লক্ষ্মীপূজোই সম্ভবত একমাত্র পূজো যেখানে মূর্তি বিসর্জন নিষিদ্ধ ।কারণ শ্রী ও সম্পদকে জীবন থেকে বিসর্জন দিতে চায় কে?তাই প্রতি বৃহস্পতিবার, সন্ধ্যাবেলায়পাঁচজন অথবা তিনজন “এয়োস্ত্রী” মিলে এই পূজো করবার নিয়ম।তাহলে ধরে নিতে হবে কুমারী বা বিধবার লক্ষ্মী পূজাতে সামিল হবার অধিকার নেই।পাঁচালিকার সেখানে একটু নরম হয়ে বলেছেন যে এয়োস্ত্রীর অভাবেও পূজা করা চলবে। তবে পূজাবিধি খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে তেল,আলতা,সিঁদুরে র অনুষঙ্গে লক্ষ্মীপূজা সধবা নারীর এক্তিয়ার ।অন্যে সেখানে প্রবেশাধিকার পেতে পারে,তবে ,সীমাবদ্ধতাসহকারে।প্রথমেই এই বৈষম্যের সীমারেখা টেনে দেওয়া হচ্ছে বটে তবে আবার সেটা ভেঙেও দেওয়া হচ্ছে।
পূজাবিধি কিন্তু এ পূজাতে ঘণ্টা ধ্বনিও নিষিদ্ধ করছে। লক্ষ্মীপুজোই সেই পুজো যেখানে মেয়ে পুজো করার অধিকার পাচ্ছেন এবং এই যে প্রতি বৃহস্পতিবারএকত্রিত হওয়া, এটা প্রায় একধরনের গেট টুগেদার, যেখানে সংসারের কাছের ফাঁকে মহিলারা একত্রিত হয়ে গল্পগাছা করছেন,গল্প শুনছেন পাঁচালির মধ্যে দিয়ে এবং “স্বামী পুত্র কন্যা নিয়ে সুখে থাকার” প্রার্থনা করছেন।এই কৌম প্রথা মেয়েদের একত্র হবার একটা সুযোগ দিচ্ছে । সুযোগ দিচ্ছে সংসারের নানা কাজের মধ্যে কিছু সময় বার করে নিয়ে মন অন্যদিকে টানার।
সেকালে মেয়েরা আর কতই বা ইচ্ছা মত এদিক ওদিক যেতে পারতেন?হয়তো পাড়ার এবাড়ি ওবাড়িতে একটু “ওলো সই” ক’রে মনের কথা প্রাণের ব্যথা বিনিময় করতে যেতেন।পাঁচালি কিন্তু এই পাড়াবেড়ানো কে ভালো চোখে দেখছে না,কারণ সেখানে হয়তো পতিনিন্দা ইত্যাদি চর্চা চলে।কাজেই মেয়ের ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়ানো বন্ধ করে তাকে লোকায়তে বেঁধে ফেলাই ভালো।পাঁচজন একসঙ্গে বসো,ব্রত করে স্বামী সংসারের মঙ্গল কামনা করো।হিসেবমতো দেখতে গেলে মেয়েদের একত্র হবার জায়গা ছিল হেঁশেল,যেখানে কাজের চাপে কথা বলার ফুরসত নেই।স্নানের ঘাট যেখানে স্নান,কাপড়কাচা ও বাসনমাজারপর্ব।সেখানে কিছু পারিবারিক কূটকাচালি আলোচিত হবার সুযোগ ছিল বটে ।তাই বৃহস্পতিবার মেয়েদের একত্রিত করে “সুশীলা “নারী তৈরি করার একটা পরিকল্পিত ছক পাঁচালির মধ্যে পাওয়া যায়।যে ছক মেনে তৈরি হয়েছে লক্ষ্মীমন্ত নারীর মিথ।এই নারী সংসারের জন্য প্রাণপাত করে,স্বামী আজ্ঞা তার শিরোধার্য, কষ্টসহিষ্ণু, ধৈর্যশীলা,,বাধ্য ও অনুগত ।এর অন্যথাতে গৃহ হয়ে যাবে “পাপের আগার।”প্রতি বৃহস্পতিবারের ব্রতকথা এরকম একটা “সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে” ধাঁচের বিধান দিয়ে রাখছে।
২
এ ত গেল আদিকাল থেকে প্রবাহিত, দীর্ঘকালীন প্রথা পরম্পরার কথা। গ্রামীণ ও কৃষিভিত্তিক জীবনের কথা। এই একবিংশ শতকে এসে আমরা কী দেখছি, শহরে, গ্রামে মফস্বলে, আধুনিকা থেকে প্রাচীনা,
