসত সাদা শাড়ি পরা দিদা কিংবা কোলে বাচ্চা নিয়ে মা তাদের গল্প।আমাদের বাড়ির সদর দরজায় প্রথম কড়া নাড়ত খবরের কাগজ দেওয়া কাকু,তারপর দুধ দেওয়ার কাকু,আর তারপরেই সেই দিদা।এসেই বলত,বৌমা একটু চা করোতো।তার কাঁধে থাকত একটা বিচ্ছিরি রকম নোংরা ঝোলা,নগ্ন হাত পা,চটি পড়ত না।পরনে সাদা শাড়ি সরু পাড়।মা তাকে পিঁড়িতে বসতে দিয়ে চা বসাত।তখনো আমাদের বাড়িতে গ্যাস আসেনি।সবে উনুন জ্বালানো হয়েছে।তার ধোঁয়ায় আমদের ঘুম ভাঙছে।অবশ্য সে সময় মাটির উনুনের কদরই বেশি ছিল,কজনের বাড়িতে গ্যাস ছিল হাতে গুনে বলা যেত।
তিনি এলে মা চা বসিয়ে প্রথমেই তার হাতে গোটা পাঁচেক বিস্কুট ধরিয়ে দিত।তিনি নিজের ঝোলা থেকে একটা রংচটা সাদা নিকেল দেওয়া এ্যালুমিনিয়ামের গ্লাস বের করে মার হাতে দিতেন।ওটাতেই তিনি চা খেতেন।আজ ভাবলে অবাক লাগে মা কী অবলীলায় সেই গ্লাস মেজে চা দিত।আমাদের সেই একফালতি ঘরে যেখানে দাঁড়াবার জায়গাই ভালো ভাবে ছিল না,সেখানে মা রান্না ঘরে আর তিনি রান্নাঘরের সামনে পিঁড়িতে বসে গল্প করত।তিনি মাকে জিজ্ঞেস করতেন,বৌমা আজ কী রান্না হবে?ছেলের জন্য বড় মাছটা রেঁধো,ছেলে মানে আমার বাবা।আর বাকিদের জন্য ছোটো হলেও ক্ষতি নেই। কারন বড় ছেলেকে সুস্থ রাখা জরুরী।তিনি কিভাবে জেনেছিলেন জানি না,আমার মার তিন দেওর,বাবার দুই বন্ধু আর এক ভক্ত আমাদের বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা। বন্ধু বা ভক্তরা মাসে কদিনের জন্য বাড়ি গেলেও দেওররা তো থাকবেই। আর সবার খরচ বাবাকেই চালাতে হবে।আমার অবাক লাগত সেই দিদা মাকে এই পরামর্শ দিলেও মা সবাইকে বড় বড় পিস গুলো দিয়ে নিজের ও বাবার পিসটা ছোটো রাখত।সেটাই আমাদের বাড়ির চল ছিল।যাহোক, সেই দিদা চা খেতে খেতে চালের দর,মাছের কিলো,ডালের আকাল কত কিছু বলে যেতেন।মা কিছু শুনত কি?কে জানে!আমি বিছানা থেকে দেখতাম,মা শুধু খুন্তি নেড়ে চলেছে,কিংবা সবজি কাটছে।বাড়ির সবাই নটা থেকে দশটার মধ্যেই বেরবে।তারপর আমরাও রেডি হয়ে মায়ের সঙ্গে স্কুল চলে যাব।এই সময় মা যেন দশভুজা।
যাহোক, চা পর্ব শেষ করে দিদা উঠত শাড়ির আঁচলে মুড়ি বেঁধে। আর বলে যেত বৌমা চালটা আরেকটু ফুটিও।বুড়ো হয়েছি,চেবাতে পারি না।সাড়ে চারটের সময় যখন আমরা বাড়ি ফিরতাম সেই দিদাকে দেখতাম পাড়ার কারোর বাড়ির দালানে শুয়ে।আমাদের দেখেই উঠে পড়ত।পিছন পিছন আসত।তারপর একসঙ্গে খেতে বসা।যদিও কোনো কোনো দিন বলত,বৌমা আজ এই প্ল্যাস্টিকে খাবার টা বেঁধে দাও।দুপুরে অমুক বাড়িতে ভাত বেড়েছিল।খেয়ে নিলাম।
আমার ক্লান্ত মা কোনো কথা না বলে টিফিন কৌটে সব গুছিয়ে দিয়ে বলত,কাল মনে করে কৌটোটা নিয়ে এসো।
দিদার মতো কত মহিলাই আসত মায়ের কাছে।কারো চালের দাবি,কারোর আলু,সবজি,কারোর শাড়ি।এসবের সঙ্গে খুচরো পয়সা তো থাকতই।অনেক বড় অবধি জানতামই না এরা আসলে আমাদের কেউ না।ভিক্ষা করে এদের জীবন চলে।আর আমার মা- অন্নপূর্ণা মা হয়ে এদের দেখভাল করত যত্ন করে।
আসতে আসতে পাড়া ভেঙে গেল।একটা বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট হল।একান্নবর্তী পরিবার ছোটো হতে হতে তিনজনে এসে নামল।হারিয়ে গেল সেই ভিক্ষা করতে আসা দিদা মাসি মামিদের দল।এখন আর মা একমুঠো ভাত দাও -এই কন্ঠ স্বর গুলো বাড়ির দরজায় শুনতে পাই না।শুধু গাড়ি করে যাবার সময়,স্টেশনের গায়ে দেখি কতগুলো বাচ্চা হাত বাড়িয়ে দেয়, পেটে হাত দেখিয়ে বলে খিদে পেয়েছে। আমি আমার মা হতে পারি না।শুধু সামর্থ্যের মধ্যে যতটুকু পারি খাওয়াবার চেষ্টা করি কিংবা গাড়ির কাচ নামিয়ে একটা নোট হাতে ধরাই।মনে মনে বলি, মাগো তোমার এই বৃহৎ সংসারে আমাদের সন্তানরা যেন থাকে ভাত ডালে।