• Uncategorized
  • 0

শিক্ষকদিবসে শুভাশিস হালদার

আমার শিক্ষক

সালটা উনিশ শ উনসত্তর, আমার তখন ক্লাস টেন। আমার স্কুল দক্ষিণ বারাশত শিবদাস আচার্য হাইস্কুল। ঐ স্কুলের হেডস‍্যার ছিলেন সুপ্রভাত ঘোষ। অসীম ব‍্যক্তিত‍্বপূর্ণ একজন মানুষ। তাঁর কঠিন ব‍্যক্তিত্ত্বের কাছে কোন অন‍্যায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। আমাদের পড়াশুনার কাল পর্যন্ত ঐ স্কুলে কোন বন্‌ধ বা হরতাল কোনদিন প্রভাব ফেলতে পারেনি। অথচ ঐ সময়কালে দঃচব্বিশ পরগনা রাজনৈতিক ভাবে বেশ অস্থির ছিল।
সত্তরের শুরু থেকে হেড স‍্যার আমাদের বাংলার ক্লাস নিতে শুরু করলেন। আমরা তখন ইলেভেন। স্কুলে সবথেকে উঁচু ক্লাসের ছাত্র। বাইরে মাও সে তুং এর প্রচার চলছে লুকিয়ে চুরিয়ে, স্কুলের ছাত্রদের , বিশেষত উঁচু ক্লাসের ছেলেদেরকে প্রচুর প্রলোভন দেখানো চলছে। আবার ঐ এক‌ই সময়ে জয়নগরে এস ইউ সি এর জন্ম ও উত্থান।জয়নগর বহড়ু বারাশত তখন নতুন রাজনৈতিক চিন্তাধারায় টগবগ করে ফুটছে। বিপ্লব যেন সবার হাতের মুঠোয়। প্রকাশ‍্যে এস ইউ সি, গোপনে নকশাল এর মাও সে তুঙ।
এসব‌ই হেড স‍্যারের নজরে ছিল। তাই হয়তো স্কুল পালানোর পথ আটকাতে নিজে শেষ পিরিয়ডে ক্লাস নেওয়া শুরু করলেন। দীর্ঘ ঋজুদেহ মানুষটি যখন স্কুলের বারান্দায় দাঁড়াতেন মুহূর্তে সমস্ত ক্লাসের হৈ চৈ বন্ধ হয়ে যেত।
একটা দিনের কথা বলবো সেই হেডস‍্যারকে নিয়ে। শেষ পিরিয়ডে স‍্যার ক্লাসে ঢুকলেন । সেদিন ছিল সোমবার। হাতে একটা বেতের ছড়ি, বেত মানে বেত‌ই, আর এটেন্ডেন্স রেজিস্টার। এগুলো স‍্যারকে কিন্তু কোনদিন‌ও ব‍্যবহার করতে দেখিনি। আসলে এটার কোন প্রয়োজন পড়তো না।
শুরু হলো পড়ানো। গান্ধারীর আবেদন। ক্লাস চলছে । অসম্ভ সাবলীল ভাবে পড়িয়ে যাচ্ছেন স‍্যার। আমরা সব ছাত্র মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছি, শুধু শুনছি। কারো মধ‍্যে কোন চঞ্চলতা নেই। শেষ ক্লাসের বিকেল গড়িয়ে সন্ধ‍্যে। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে অনেকক্ষন। কিন্তু আমাদর ছুটি হয়নি। আর হয়নি অন‍্যান‍্য শিক্ষকদের। হেড স‍্যারকে না বলে কেউ স্কুল ছাড়তে পারতো না। আমরা দেখতাম অন‍্যদিন ছুটির সময়ে হেডস‍্যার তাঁর বসারঘরের সামনে এসে দাঁড়াতেন। কোন কথা বলতেন না। শুধু দেখতেন ছেলেদের চলে যাওয়া, শিক্ষকদের চলে যাওয়া। নিজে যেতেন সবার শেষে।
সব স্কুলেই একজন করে সর্বজনীন দাদা বা দিদি থাকেন। আমাদের ছিল মুরারীদা। হেডস‍্যার থেকে শুরু করে ক্লাস ফাইভের ছাত্ররাও মুরারীদা বলতো। মুরারীদা কেবল সময়ে সময়ে ঘন্টা বাজাতো, স্কুল শুরু, পিরিয়ড শেষে, আর ছুটির ঘন্টা।
অবশেষে সাড়ে ছ’টার পর মুরারীদা এসে ঢুকলো ক্লাসে। এসেই চিৎকার ” ক‌ই কি ব‍্যাপারটা কি, পোলাগুলানের ঘর বাড়ি নাই, খিদাতিষা নাই, অগো বাপ-মা নাই, তারা অগো লগে চিন্তা করেন না? সন্ঝা গড়ায়া রাত হ‌ইল। মাষ্টারগুলান শুদ্ধা ব‌ইসা র‌ইছে। অগো ঘর যাওন লাগে কি লাগেনা?”
হেডস‍্যার একেবার চুপ। মুরারীদা থামলে স‍্যার বললেন “এঃ, এত দেরী হলো। যা যা তোরা বাড়ি যা, বাড়ি যা। ”
“–উঁহু, কেউ যাবানা, পোলাগুলানের খিদায় মুখ শুকায়া গ‍্যাসে, মাষ্টারগুলান শুদ্ধা র‌ইসে, অগো টিফিন খাওয়ান লাগে।”
–” উঃ, কি শাস্তিরে বাবা। যাও সবার জন‍্য মুড়ি আর বেগুনী নিয়ে এসো।”
এই ছিলেন আমাদের হেডস‍্যার। আর তাঁর পিছনের শিক্ষক আমাদের মুরারীদা। দুজনেই আমাদের প্রাণের মানুষ, আপন শিক্ষক।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।