• Uncategorized
  • 0

শিক্ষকদিবসে আলোক মন্ডল

কবিতা মগ্ন প্রাণ।অবসরপ্রাপ্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক । দশাধিক কাব্যগ্রন্থের স্রষ্টা।"কবিকর্ণিকা" -কবিতাপত্রের সম্পাদক। কবিতা

শিক্ষকদিবসের সেকাল-একাল ও আমি

টেন-ইলেভেন ক্লাসের দামাল ছেলেরা যারা কেরোসিনের দাবীতে ব্লক অফিস ঘেরাও করেছিল, স্কুলে এক নিষ্ঠুর পাষণ্ড সংস্কৃত পণ্ডিতের হাত থেকে বেত কেড়ে নিয়ে ছাত্র পেটানো বন্ধ করেছিল সেইছেলেরাই একদিন আমতলায় আমাদের ছুটির পর জড় হতে বলে, ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষকমশাই দের প্রথম পিরিয়ডে একপ্লেট মিষ্টি ও ফুল দিয়ে শিক্ষকদিবস পালনের নির্দেশ দিল।সেই মাফিক ১০/২০ পঃ চাঁদা ক্লাসে ক্লাসে সংগ্রহ হোল,উদযাপন হোল দিনটি।কোন বেলুন ফাটানো নয়,নয় আবির-পারফিউম ,নয় মিউজিক সিস্টেম।স্যার কিছু বলতেন,তার কিছুটা কানের ভেতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করত কিছুটা মাথার উপর দিয়ে উড়ে যেত আর তারপরই মাস্টারমশাই যথারীতি ক্লাসের পড়া পড়াতে শুরু করতেন।ক্লাস শেষকরে থলি থেকে টিফিনক্যারিয়ার বের করে তাতে মিষ্টিগুলি কুড়িয়ে নিয়ে রুম ছাড়তেন। তারপর ছুটির পর প্রধানশিক্ষককে লাইন দিয়ে প্রণাম, এই ছিল শিক্ষকদিবস উদযাপন।মাঝেমাঝে কোন-কোন বছর আমতলাতে এই উপলক্ষে সভা হোত। ছাত্রদের থেকে দু’একজন শিক্ষকমশাইয়ের পাখিপড়া শিখিয়ে দেওয়া বক্তব্য বলতো, হাতেলেখা কাগজটি হাতে নিয়ে, দুরুদুরু বুকে।কোন মাইক বা বক্স ছিল না। যে ছেলেটি ঐ সভায় বলতে পেতো তাকে সমস্ত স্কুলের ছেলেরা সারামাস অন্তত পুজোরছুটি পড়া পর্যন্ত সমীহের চোখে দেখতো।এখানে বলে রাখি আমি ছাত্রজীবনে ৪টি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়েছি কিন্তু একজনও আমার মনে তেমনভাবে দাগ ফোলেন নি শুধু পিঠে খেজুরছড়ির দাগ ফেলেছিলেন একজন সংস্কৃত ভাষার নিষ্ঠুর মাস্টারমশাই।আমি রুখে দাঁড়িয়ে তাঁর হাত থেকে একবার বেত কেড়ে নিয়েছিলাম তাই হেডমাস্টারমশাই তাঁর রুমে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমাকে বেধড়ক পিটিয়ে ছিলেন। প্রতি শিক্ষকদিবসে আমার এই ঘটনাটা মনে পড়ে।
এতো গেল হাইস্কুলের শিক্ষকদিবস।প্রাইমারিতে দেখতাম শিক্ষকদিবসে আলপিনে আঁটা ছোট্ট একটি পতাকা হেডপণ্ডিত হাতে তুলে দিতেন তাও সবাই কে নয়, শ্রেণিতে যে মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের তার হাতে। আগের দিনই বলে দিতেন বাবা/মার কাছ থেকে ১০পঃ আনতে।আমার জীবনে প্রাইমারিতে তিনটি স্কুলে পড়ার স্মৃতি আছে, এই দিনটিতে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকমশাই আমাদের,যারা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তাম, তাদের লাইন দিয়ে তাঁর বাড়িতে দু’দিকে দু’টি লম্বা বাঁশে এরিয়াল-তার ঝুলানো ইয়াবড় রেডিও দেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন আর শুনিয়েছিলেন দিল্লী থেকে রিলে করা ইভা নাথের সংবাদ পড়া। আর সেই জন্য ঐ শিক্ষককে আমি ভাবতাম, উনি মা/ বাবার পরেই আর একজন সেরা মানুষ,যিনি আমাকে পৃথিবীর আশ্চর্যতম জিনিসটি দেখিয়েছেন! তখন ভারত-পাকিস্থানের যুদ্ধ চলছে।
