মেহফিল-এ-Guftagu, রুদ্র সুশান্ত

স্রোতাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন মান্না দে

“কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই” এই এক লাইন গানেই পাঠক বুঝতে পেরেছেন, আমি কার কথা বলছি। ১লা মে, ১৯১৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন এই মহান শিল্পী প্রবোধ চন্দ্র দে, যিনি সকলের কাছে ‘মান্না দে’ নামে পরিচিত। রবীন্দ্র সঙ্গীত, কাওয়ালি,  গজল, ক্লাসিক্যাল, সেমিক্লাসিক্যাল, আধুনিক গান, রক এন্ড রোলসহ প্রায় সব ধরণের গানেই তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত তিনি চলচিত্র জগতে অপ্রতিদন্দ্বী হিসেবে সন্মান অর্জন করেন। প্রায় ৩৫০০ এর অধিক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তাঁর কণ্ঠে গাওয়া আধুনিক গুলোকে স্রোতাগণ একান্ত নিজের করে নিয়েছেন।
 ঠিক তেমন একটা গান-
“যদি কাগজে লেখো নাম কাগজ ছিড়ে যাবে
পাথরে লেখো নাম পাথর ক্ষয়ে যাবে।
হৃদয়ে লেখো নাম সে নাম রয়ে যাবে।।
হৃদয় আছে যার সেই তো ভালোবাসে
প্রতিটি মানুষেরই জীবনে প্রেম আসে।
কেউ কি ভেবেছিলো শ্যামকে ভালোবেসে
রাধার ভালবাসা কাহিনী হয়ে যাবে।
হৃদয়ে লিখো নাম সে নাম রয়ে যাবে।।
গভীর হয় গো যেখানে ভালোবাসা
মুখে তো সেখানে থাকে না কোন ভাষা।
চোখেরও আড়ালে মাটির নীচে ঐ
ফাল্গুন চিরদিনই নীরবে বয়ে যাবে।
হৃদয়ে লিখো নাম সে নাম রয়ে যাবে।।”
মান্না দে’র গাওয়া গানগুলো আমাদের প্রত্যাহিক জীবনের সাথে গেঁথে আছে, গানগুলো যেনো জীবনের কথা বলে। আদর-স্নেহ, মায়া-মমতা, বন্ধুত্ব, প্রেম-ভালোবাসা, জীবনের অনুভূতি সবকথাই আছে তাঁর গানে। কণ্ঠ দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন, বিশ্ববাসীর কাছে খুবই পরিচিত নাম মান্না দে। তিনি শুধু বাঙলা কিংবা হিন্দিতে নয়, পাঞ্জাবি, মারাঠি, ভোজপুরি, ওড়িয়া, সিন্ধি, আসামী, কোঙ্কনি, গুজরাটি, নেপালী, মাগধী, মালায়ালম এসব ভাষায়ও গান করেন। সব শ্রোতাদের কাছে তাঁর অমর সৃষ্টির একটু তাঁর “কফি হাউজ” গানটি।
বাঙলায় এমন কোন স্টেজ শো হয়তো তিনি করেননি যেখানে দর্শক তাঁকে এই গানটি গাওয়ার অনুরোধ করেনি। গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখা ও সুপর্ণ কান্তি ঘোষের সুরে গাওয়া সেই কালজয়ী গানটি-
“কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই,
আজ আর নেই
কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো
সেই, আজ আর নেই।
নিখিলেশ প্যারিসে মইদুল ঢাকাতে নেই
তারা আজ কোন খবরে
গ্র্যান্ডের গীটারিস্ট গোয়ানিজ ডিসুদা
ঘুমিয়ে আছে যে আজ কবরে
কাকে যেন ভালোবেসে আঘাত পেয়ে যে
শেষে পাগলা গারদে আছে রমা রায়
অমলটা ধুঁকছে দুরন্ত ক্যান্সারে জীবন করেনি
তাকে ক্ষমা হায়।।
সুজাতাই আজ শুধু সবচেয়ে সুখে আছে, শুনেছি
যে লাখপতি স্বামী তার
হীরে আর জহরতে আগাগোড়া মোরা সে,
বাড়ি-গাড়ী সবকিছু দামী তার।
আর্ট কলেজের ছেলে নিখিলেশ সান্যাল
বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকত,
আর চোখ ভরা কথা নিয়ে নির্বাক শ্রোতা
হয়ে দি সুজাটা বসে শুধু থাকত।।
একটা টেবিলে সেই তিন চার ঘন্টা
চারমিনার ঠোঁটে জ্বলত
কখনো বিষ্ণু দে কখনো যামিনী রায় এই নিয়ে
তর্কটা চলত।
রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে যেখানেই যে থাকুক কাজ
সেরে ঠিক এসে জুটতাম
চারটেতে শুরু করে জমিয়ে আড্ডা মেরে
সাড়ে সাতটায় ঠিক উঠতাম।।
কবি কবি চেহারা কাঁধেতে ঝোলানো ব্যাগ
মুছে যাবে অমলের নামটা
একটা কবিতা তার হলো না কোথাও ছাপা
পেল না সে প্রতিভার দামটা।
অফিসে সোস্যালে ম্যামেচার নাটকে রমা রায় অভিনয় করত
কাগজের রিপোর্টার মইদুল এসে রোজ কি
লিখেছে তাই শুধু পড়ত।।
সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে,
সাতটা পেয়ালা আজও খালি নেই
একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি শুধু
সেই সেদিনের মালী নেই
কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউজে কত
স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়
কতজন এলো গেল কতজনই আসবে কফি
হাউজটা শুধু থেকে যায়।।”
