• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব – ১১)

কু ঝিক ঝিক দিন

১.

আমি দাঙ্গার কথা প্রথম শুনি পাশের ঘরের দিদার থেকে।তিনি প্রায়ই গল্প শোনাতেন,বাংলাদেশের দাঙ্গার সময় কিভাবে প্রাণ বাঁচিয়ে তারা কলকাতা চলে এসেছিলেন।এই দাঙ্গা জিনিসটা কি সেটা আমার ছ-সাত বছর বয়সে বোঝা সম্ভব ছিল না।এমনকি হিন্দু মুসলিম এই শব্দ গুলোর সঙ্গেও আমি পরিচিত ছিলাম না। দাঙ্গার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় ১৯৮৪ সালে।
বড়দের মুখে শুনেছিলাম ,ভারত থেকে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র খালিস্তান রাষ্ট্র গঠনের অভিপ্রায়ে সংঘটিত হয়েছিল শিখ বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে ৬ জুন অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে অভিযান চালায় ভারতীয় সেনাবাহিনী। এই অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে পবিত্র স্বর্ণমন্দিরের স্থাপনাগুলোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিসহ অগণিত সাধারণ শিখ জনতা নিহত হয়েছিল সেনাবাহিনীর হাতে।
এরই ফলে ১৯৮৪সালের ৩১অক্টোবর ইন্দিরা গান্ধী দুজন শিখ দেহরক্ষীর দ্বারা হত্যা হয়। সেদিন সন্ধা থেকেই দিল্লী ও ভারতের ৪০ টিরও বেশি শহরে শিখ বিরোধী দাঙ্গা আরম্ভ হয়।
সেদিনই প্রথম জানলাম এক জাতি আরেক জাতিকে হিংসার বশবর্তী হয়ে খুন করলে দাঙ্গা হয়।দাঙ্গা মানুষের মনুষ্যত্বকে নষ্ট করে দেয়।
ইন্দিরাকে শিখ সম্প্রদায়ের কেউ গুলি করে মেরেছিলেন।তার জন্য সারা ভারতে বৃহৎ অর্থে শিখ নিধন শুরু হয়েছিল।এ রাজ্যেও তখন তার ব্যতিক্রম হয়নি।বাড়ি থেকে ধরে ধরে শিখদের বের করে খুন করা হচ্ছিল। এমনকি যদি কোনো বাড়িওয়ালা হিন্দু পরিবার তার শিখ ভাড়াটেকে রাখছিল,তো তার বাড়িতেও ঢুকে হামলা চালাচ্ছিল কংগ্রেসের লোকজন।
বাবা সেই সময় খুব কষ্ট পেতেন।বারবার বলতেন, একজনের ভুলের মাসুল সমগ্র শিখ জাতিকে কেন দিতে হবে।তাছাড়া কোনো সুস্থ মানুষ এই নিধন মেনে নিতে পারছে না।শুধু একদল দাঙ্গাবাজ,রাজনৈতিক সুবিধা পাবার জন্য এসব করছে।
যদিও এটাও শুনছিলাম সারা ভারতে যে পরিমান শিখ নিধন চলছে তার এক শতাংশরও কম এখানে হয়েছে। কারন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ঘোষনা করেছিলেন,কোথাও জমায়েত বা গন্ডোগোল হলেই যেন পুলিশ কোনো দল না দেখে সরাসরি মাথায় গুলি চালায়।
আমাদের পাড়ায় কোনো শিখ ছিল না।কাজেই কি ঘটছে তা চাক্ষুষ দেখিনি।কিন্তু রোজ কাগজে এই খবরগুলো পড়ে মন খারাপ হয়ে যেত।ভাবতাম,মানুষ কি করে মানুষকে খুন করতে পারে!
এইসময় আমাদের নতুন বাড়ি বানাবার কাজ শুরু হয়েছিল।দায়িত্বে ছিল সিংহাসন নামে এক কনট্রাকটর। তার মাথায় শিখদের মত বিশাল পাগড়ি বাধা থাকত।কেউ বলত সে বিহারের,কেউ বলত সে শিখ।সে নিজে কখনো নিজের কি জাত তা নিয়ে কথা বলত না।বাংলার সঙ্গে হিন্দি মিশিয়ে সে কথা বলত।তার নাম এমন অদ্ভুত ছিল কেন তাও কখনো জানতে চাওয়া হয়নি।এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা আমাদের নিষিদ্ধ ছিল।
বাবা কখনোই পছন্দ করত না কারোর জাত,সোস্যাল স্টেটাস এসব নিয়ে কথা বলা।