এখন দেখি শিক্ষকদিবস যাথারীতি আড়ম্বরপূর্ণ এক মহোৎসব, শেণিকক্ষ সাজানো ডিজিটাল আলো ও মিউজিক সিস্টেমে,শিক্ষকমশাই ক্লাসে ঢুকলেই মাথার উপর ফুল ঝরে পড়ে,বেলুন ফাটতে শুরু করে ফটাফট,বোতল থেকে পারফিউ স্প্রে অঝোর ধারায় ঝরে,যেন বিয়ের বর বরণ! তারপর টেবিল ভর্তি উপচে পড়া দামিদামি গিফ্ট। সেখানে ঘড়ি,মোবাইল,দামিপার্স, ব্যাগ,ব্রান্ডেড কোম্পানির শার্ট-প্যান্ট কী থাকে না! থাকে ঢাউস একটা মিষ্টির প্যাকেট। তারপর নাচ গান দু’একটি কবিতাপাঠ তবে বেশির ভাগ সময় জুড়ে চিপসে বাজানো গানের সুরে নাচ, অনেক সময় তা নান্দনিকতার সীমা ছাড়িয়ে যায়।যে মাস্টারমশাই যত দামী(অর্থমূল্যে) গীফ্ট পান তার বাজারদর ততবেশী।আর এসব আয়োজন চলে একমাস ধরে,মোটা অঙ্কের চাঁদা সংগ্রহ ও তা বাধ্যতামূলক। এরপর আছে প্রাইভেট শিক্ষকদের কারখানায় শিক্ষকদিবস। সেখানে ১০০ গুন বেশি আড়ম্বর ও আয়োজন,বিনিময়ে পরের যে-কোন একরাতে মাস্টারমশাই এর চিকেন বিরিয়ানি সহযোগে গ্রাণ্ডফিস্ট,পড়ুয়াদের জন্য। আবার কেউকেউ কোন পাহাড় কিংবা ড্যামে নিয়ে যান ছাত্রছাত্রীর অবাধ বিচরণের জন্য। কারণ শিক্ষকমশাই তো এখন টিচার নন,ব্যক্তিগত বানিজ্য বিস্তারের কারিগর, ছাত্রবন্ধু সুতরাং ছাত্ররূপ ক্রেতাদের মনোরঞ্জন তো করতেই হয় নইলে খদ্দের আসবে কী ভাবে!
এখন ছাত্রশিক্ষক সম্পর্ক তো শুধু গিভ আন্ড টেক পলিসিতে আচ্ছন্ন, এখানে শ্রদ্ধা নম্রতা এসবের জায়গা নেই আছে বানিজ্য তাই শিক্ষকদিবসে এতো আড়ম্বর,এতো সাজগোজ! আমাদের শিক্ষাকালে শিক্ষক দিবসের তাৎপর্য বোধগম্য ছিলনা ঠিকই তবে ছিল শিক্ষকদের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ছিল শিক্ষকদের পাঠদান শোনার অসীম আগ্রহ।তাই অনুষ্ঠান বা তার আড়ম্বরের কথা ভাবাই যেত না।
আর মহাবিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনও এই দিনটি শিক্ষকরা বা ছাত্ররা এরকম আড়ম্বরে পালন করতো না। তবে কখনও কখনও এই দিনটিতে ছাত্র-শিক্ষক সৌজন্যতামূলক ক্রিকেটে ম্যাচ হোত।তবে মহাবিদ্যালয়ের জীবনে মনে আছে, একজন অধ্যাপকের কথা যিনি আমার সবচেয়েপ্রিয় ও শ্রদ্ধেয় তিনি শুধু ক্লাসের শুরুতে মনে করিয়ে দিতেন এই দিনটির কথা আর ক্লাস শেষ করে বলতেন,” আজকের দিনটিকে মনে রেখে তোমাদের একটি টিউটোরিয়াল ক্লাস নেব নাটক বিষয়ে, সেকেন্ড ফ্লোরে ৪ নম্বর রুমে,সবাই এসো!” -তিনি আমার শিক্ষাগুরু ডঃরবীন্দ্রনাথ সামন্ত,আজ শিক্ষকদিবসে জানাই তাঁকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।