জীবনের প্রত্যেকটি ছন্দকে তিনি কণ্ঠে লালিত করেছেন। তাঁর গান জীবনের কথা বলে, জীবনের বহুমুখীতার কথা বলে। তিনি মাতৃভক্তিমূলক গানও করেছেন এবং তা স্রোতাশ্রেনীর মনও জয় করে নেয়। মায়ের একজন অনাহূত ভক্ত হিসের মায়ের মন্দিরে নিজেও সমর্পণ করেছেন। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ও মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়েরর সুরে গেয়েছেন-
“আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি
আমি অনাহূত একজন, অনেক দোষেতে দোষী।।
আমি সবার পিছনে থাকবো শুধু মনে মনে মাকে
ডাকবো
কারো কাজে বাধা দিলে সাজা দিও যত খুশী
আমায় সাজা দিও যত খুশী।।
ভেব না হঠাৎ সামনে গিয়ে মায়ের চরণ ছুঁয়ে দেব।
দুর থেকে শুধু চোখের জলেতে মার রাঙা পা ধুয়ে দেব।
শুধু আরতি যখন করবে, মা’র পূজাদীপ তুলে ধরবে
আমাকে দেখতে দিয়ো মায়ের একটু হাসি।।”
১৯১৯সালে মা মহামায়া দে ও পিতা পূর্ণচন্দ্র দে’র কোলে জন্মগ্রহণ করেন এই মহান শিল্পী। তাঁর কাকা কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র কাছেই তিনি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছেন।কাকার কাছে গানের প্রথম পাঠ নেন। বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ার সময় তিনি পরপর তিনবার সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথম হন। ১৯৪৩ সালে ‘তাম্মানা’  ছবিতে প্রথম গান করে জনপ্রিয় হন।  পরে ১৯৫০ সালে শচীন দেব বর্মনের নির্দেশনায় ‘মশাল’ ছবিতে একক গান করেন, এরপর তাঁকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি। একের পর এক জনপ্রিয় গান গেয়ে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। এইসব অমর সৃষ্টি তাঁকে হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখবে। তেমনি একটি জীবনমুখী গান “আদরের ছোট বোন”।
পুলক ব্যানার্জির লেখা ও সুপর্ণ কান্তি ঘোষের সুরে গাওয়া সেই গানটি-
“মার স্নেহ কাকে বলে জানিনা
বাবার মমতা কি বুঝতে না বুঝতে
এ বিরাট পৃথিবীতে দেখলাম
সে ছাড়া আমার আর কেউ নেই
সে আমার ছোট বোন
বড় আদরে ছোট বোন (২)
ভালো করে যখন সে কথা শিখে নি
তখন থেকে সে গেয়ে যেত গান।
বাজনার হাত ছিলো ভালোই আমার
তার সাথে বাজাতাম দিয়ে মন প্রাণ।।
রাস্তায় ভিড় করে শুনতো সবাই
অবাক হতো যে কত জ্ঞানী গুণী জন।
ভোর বেলা তার গানে ঘুম ভাঙ্গতও
রাতে তাকে বাজনায় ঘুম পারাতাম।।
ভাইয়ের বাজনায় আর বোনের গানে
সহজ সরল সেই দিন কাটাতাম
ছোট্ট একটি ঘর এদুটি মানুষ
এই ছিলো আমাদের সুখের ভুবন
একদিন যখন সে একটু বড়
প্রথম সুযোগ এলো এক জলসায়
মুগ্ধ শ্রোতারা তার কণ্ঠ শুনে
দুহাত ভরালো তার ফুলের তোড়ায়
ঘরে এসে আমায় সে করলো প্রণাম।
প্রথম ভরলো জলে আমার নয়ন
তারপর কি যে হলো গান শুধু গান।।
ছড়িয়ে পরলো তার আরো বেশী নাম
শ্রোতারা উজাড় করে দিলো উপহার
দিলোনা সময় শুধু নিতে বিশ্রাম
ক্লান্তির ক্ষমা নেই ওদের কাছে
আরো বেশী দিতে হবে বুঝে নিল মন
একদিন শহরের সেরা জলসায়
সেদিন গলায় তার দারুন জ্বালা
তবুও শ্রোতারা তাকে দিলোনা ছুটি
শেষ গান গাইলো সে পরে শেষ মালা
শিল্পের জন্য শিল্পী শুধু
এছাড়া নেই যে তার অন্য জীবন
নীরব হলো ছোট বোন
বড় আদরের ছোট বোন
তার গান থেমে গেছে নেই শ্রোতা আর
আমি একা বসে আছি স্মৃতি নিয়ে তার।
আনন্দ নিয়ে গেছে ওরা সকলে
দুঃখটা হোক আজ শুধুই আমার।
অনুযোগ এতো নয় এই শিল্পীর
ভাই বোন সকলের ভাগ্য লিখন।”
সঙ্গীতে তাঁর অবদানের কথা স্বীকার করে ভারত সরকার ১৯৭১ সালে পদ্মশ্রী, ২০০৫ সালে পদ্মবিভূষণ, ২০০৯ সালে দাদাসাহেব ফালকে সম্মাননায় ভূষিত করেন। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে রাজ্যের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘বঙ্গবিভূষণ’  প্রদান করেন।
এই মহান গুণী শিল্পী ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর ব্যাঙ্গালোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। দৈহিক মৃত্যু হলেও তিনি সহস্র বছর বেঁচে থাকবেন অজস্র স্রোতাদের হৃদয়ে।
Spread the love

You may also like...

error: Content is protected !!