বাজী
আজ আমার হাল খুবই খারাপ। তাতে আমার নিজের দোষ নেই মোট্টেই! হয়েছে কি খুলেই বলি।
টীমটা আমাদের বেশ জমজমাট। আর বছরে বেশ কয়েকবার সব্বাই মিলে যাই ঘুরতে এদিক সেদিক। কখনও বড় টুর দশ দিনের কখনও ছোট, দুরাতের। এবারো তাই ছিল। পাঁচটা ফ্যামিলি মিলে এসেছি সাগরপাড়ের এই নামী রিসর্টে। অফ্ সিজন, তারপর উইক ডে। একদম ফাঁকা। আমরাই শুধু। তা মৌজ মস্তি একটু বেশিই হলো। দিনে রাতে সব বেলাতেই। সৈকতে বাচ্চাদের সাথে হুটোপুটি, স্নান, ডাবের শাঁস। দুপুরে সাঁটিয়ে লাঞ্চ, চমৎকার রান্না এদের। তারপর একটু আয়েশের ঘুম। বিকেল শেষে উঠেই এক কাপ ধোঁয়ান্ত চা, আহা! কিন্তু সন্ধ্যে থেকেই যত ঝামেলা। আরে এদের বারণ করলেও শোনে না। দেদার আড্ডা, পান, অনুপান। তারপর চলে বাজী। না না, দুমদাম পরিবেশ দূষণের বাজি নয়! এ হলো সেই মহাভারতীয় যুগ থেকে চলে আসা বাজী। এটা কোন সিনেমার গান বল তো, ওটা কোন লেখকের লেখা জানিস, রোনাল্ডোর সব থেকে বেশি গোল কোন ক্লাব খেয়েছে, গত পূজোতে দাদাবৌদির বিরিয়ানির দাম বেড়েছিল না বাড়েনি, পাড়ার অমুক দাদার তমুক দিদির সাথে ইয়ে ছিল কি না- সব কিছু নিয়েই বাজী। বাজীর শর্ত কি? কি না, সেটা বললেই বোধহয় ভালো। কখনও এক কেজি চিকেন তো কখনও গোটা একটা বই। কখনও তিনমাস বিরিয়ানির উপর নিষেধাজ্ঞা তো কখনও সিনেমা দেখাও গোটা দলকে! এইবারে আমি পড়েছি ফাঁদে।
রামের বয়স বেশি নাকি জাম্বুবানের – মানে ইয়ে, ঐ ভল্লুক আর কি! কে বেশি বড়, মানে বেশি পুরাতন তাই নিয়ে তক্ক, বাজী। ! আরে আরে, রামায়ন ভেবে ভুল করবেন না। এই রাম আর ভাল্লুক হলো গিয়ে বোতলবন্দি জিনের মত ক্ষমতাধর দাসানুদাস! কিন্তু অর্বাচীনের দল জানেই না, আমার কাছে এটা কোন তর্কের বিষয়ই না! ভল্লুকের আদি ইতিহাস জানে ওরা? সেই মিশরের পিরামিডেও সে বহাল তবিয়তে বিরাজমান ছিল! রাম তো সেই তুলনায় দুদিনের ছোকরা। তা, এই যদি বাজীর বিষয় হয় তার শর্ত তো জলবৎ তরলং হবেই, বুঝলেন কিনা! এখন সেই বাজী জেতার কারণে যদি ঐ রক্তবরণ তরলের কোটা আমার বর্ধিত হয়, অতঃপর আমার বোধ চেতনা উন্মাদনা বাক্যস্ফূর্তি পদচারণা সবকিছুর দখল নেয়, তো আমার আর কি করার আছে বলুন তো! তাও তো বুঝলেন কিনা, হুঁশ আমি হারাইনা কখনও।
এই এখন যেমন খেতে বসেছি, আমার ভাগের খাবারটি তো খাবো নাকি! খাবার নষ্ট করা এক্কেবারে উচিত নয়, সেটাও তো ঠিক, নাকি! তা, আমার না হয় ধীরে সুস্থে বেছে বুছে চিবিয়ে গিলতে একটু বেশি সময় লাগছে আজ, তা বলে কি খাবো না! তো, আমার ফ্যামিলি, দলের সবাই, মায় বন্ধু বলে জানি যাদের, যাদের সাথে বাজী ধরি বাজী হারি, তারাও কিনা আমাকে রেখে চলে গেল! আমিও ছাড়বো না, যতক্ষন হুঁশ ততক্ষন মান। যতক্ষন মান ততক্ষন কচু, মানে আমার কচু হবে! ঐ খাবার সব খেয়ে তবে রুমে যাবো। রুম গুলো রেস্তরাঁ থেকে বেশ দূরেই। তার উপরে আলো টালোও সব নিভিয়ে দিলো রিসর্টের লোকজন, রেস্তরাঁর ভেতরে কেবল দু’এক জন রয়ে গেল। আমার জন্যই হবে। বললাম বাপু দাঁড়া, সব শেষ করেই উঠবো, এট্টু সময় দে। নরম তুলতুলে রুটি ছিঁড়ে মাখো মাখো মাটনের গ্রেভিতে ডুবিয়ে মুখে পুরে আহ্! সঙ্গে সঙ্গে চিবিয়ে খেয়ে নিলে আর স্বাদ পেলাম কই, রয়ে সয়ে খেলে তবে না মজা! তার সাথে আয়েশ করে কুড়মুড়িয়ে হাড় চিবাও, সুরুৎ করে টান দিয়ে হাড়ের অন্তঃস্থল পর্যন্ত সারশূণ্য করে দাও তবে না জীবন! এই বিপুল উল্লসিত উপভোগের মধ্যে এক হিলহিলে ধরনের ছোকরা, ছোকরা নাকি বয়স্ক, বয়স্ক বয় তো দিনে দেখিনি! সে যাই হোক্, তার চেহারাটা কেমন ঝাপসা ঝাপসা ঠেকায় আমি আর বয়স নিয়ে মাথা ঘামাইনি। হুঁশ কিন্তু আমার দিব্যি আছে! সেও দিব্যি আমার উল্টোদিকে বসে ফিনফিনে স্বরে বললো, হাড়গুলো চিবোচ্ছেন? এইভাবে? এই রকম জান্তব খাদ্যাভ্যাস নিয়ে এই থ্রি স্টার রিসর্টে উঠেছেন? এটিকেট বলে কি কিছুই শেখেননি!
