রম্যরচনা -তে শিলাদিত্য মুখোপাধ্যায়

জন্ম ১১/১০/৬২, রম্যরচনায় অসাধারণ পারদর্শী, লেখেন রম্য কবিতা এবং ছড়া।

শৈত্যপ্রবাহ

এবার থেকে যাহা বলিবো মিথ্যা বলিবো, মিথ্যা বৈ সত্য বলিবো না…এমন ধনুকভাঙ্গা পণ করেও কথা রাখতে না পারাটাই যেন আমার এই মূহুর্তে অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে…যখনই কিছু লিখতে বসি তখনই আমার জীবনের সমস্ত সত্যি গুলো হড়হড়িয়ে বেরিয়ে এসে ঝর্ণার জলের ঝরঝরিয়ে ঝরতে শুরু করে দেয় আর সেটা পড়ার পর সবাই আমাকে নিয়ে যাচ্ছেতাই করে…সবার কাছে হাসিঠাট্টার পাত্রও হই…। কিন্তু কথাতেই আছে, স্বভাব যায় না মলে…তাই লিখতে বসলে আমি সত্যিটাই লিখি…যেমন আমি এখন হলফ করে বলতে পারি যে আমার পাশে যদি গিন্নি থাকে তাহলে আমি শীত ছাড়া আর দুনিয়ার কাউকে পরোয়া করি না…একমাত্র শীতই আমার আত্মবিশ্বাসের ভিত কে কাঁপিয়ে দিয়েছে…নইলে…!! থাক সে কথা…নিজের ঢাক আর কত নিজে পেটানো যায় বলুন তো…??
তবে হ্যাঁ…এটা স্বীকার করতে আমি এতটুকু লজ্জিত বা কুণ্ঠিত নই যে আমি আগেও শীতকাতুরে ছিলাম, এখনও আছি আর আগামীতেও থাকবো…। একজন প্রকৃত শীতকাতুরে হতে গেলে যা যা গুণাবলী থাকা প্রয়োজন তার যাবতীয় গুণ আমার মধ্যেই বিদ্যমান…আমি বারো মাসই ঠকঠক করে কাঁপি (শীতকাল ছাড়া বাকি সময়টুকু গিন্নির ভয়ে), উনিশ থেকে বিশ হলেই হাঁচি শুরু…প্রথমে খান দশ-বারো, এরপর পাক্কা সাড়ে তিন মিনিটের একটা ছোট্ট বিরতি…তারপরই একসাথে খান ত্রিশ-চল্লিশ হাঁচি…এরও ঠিক দু’মিনিট পাঁচ সেকেণ্ড পর থেকেই ননস্টপ…পুরো টি-টোয়েন্টি ম্যাচ…বিভিন্ন স্টাইলে বিভিন্নরকম আওয়াজে নির্গত হতে থাকা কানঘাতী হাঁচি…এইভাবে মিনিট কুড়ি চলার পর অবশেষে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিমায় “বাপি বাড়ি যা” বলে গগনবিদারী “হ্যাঁচ্চোওওও..হ্যাঁচ্চ্যাওওও…” হাঁচি দিয়ে তবেই ইনিংসের সমাপ্তি ঘোষণা করি…। যদিও এর মধ্যেও দু’একটা কে বাউন্সার সামলানো মতো মাথা নীচু করে, থুড়ি…!! মাথাকে গগনমুখী অবস্থায় রেখে জলহস্তী টাইপের হাঁ করে প্রাণপণে নাক টিপে সামলে নেওয়া আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে “ছিঁক..ছিঁক” আওয়াজে অনেকটা ব্যাটের কানায় লেগে সিঙ্গল রান নেওয়ার স্টাইলে ময়দানে গড়িয়ে দিই…তবে ততক্ষণে নাক কিন্তু জলদানের বিরতি পালন করা শুরু করে দিয়েছে…কারণ এর পরপরই নাক দিয়ে কাঁচা জল গড়ানো শুরু…আধঘন্টার মধ্যেই নাক ইনসাফিশিয়েন্সি অফ এয়ার উইথ ওভার ফ্লো অফ ওয়াটারের কারণ দেখিয়ে পুরোপুরি লক-আউট ঘোষণা করে আর তখন আমার কথাবার্তাতেও