হিন্দু বাঙালির ঘরে ঘরে মহিলারা আজো লক্ষ্মীপুজো করে চলেছেন। প্রতি বেস্পতিবার নিত্যনৈমিত্তিক পুজো করছেন। তাছাড়া কোজাগরী পূর্ণিমার লক্ষ্মীপুজো , বছরে একটিবার । তাছাড়া দীপাবলী অমাবস্যাতেও অনেকেই লক্ষ্মীপুজো করেন।
লক্ষ্মী নাকি ধনদাত্রী দেবী, কিন্তু বাঙালির চির দুর্ভিক্ষপ্রপীড়িত যৌথ মননে, কালেকটিভ আনকনশাসের অন্তরে, ধনদাত্রীকে আমরা অন্নদাত্রী বলেই দেখতে শিখেছি। আর তাই, শরতের নতুন ফসলের সঙ্গে লক্ষ্মীপুজোর পুজোর ভোগ বা নৈবেদ্যর একটা নিবিড় সম্পর্ক লক্ষ্য করেছি।
কেন কেউ জানিনা আমরা, ইতিহাস হারিয়েছি, কিন্তু এই ঘরোয়া লক্ষ্মীপুজো ধর্মপালনের থেকে ও সাংস্কৃতিক আচার আচরণই যেন বেশি হয়ে উঠেছে । পুরুষমানুষেরা কমিউনিস্ট হোন অথবা লিবারাল, বাড়িতে মা বৌদি বা গিন্নি যেন এই লক্ষ্মীপুজো করবেনই। আর অধিকাংশ পুজোর মূল আকর্ষণ থাকে ছোট্ট মাটির মূর্তি, ফুলের মালা, আর চারিদিক থেকে জুটিয়ে আনা একরাশ সুখাদ্য, যার মধ্যে মূলত নারকেল নাড়ু, মোয়া নিমকি গজা , চিনির মঠ ও চিনির বাতাসা, নকুলদানা, কদমা, খেজুর আখ পানিফল শশা আপেল বাতাবি লেবু ইত্যাদি ফল, মাখা নারকেল কোরানো ও মুগ ডাল ভেজানো, আতপ চাল ভেজানো, কলার অপরূপ এক নৈবিদ্যি , খিচুড়ি ও ভাজাভুজি, লুচি ও মোহনভোগ প্রায় অনিবার্যভাবে উপস্থিত। অনেক বাড়িতে পুরোহিত আসেন, অনে ক বাড়িতে বাড়ির মহিলারাই পূজা করেন বই দেখে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সারাদিন উপোশ করে সামগ্রী জড়ো করা হয়। পুজো হয় বিকেলের দিকে সূর্য পড়ে এলে। কেননা পূর্ণিমার সঙ্গে অখন্ড যোগ আছে এ পুজোর। যেমন আছে শ্বেত প্যাঁচাটির সঙ্গে।
বাঙালির নানা ঘরে নানা মাপের, কম বেশি জাঁকজমকের পুজোয় অন্নদাত্রীই হোন আর ধনদাত্রীই হোন, মা লক্ষ্মীর নানা রকমভাবে পুজো হলেও, একটি আশ্চর্য বিষয় হল, প্রতি পুজোতেই লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ হয়ে থাকে। আশ্চর্য, কারণ দুর্গার পাঁচালি নেই। সরস্বতীর পাঁচালি নেই। আছে লক্ষ্মীর শুধু। আশ্চর্য কারণ ‘ লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়া’ নামক ঐতিহ্যবাহী ও কৌম বস্তুটি বাঙ্গালার সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অন্য অনেক আচরণের মত উবে যায়নি… অন্য সব পুজো আচ্চা আচার আচরণ, নানা ধরনের তিথি ও ব্রত পালন, এটা ওটা লোক উৎসব ও পার্বণের বিলোপ ঘটেছে, নানা ধরণের মন্ত্র-ছড়া-পাঁচালি পড়া আর হয়না অন্তত শহুরে মেয়েদের মধ্যে এমন কোন অভ্যাস নেই দেখা যায়। কিন্তু লক্ষ্মীপুজোয় লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়া এখনো কনস্ট্যান্ট। কী শহরে কী গ্রামে।
কে লেখেন বা লিখেছিলেন এই পাঁচালি ? কীভাবে কিনি আমরা পাঁচালি? কেন পড়ি আমরা পাঁচালি? কবে থেকে শুরু হল হাতে লেখা পুঁথির বদলে এই ছাপা পাঁচালি কেনা ও পড়া?
