প্রবাসী কোনও কবিতাপ্রেমীর কবি হিসেবে কলকাতার বইমেলায় আত্মপ্রকাশের ধাপগুলি মোটামুটি সহজ ও অনায়াস। প্রথমত যাঁর সেভিংস অ্যাকাউন্টে ডলার বা পাউন্ড জমছে, কাব্যগ্রন্থ নির্মাণের খরচ নিয়ে তাঁকে দু’বার ভাবতে হয় না। ছাত্রাবস্থায় যাদবপুর, শিবপুর বা খড়্গপুরের হস্টেলে যে-কবিতাখাতা ছিল মূলত অসূর্যম্পশ্যা তথা নিজের সঙ্গে সংলাপ, প্রবাসের নিরাপদ থিতু জীবনের উইক-এন্ডে সেই খাতার পৃষ্ঠা উত্তরোত্তর ভরেছে। অত:পর শখ হবে, ইচ্ছা হবেই।
তো সেই কবিপ্রতিভার আবরণ উন্মোচনের জন্য কলকাতার বইমেলার মতন আদর্শ মক্কা-মদিনা জ্যাকসন হাইট বা ট্রাফলগার স্কোয়্যারে নেই।
তার আগের ধাপে ফেসবুকের বন্ধুরাই জানিয়ে দিয়েছেন, কোন্ প্রকাশনা অখ্যাত অথচ ছক-ভাঙা (!) তরুণ কবিদের কাজ নিজস্ব কেতা-কায়দায় হট্ এবং হট্ কে প্যাকেজে বাজারে ছাড়ছে। তাদের ফেসবুক পেজ আঁতেল ও খরসান উত্তর-আধুনিকতায় ছয়লাপ। কয়েকজন পরিচিত, প্রতিষ্ঠিত কবি/লেখকের কাজ ছাপা হয় বটে, তবে বেশিরভাগই তরুণ তুর্কি। মেধায়, মেজাজে, শব্দ-প্রয়োগে তুখোড় স্মার্ট ও ‘ অন্যরকম ‘।
বিষয় অবশ্য সেই একই প্রাচীন মদিরা — প্রেম, ভাঙা প্রেম, স্পৃহা, প্রতিবাদ, বিষাদ, স্বগতোক্তি, যৌনতা, সমাজচেতনার ককটেল। জিঘাংসা, প্রতিহিংসার লাইনটাইনও থাকতে পারে।
ফর্মে কিছু বৈচিত্র্য আনা হবে। ক্রিয়াপদগুলিকে ‘ গ্যালো ‘, ‘ গ্যাছে ‘, ‘ দ্যাখাবে ‘ এইভাবে লেখা হবে ( যদিও এই স্টাইল পঞ্চাশ-ষাট বছরের পুরনো)। পাশাপাশি ‘ ব্যাড়াচ্ছে ‘ না-লিখে ‘বেড়াচ্ছে ‘ও বিরাজ করবে। সন্ধেবেলার ভুল বানান ‘ সন্ধ্যেবেলা ‘ও থাকবে। চর্যাপদের অনুকরণে কবিতা থাকবে, জীবনানন্দের প্যারডিও।
সবচেয়ে চমকপ্রদ যা তা হল কিছু অশ্লীল শব্দের নর্ম ব্যবহার। মোহিত পাঠক বুকের বাঁ দিকে শিহরন সয়ে যেন ভাবে, আহা, এমন বই আগে তো পাইনি !
এসব কাব্যগ্রন্থের অন্যতম সোনার পালকটি হল, কোনও কবিকে দিয়ে ভূমিকা লিখিয়ে নেওয়া। ওই প্রকাশনা সংস্থাই সেটা করিয়ে নেবে। সেই মুখবন্ধের কবির খ্যাতি প্রাতিষ্ঠানিক হতে পারে, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার জন্য হতে পারে আবার হাংরি আন্দোলনকেন্দ্রিকও হতে পারে। শেষেরটি হলেই জমে বেশি। ভূমিকাকে ভূমিকা না-লিখে, মুখবন্ধ না-লিখে ইতিমুখ লেখা হবে।
সেই প্রবীণ, বিদগ্ধ কবি কিছু অদ্ভুত, অচেনা ‘ শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম ‘ জাগানো শব্দবন্ধ ও বিশেষণ ব্যবহার করে নিজের জাত চেনাবেন। ‘ কৌমসমাজ ‘, ‘ আস্তিত্বিক প্রশ্ন ‘, ‘ জলবিভাজক সম্পর্ক ‘, ‘ প্রতিস্ব গুলো/ প্রতিস্ববীজ/প্রতিস্ব-পরিসর ‘ ( এই ‘ প্রতিস্ব ‘ শব্দের অর্থ আমি আমার দীন অভিধানে খুঁজে পাইনি), ‘ সংবেদনের ইমপ্লোজান ‘ ( ইংরেজি implosion ), ‘ স্পৃহার ডমিনো এফেক্ট ‘ ইত্যাদি শব্দচ্ছটায় উদ্দিষ্ট বইটি সম্পর্কে সম্ভ্রম-আকর্ষণ চেগে উঠতে বাধ্য।