মরেচে! এরা আবার এই সব দার্শনিক ধরনের বয়টয় রেখেছে নাকি! এই অবেলায় আমাকে জ্ঞান দিতে এসেছে? এটিকেট বলে যে একটা বস্তু আছে সে তো আমি বিলক্ষণ জানি! সেসব যারা তৈরি করেছে তাদের হাড্ডিগুড্ডি পেলে বেশ করে চিবোতাম! হঠাৎ একটা কথা চড়াৎ করে মনে পড়লো। চনমনে স্বরে বললাম ব্যাটাকে- খুব জ্ঞান দিচ্ছো না, খুব এটিকেট শেখাচ্ছো? বিরাট জানেবালা মনে করো নিজেকে? তা একটা গপ্প বলবো, বলতে পারবে কার লেখা? বাজী ধরলাম, বলতে পারলে তোমার কথা আমি শুনবো। হাড় চিবোনো বন্ধ!
না পারলে? ফিনফিনে প্রশ্ন। না পারলে…. তুমিই বলো! ঠিকাছে, না পারলে আমার হাড়গুলোও আপনি চিবাবেন। তোমার হাড়! ইস্ এঁটো হাড় চিবোবো আমি? তোমার সাহস… আরে ছিঃ ছিঃ, না না এঁটো না, এঁটো না। বললে যে তোমার হাড়? মানে তোমার খাওয়া… আরে নাহ্, আমারই হাড়, কিন্তু এঁটো না। সেটা কি করে হয়, তা নিয়ে পরে আবার নাহয় একটা বাজী ধরবো, কেমন? এখন আপনার গপ্প বলুন। আরেকটা বাজী! নড়েচড়ে বসি। হুঁশটা পুরোপুরিই আছে আমার। গুছিয়ে শুরু করি- মুর্গীর ঠ্যাংটি হাতে নিয়ে ‘কড়কড়ায়তে, মড়মড়ায়তে’ বেশির ভাগ ইউরোপীয়ই নিজের বাড়িতে করে, কিন্তু বাইরে নৈব নৈব চ। ঐ সেই এটিকেট, বুঝলে তো? তবে কোন কোন জার্মান এবং সুইস রেস্তোরাঁয় রোস্ট সার্ভ করবার সময় মুর্গীর ঠ্যাংগুলো সুন্দর করে উপরের দিকে সাজিয়ে রাখে আর ঠ্যাংগুলোর ডগায় বাটার পেপারের ক্যাপ পরিয়ে দেয়! হাত নোংরা না করেই ঐ ঠ্যাংটা চিবোনো যায়। এ ব্যবস্থা দেখে ইংরেজদের কিন্তু জিভে জল আসেই আসে, কিন্তু সেটা চেপে গিয়ে বলে, ‘জর্মনরা বর্বর! এখন বলো তো দেখি ছোকরা, এ গল্প কার লেখা? হি হি হি হি…. বাপ্ রে, ফিনফিনে স্বরে হাসির কি নমুনা! যেন ভূতের হাসি। গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। কিন্তু ব্যাটা হাসে কেন? নিন্, রাখুন আপনার হাড় চিবানো। হেরেছেন। এই লেখা কার বলতে পারবো না? আলী সাহেব আমার প্রিয় লেখক। ফিনফিনে উত্তর শুনে আমার চক্ষু চড়কগাছ! যাহ্ হেরে গেলাম যে! কিন্তু এ তো বেশ কালটিভেট করার মত বয়! মাথাটা নেহাত বোঁ করে…. তবে হুঁশ কিন্তু হারাইনি।
তবে এই মুহুর্তে এমন একটা লেখা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য আপনাকেও জিতিয়ে দিলাম। নিন্ আমার হাড় গুলো দিয়ে দিই – বলতে বলতে ফিনফিনে স্বরটা কেমন খটেখটে হয়ে গেল! চোখের সামনে ঝাপসা চেহারাটা ফটফটে সাদা হাড়ের শরীর হয়ে গেল! তারপর খটাখট টকাটক সব কটা হাড় খুলে খুলে আমার সামনে টেবিলের উপর জমা হয় l সত্যি বলছি, তখনও পর্যন্ত আমার হুঁশ ছিল পুরোপুরিই।