কোন প্রশ্নেরই সদুত্তর নেই আমার কাছে। বহু লোক শিল্প বা লোক ব্যবহারের মতই এ নিয়ে গবেষণার চিহ্ন খুঁজতে বসলে খড়ের গাদায় সূচ খোঁজা হবে।সচরাচর দশ কর্ম ভাণ্ডারে নানা পূজা সামগ্রীর সঙ্গে সঙ্গে আসে পাঁচালিটি। একটি পাতলা ফিরফিরে কাগজে , সাদা বা ঘিয়ে রঙের ওপর লাল অক্ষরে ছাপা পাঁচালি, সচরাচর সেইসব প্রেসে বা প্রকাশকের ঘরে ছাপা হয় যাকে কথ্যবাংলায় বটতলা বলি।
একশো বছর ধরে বদলে গেছে বাঙালি মেয়ের মুখের ভাষা বদলে গেছে ব্রত পালন আর পুজো করার রীত। পাল্টায়নি শুধু লক্ষ্মীর পাঁচালির মূল সুর। যে সুর এখনো ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ। কী কী করলে লক্ষ্মী কুপিতা হন আর কী কী করতে থাকলে লক্ষ্মীকে ঘরে ধরে রাখা যাবে সেই তালিকায় কোন পরিবর্তন চোখেই পড়েনা। মোটের ওপর, বলাই যায় লক্ষ্মীর পাঁচালি এত বছর ধরে সমাজের অগ্রগতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়নি, আজকের ভাষায় আপডেট করেনি, তার কোন উন্নয়ন হয়নি, অভিযোজন হয়নি।
এবং প্রায় পুরো ক্ষেত্রেই পাঁচালিটিতে যতকিছু অনাচার বা অসুবিধা সবকিছুর দায়ভার মেয়েদের ওপরে। মেয়েরাই সংসারকে ধরে রাখবেন আর তাই সংসার রসাতলে যেতে বসলে মেয়েরাই ভুলচুকের শাস্তি মাথা পেতে নেবেন। দেশে দুর্ভিক্ষ হলেও কোন না কোনভাবে মেয়েরাই দায়ী! নারী কেন্দ্রিক এই বয়ান সোজা কথায় রীতিমত নারীস্বাধীনতাবিরোধী। আর তাই আপত্তি।
আমার মত অনেক মেয়ের স্মৃতিতেই , ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার পর্বে, দিদিমা বা জ্যেঠিমা বা মায়ের পড়া পাঁচালির এই সব অংশে এসে ঠোক্কর খাওয়া যেন অনিবার্য ছিল। আমরা এসব শুনতাম ও হাসতাম , পুজো আচ্চাকে বর্জন করার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীর পাঁচালিকেও বর্জন করতাম। মানসিকভাবে অন্তত। আমাদের কাছে একটা হাস্যকর রিগ্রেসিভ বিষয় থেকে গেছে লক্ষ্মীর পাঁচালি।
কিন্তু আজও , ২০১৯ তেও ঘরে ঘরে আমাদের ই মত বয়সিনীরাই , পারিবারিক প্রথাকে মান্যতা দিয়ে, যত টা না ধর্মীয় কারণে তারও চেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক চিহ্ন হিসেবে লক্ষ্মীপুজো করছি । এবং সঙ্গে পাঁচালিটাকেও ফেলতে পারছি না। এই জায়গা থেকেই উঠছে একটা দাবি অথবা প্রশ্ন।
পাঁচালির নবীকরণ করা যায়না? আনা যায় না একটা নিউ অ্যান্ড ইমপ্রুভড পাঁচালি? এই চিন্তা আমাদের মধ্যে কিছু বছর ধরে চারিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে উপেক্ষা বা অবহেলা করা হলে ভুল হবে এই পাঠ্যবস্তুকে। ভুল হচ্ছে লক্ষ্মীর পাঁচালিকে ছোট করে দেখে। কেননা কথাগুলি নয় নয় করেও আমাদের কৌম স্মৃতিতে বা অবচেতনে থেকেই যাচ্ছে। তথাকথিত এগিয়ে যাওয়া মেয়েরা বছরের এক দিনে এই বই পড়ছেন দায়সারাভাবে।
এইসব ভাবনা থেকেই এই নতুন পাঁচালির উদ্ভব। পাঠক পাঠিকারা কে কীভাবে নেবেন , সেটা তাঁদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হল।