সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে পূর্বা দাস (পর্ব – ২)
অমরত্বের আগে
পর্ব – ২
পাবং এর সাথে সাথে থারোও নিঃশব্দে অন্ধকার বাগানের গাছপালা সরিয়ে বসবার ঘরের ঠিক নীচটিতে এসে দাঁড়াল। বৃদ্ধ মানুষটির গলা কানে আসতেই থারোর শরীর শক্ত হয়েছে। তিনি তখন নাতিকে তার কাছ থেকে সরিয়ে না নেবার জন্য অনুরোধ করছিলেন ছেলেকে। পাবং রাজী হল এঘরেই পিয়ানোটার সদ্ব্যবহার করতে। আধো অন্ধকার বাগানে থারো তার শুকনো, ফাটা ঠোঁট চেটে নিল জিভ দিয়ে। ধীরে ধীরে তার মাথা ঝাঁকুনি শুরু করল বন্য উল্লাসে। এলোমেলো শনের নুড়ি চুলগুলো ছড়িয়ে গেল মুখময়, কিন্তু মাথা নাড়ানোয় বিরাম নেই। ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা কে আড়াআড়ি রেখে সে তার অদৃশ্য প্রভুকে স্মরণ করে বিড়বিড় করে কিছু শব্দ উচ্চারণ করলো। এবার তার হাত এগিয়ে গেল ওই ঘরটির দিকে। যেন সে কিছু ছিনিয়ে আনছে ওখান থেকে। ভীষণ পরিশ্রমের চিহ্ন এখন থারোর সর্বাঙ্গে। শীতল হয়ে আসা সন্ধ্যের হাওয়াতেও তার সারা দেহে ঘাম। আবার সে তার অদৃশ্য প্রভুকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলল। যেন নিবেদন করলো যা সে আহরণ করেছে ওই ঘর থেকে। কি সেই জিনিস! কেউ দেখেনি কখনো। কেউ জানেনা। শুধু থারোর ফিরে যাওয়ার রাস্তার পেছনে সবুজ গেটওয়ালা বাড়িটি এখন যেন সুনামি বিধ্বস্ত কোন উপকূল শহর।
সপ্তাহ খানেক পরে এক রোদ্দুর ঝলমলে সকালে অ্যাবক থারো শুয়ে ছিল তার তেল চিটচিটে শক্ত বিছানায়। মনে হয় যেন কত জন্ম আগে এই বিছানাও একদিন মেঘের মতো হালকা ছিল। তার ঘরের ভেতর অন্ধকারের রাজপাট। এক সপ্তাহ আগেও থারোর সমস্ত শরীরের হাড় যেন গুড়ো হয়ে যাওয়ার ব্যাথায় বিষ হয়ে ছিল। কিন্তু এখন সে অনেক সুস্থ; অন্তত নিঃশ্বাস নিতে পারছে একটু ভালোভাবে। বাইরে একটা কলরব ঘন হচ্ছিল ধীরে ধীরে। থারো ব্যস্ত হলো না এতটুকু। শুধু নিশ্চল শুয়ে রইলো সেই পরিচিত ঘণ্টাধ্বনিটির অপেক্ষায়। এই বাড়িতে তার প্রপৌত্র পৌত্রীরা কেউই কথা বলে না তার সাথে। সবচেয়ে বড় নাতির ছেলে তামো ঠিক তার পাশের ঘরটিতেই থাকে। থারোর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা তার ঘরেই হয় কিন্তু সে যেন ভয়ে, ঘৃণায় ছুড়ে দেওয়া খাবার। থারো অবশ্য খুশিই হয় যখন তামোর শান্তশিষ্ট বৌটি বেশ ঝকঝকে থালায় গরম ভাত আর ধোঁয়া ওঠা মাছের কারি নিয়ে ঢোকে। বউটিও কোন কথা না বলে কোনমতে বিছানার পাশে রাখা বাঁশের গোলটেবিলে থালাটা নামিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে, আর যতক্ষণ না নিশ্চিত হয় তার খাওয়া শেষ হয়েছে ততক্ষণ একটিবারও এদিকে আসে না। এমনকি কিছু লাগবে কিনা – সেকথাও কোনদিন জিজ্ঞেস করেনি ও। থারোর প্রাতঃরাশ সারা হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। এখন শুধু অপেক্ষা সেই বিশেষ ঘণ্টাধ্বনিটির জন্য এবং একটি শবযাত্রার শোকচ্ছ্বাস। এবং তার নিজস্ব, একদম নিজের বিশেষ ক্ষমতার একাকী উদযাপন ।জনতার কোলাহল এগিয়ে এসেছে একদম তার ঘরের পাশে। শুয়ে শুয়ে মাংসের সুরুয়া খাওয়ার মত সে উপভোগ করল শব বাহকদের হাতে ঘন্টার আওয়াজ, মৃত মানুষটির পরিবারের লোকজনের বিলাপ। তাকে আরো নিশ্চিত করতে সেই হাস্যমুখর মেয়েটি একমা’র উচ্চগ্রামের কান্না ছড়িয়ে গেল চারদিকের পল্লীতে। সুস্থসবল শ্বশুরমশাইয়ের হঠাৎ মৃত্যু তাকে বিহ্বল করে দিয়েছে। মাঠে কাজ করতে গেলে ছোট বাচ্চাটিকে তিনিই দেখেশুনে রাখতেন যে।