কেমন যেন একটু অশরীরির ছোঁয়া…যে কথাই বলতে যাই, তাতেই চন্দ্রবিন্দুর আধিক্য এসে পড়ে…!! একবার তো আমার হাঁচির আওয়াজে আশপাশের লোকজন পর্যন্ত ছুটে এসেছিলো…!!! তারা আমার নানাবিধ বেআক্কেলেপনার সাথে এতটাই সুপরিচিত ছিলো যে দূর থেকে আমার হ্যাঁচ্চোওওও…হ্যাঁচ্চ্যাওওও আওয়াজ শুনেই ভেবে নিয়েছিলো যে নির্ঘাত আমি গিন্নি কাছে প্রচুর মারধোর খেয়ে চিৎকার করে বলছি “কে আছোওওও…বাঁচাওওও…কে আছোওওও…বাঁচাওওও…।”
নতুন বছর পড়লে আমার সর্বপ্রথমে একটাই কাজ…যেখান থেকে পারো একটা এক পাতার লাল রং-এর ক্যালেন্ডার জোগাড় করো…তবে বিশ্বাস করুন…?? আমি কোনো পন্থী না হওয়া সত্ত্বেও আমার এই বামপন্থী রং-এর প্রতি প্রীতি কোথা থেকে এসেছিলো তা আমার আজও অজানা…। যাইহোক, এরপরের কাজই হলো সেই ক্যালেন্ডারে কবে কাগজওয়ালা কাগজ দেয়নি, গয়লা কবে দুধ দেয়নি, ধোপা কবে আমার জামা দেয়নি, কবে গিন্নি গ্যাস লাগিয়েছে…এইসব দাগিয়ে রাখা…। তবে এইসব কাজের চাইতেও ঐ ক্যালেন্ডারের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ঠিক কবে আমার শীতের পোষাক বের করে রাখতে হবে সেটা গিন্নিকে মনে করিয়ে দেওয়া…। ক্যালেন্ডার হাতে পাওয়ার পর আমার প্রথম কাজই হলো খুঁজে কালীপূজো কবে তা বের করা…তারপরই ঐ তারিখের ওপর কালি দিয়ে গোটাগোটা অক্ষরে দাগিয়ে দেওয়া #আজআমারশীতেরজামাকাপড়চাই আর সেই ক্যালেন্ডারের কাজ হলো বাড়িতে সারাদিন, সারাক্ষণ আমার গিন্নির নাকের ডগায় “ঝুলে ঝুলে লাল…মস্ত ক্যালেন্ডার” হয়ে দুলে দুলে তার ভুলে যাওয়ার প্রবণতা কে প্রশমিত করা…। একমাত্র এইবারই গরম জামাকাপড় আমার সময়মতো বের করে দেওয়ার পরেও গতকাল অবধি একটাও গায়ে না দেওয়ার জন্য গিন্নির রোষকষায়িত নয়নঠারে ভস্মীভূত হওয়ার আগেই আজ একটা পাতলা উইণ্ড চিটার বগলদাবা করে কাজে বেরিয়েছি…।
সবার মনে আছে কিনা জানিনা গতবার কিন্তু মারাত্মক ঠাণ্ডা পড়েছিলো…আমিও যথারীতি নিজেকে শুধুমাত্র চোখ আর নাক, এই দুটোকে মুক্ত রেখে আগাপাশতলা গরম পোশাকে মুড়ে ফেলেছিলাম…নীচে উলিকটের গেঞ্জি, তার ওপর একটা হাফ আর একটা ফুলহাতা সোয়েটার, তারও ওপরে মোটা উইণ্ড চিটার, গলায় মাফলার, মাথায় উলেন টুপি, হাতে গ্লাভস…এইসব ভেদ করে ঠাণ্ডা তো দূরের কথা…বন্দুকের গুলিও আমার শরীরে প্রবেশ করার আগে দশবার চিন্তা করবে..। জীবনে কোনদিন মহাকাশে যাওয়ার কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম, উড়োজাহাজেও চাপতে পারবো কিনা সন্দেহ সেটা জানা সত্ত্বেও এইসব পরিহিত অবস্থায় নিজের মধ্যে কেমন যেন একটা নভোচারী নভোচারী ফিলিংস আসতো…!!