তাই সিংহাসন নামের কারন কি নিয়ে মনের ভিতর জিজ্ঞাসা থাকলেও করে ওঠা হয়নি।
এহেন সিংহাসন শিখ নিধন পর্বে পুরো বেপাত্তা হয়ে গেল।তার বাড়ি গিয়েও তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না।আমাদের বাড়ির কাজ বন্ধ হয়ে গেল দীর্ঘদিনের জন্য। সবাই বলাবলি করছিল,তার মানে সিংহাসন আসলে শিখ।তাই সে কোনো গোপন জায়গায় লুকিয়ে আছে।
আমাদের খুব মন খারাপ।ধুতি ফতুয়া পরা সিংহাসনকে আর দেখা যাবে না!তাকেও কি মেরে ফেলেছে?
একদিন সোনাইকাকু(আমাদের পাড়ায় বামফ্রন্টের কর্মী,বাবাকে বড়দা বলতেন) বাবার ঘরের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে কান্না কান্না সুরে বলছিল,বড়দা যেভাবে রক্ত গঙ্গা বইছে তা আর চোখে দেখা যাচ্ছে না।
বাবা বলছিল,তোদের সরকার করছে কি?তারই তো এসব কড়া হাতে দমন করা উচিত।
এই সরকার মানে কে সেটা বুঝতে না পেরেই আমি বলে উঠেছিলাম,সরকার কাকুরা তো কিছু করেনি।তারা তো খুব ভালো।
তখন দুজন সরকার কাকুকে আমি চিনতাম।এক, আমাদের পাশের বাড়ির ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বড়কাকু, যার টাইটেল ছিল সরকার,আর দুই, দমদম নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী সরকার কাকু।যার থেকে কাপড়ের ছিট নিয়ে এসে মা আমাদের জামা,টেপফ্রক বানিয়ে দিত।এর মধ্যে প্রথম জনের আমি ছিলাম মন দিদি।সে আমাকে প্রাণের চেয়েও অধিক ভালোবাসত।আমিও ছিলাম বড় কাকু অন্ত প্রাণ।
বাবা বলেছিল, এটা সরকার টাইটেলের কথা বলা হচ্ছে না।এই সরকার মানে যে রাজ্য চালায়।
এ বিষয়ে আমার বিন্দু মাত্র উৎসাহ ছিল না।কারন তার কিছু দিন আগেই ১৯৮২ সালে বিজন সেতুতে আনন্দ মার্গী বেশ কিছু মহিলা কর্মীকে ও পুরুষকে এই সরকারের লোকেরাই নাকি খুন করেছিল প্রকাশ্যে। এবং তখনো বাবার মুখে আক্ষেপ শুনেছি। কাজেই এখন সরকার কিছু করবে না এটা আমি যেন নিশ্চিত ছিলাম।
কিন্তু নিশ্চিত ছিলাম না সিংহাসন খুন হলে আমাদের বাড়িটা কিভাবে শেষ হবে আর তার কিছু হলে তার বউ বাচ্চার কি হবে তা নিয়ে।
ধীরে ধীরে সব আক্রোশ, খুন,স্থিমিত হতে লাগল।ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে উঠল শহর কলকাতা।
এমনই একদিন সকালে স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছি,তখন সবাইকে অবাক করে হাজির হল সিংহাসন।কিন্তু তাকে চেনাই যাচ্ছিল না।কারন তার মাথার চুল পুরো ন্যাড়া,পাগড়ি নেই, দাঁড়ি নেই এমনকি বিশাল গোঁফটাও নেই।
সে বলল,নিজের ও পরিবারের প্রাণ বাঁচাতে এ ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না।কারন সবাই তাকে শিখ বলে সন্দেহ করছিল।দুবার মারতেও গেছিল।ভাগ্য জোরে বেঁচে গেছে।
কিন্তু তুমি তো শিখ!আমার প্রশ্নের উত্তরে সে বলল,কস্মিনকালেও নয়।আমি বিহারি। এই চুল দাঁড়ি গোঁফ সব মানত করা আছে।আজীবন কাটব না বলে।
তাহলে কাটলে কেন?
সে বলল,প্রাণটাই যদি না থাকে তবে মানত রেখে আর কী হবে!
আমার কাছে বিহারি,শিখ, হিন্দু এসব কোনো ফারাক ছিল না। সিংহাসন ফিরে এসেছে, এবার আমাদের বাড়িটা হবে- এটা ভেবেই মন আনন্দে মেতে উঠেছিল।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।