এক রবিবার এমনই সাজে বাজার গিয়ে কি যে ফ্যাসাদে পড়েছিলাম সে আর কি বলবো…!!! একে সর্দিতে নাক পুরো বন্ধ…যেটাই বলছি সেগুলোর প্রতিটাতে আপনিই চন্দ্রবিন্দু যোগ হয়ে অনেকটা অশরীরীদের বলা কথার মতো শোনাচ্ছিলো…!!! কিন্তু সে বললে তো আর হবে না…!!! বিবাহিত পুরুষ মাত্রই হাজার অজুহাতেও বাজারে যাওয়া থেকে মুক্তি নেই…তাই গুটি গুটি পায়ে বাজারে গিয়ে প্রথমেই আলু বিক্রেতা পাণ্ডেজীর কাছে গিয়ে গম্ভীর মেজাজে বললাম, “ঢাঁই কেঁজি…” পাণ্ডেজী উত্তর দিলেন, “হাঁ জী…বলিয়ে জী…” আমি আবারও “ঢাঁই কেঁজি” বলে দাঁড়িয়ে রইলাম…প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিট অতিক্রান্ত…যারা পরে এসেছিলো তারাও সবাই আলু নিয়ে চলে গেলো…বাধ্য হয়েই আবার বললাম, “ক্যাঁ হুঁয়া…?? ঢাঁই কেঁএএজি…” পাণ্ডেজী আবার বললেন, “জী জী…হাঁ জী..বলিয়ে জী…” আবার দশ মিনিট পার…দোকানে আমি ছাড়া আর কেউ নেই…এবার পাণ্ডেজী নিজেই আমার দিকে চেয়ে বললেন, “ক্যা হুয়া…?? বলিয়ে জী…??” এবার গেলো আমার মটকা গরম হয়ে…মুখের ওপর থেকে হনুমান টুপি, মাফলার টান মেরে সরিয়ে ফাঁকটা কে একটু বড় করলাম, তারপর চিৎকার করে বললাম, “ঔঁর কিঁতনি বাঁর বঁলুউঁউঁউঁ…!! ঢাঁই কেঁজিইঁইঁ…ঢাঁই কেঁজিইঁইঁইঁ…” আসলে একে অত চাপাচুপি দেওয়া মুখ আর তার ওপর নাকে নাকে কথা…তাই বারবার “ঢাঁই কেঁজি” বলা সত্ত্বেও আলু ওয়ালা বারবার সেটাকে শুধু “পাণ্ডেজী” বলে ডাকতেই শুনেছিলেন…।
আর একবার মাছের বাজারে যেতেই মাছওয়ালা জানতে চাইলো, “কি দাদা..?? কাতলা…? না রুই…??” আমার ঐ ঢাকাঢুকি দেওয়া মুখগহ্বর থেকে শুধু কুঁইকুঁই করে আওয়াজ বেরোলো, “রুঁই”…মাছওয়ালা আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে একটা আঙুল তুলে কি যেন বোঝাতে চাইলো…!! আমি ভাবলাম ১ কেজি দেবো কিনা জানতে চাইছে…আমিও কলের পুতুলের মতো ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম…বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বললাম, ” কঁই দাঁওওও…?” মাছওয়ালা বিজ্ঞের মতো উত্তর দিলো, “কই তো নেই…শুধু কাতলা আর রুই…।” এই কেলো করেছে…!! কই কখন চাইলাম…!!! বাধ্য হয়ে আমি আবার কুঁইকুঁই করে বললাম, “আঁরে বাঁবা..!! রুঁই..রুঁই…” তাই শুনে মাছওয়ালা খেপে গিয়ে সেই আগের মতোই আঙুল দেখিয়ে বললো, “এখানে শুধু রুইই আছে…পুঁই ওদিকে…।” কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলাম…পরে বুঝলাম আমার ঐ মিনমিন করে নাকে সুরে রুই কে ও পুঁই শুনেই তর্জনী দিয়ে ইঙ্গিতে বোঝাতে চেয়েছিলো ওদিকে আছে আর কঁই দাঁও কে কই মাছ দেবার কথা ভেবে ঘাপটি মেরে বসেছিলো…।
আর একদিন এমন ঘটনা ঘটেছিলো যে তা আর কহতব্য নয়…!! একদিন সন্ধ্যেবেলায় ঐরকম নভোচারী অবস্থায় আমাদের ঘরের বাইরে দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম…দরজার ঠিক মুখোমুখিই আমাদের ঘরের আলমারিটা রাখা থাকে…আয়না লাগানো আলমারি…আচমকাই ঘরের মধ্যে নজর পড়তেই আঁতকে উঠলাম…দেখলাম একজন অচেনা মানুষ ঘরে আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে…বুকের ভেতরটা ছ্যাঁক করে উঠলো…!!! সদ্য মাইনের টাকা গুলো আলমারিতে তুলে রেখেছি…!! ঝেঁপে দিলে সারা মাস তো না খেয়ে থাকতে হবে…!! দু’দিন আগেই গিন্নি বিয়েবাড়ি ঘুরে এসে কিছু গয়নাও আলমারিতে তুলে রেখেছে…!! আর কালবিলম্ব না করে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে চোখ বন্ধ করে কাঁপা কাঁপা গলায় “চোঁওঁওঁর, চোঁওঁওঁওঁর” বলে চিৎকার শুরু করে দিলাম…বাড়ির সবাই দুদ্দাড়িয়ে এসে হাজির হয়ে গেলো…সদ্য টিভিতে দেবী চৌধুরানী দেখে আমার গিন্নি তো তখন একেবারে ফুলন দেবীর ফর্মে রয়েছে…!! সেও কোথা থেকে একটা আস্ত নাদন হাতে লেডি সামুরাই-এর মতো অকুস্থলে হাজির…গিন্নি অমন রণং দেহী মূর্তি দেখে আমার মনে তো আর ফুর্তি ধরে না…!! আব আয়েগা মজা…ব্যাটা চোর…!! দ্যাখ কেমন লাগে…!!! গিন্নি আসা মাত্রই আমি দুর্দান্ত রিফ্লেক্সের সাহায্যে তড়াক করে এক লাফ মেরে একেবারে গিন্নির পেছনে…গিন্নি এবার সরাসরি আমায় প্রশ্ন করে বসলো, “কোথায় চোর…??” আমি আঙুলের ইশারায় ঘরের ভেতরে দেখিয়ে দিলাম…গিন্নি নাদনবাড়ি বাগিয়ে আমজাদ খান স্টাইলে দোড় গোড়ায় পায়চারি করে করে বলতে লাগলো, “বেরিয়ে আয় বাইরে…তাহলে কিচ্ছু বলবো না…কিন্তু আমি যদি ঘরে ঢুকি…!!! তাহলে তোর একদিন কি আমার একদিন…।”
উফফফ্…!!! সেই চির পরিচিত ডায়লগ…!!! প্রায় ২২ বছরের বিবাহিত জীবনে প্রতিদিনই কতবার যে শুনেছি…!!! অব তেরা ক্যা হোগা রে কালিয়া…?? দু’একবার হুঙ্কার দিয়েই গিন্নি জ্যাকি চ্যাং-এর স্টাইলে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো…ঢুকেই আলমারির পাশ, খাটের তলা, জানলার কোণা, মায় ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার পর্যন্ত আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও যখন চোরের সন্ধান পেলো না…তখনই বাইরে এসে খপ করে আমার ঘেঁটি ধরে হিড়হিড় করে টেনে ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েই হুঙ্কার দিলো, “কোথায় চোর…?? খুঁজে বের করো…” আমিও মেঝেতে হামাগুড়ি গিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজে কিছু না পেয়ে যেই না উঠে দাঁড়িয়েছি…!!! অমনি দেখি সেই লোকটা ঠিক আমারই পাশে দাঁড়িয়ে আছে…!!! চোখ কপালে তুলে ভিরমি যাবো কিনা ভাবছি…ঠিক তখনই খেয়াল করলাম এত আমি নিজেই…!!! আয়নার মধ্যে আমার নিজেরই প্রতিবিম্ব…!!! তারপর যে ঘটনা ঘটেছিলো তা শুনলে আপনাদের দেহেও শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাবে…তবে তার কোনও প্রমাণ আমার এই মূহুর্তে তো বটেই, সেই মূহুর্তে চাইলেও আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভবপর ছিলো না…কারণ…?? কারণ গায়ে মোটা মোটা গরম জামা থাকার ফলে লাঠি সেই ভাবে আমার দেহে কোনো দাগই ফেলতে পারেনি…।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।